আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি ক্রাউন সিমেন্টের সৌজন্যে প্রথম আলোর বিশেষ আয়োজন অভিজ্ঞতার আলোয়। আজ আমি এসেছি আমার শিক্ষক, আমাদের শিক্ষক, বাংলাদেশের স্থাপত্যবিদ্যার একজন মহিরুহ ব্যক্তিত্ব এবং একজন দার্শনিক ব্যক্তিত্ব, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুরাগী ব্যক্তিত্ব স্থপতি সামসুল ওয়ারেস স্যারের কাছে। স্যার, আপনাকে প্রথম আলোর এই বিশেষ আয়োজনে স্বাগত জানাই।
সামসুল ওয়ারেস: আপনাকে ধন্যবাদ।
স্যার, আপনার জীবনী যতটুকু পারি, আমি পড়ার চেষ্টা করলাম। আপনার জন্ম ১৯৪৬ সালের ২১ জানুয়ারি। সেই হিসাবে আপনার বয়স ৭৯ পার হলো। সামনের জানুয়ারিতে আপনি ৮০ হতে যাচ্ছেন।
সামসুল ওয়ারেস: রাইট।
আপনার জন্ম হয়েছিল পুরান ঢাকায়?
সামসুল ওয়ারেস: বংশালে।
আপনাদের বাড়ি কি ঢাকাতেই?
সামসুল ওয়ারেস: আমাদের গ্রামের বাড়ি ঘোড়াশাল, এটা নরসিংদীর মধ্যে পড়েছে। আমরা ওখানে আর থাকিনি। পড়াশোনা করতে গিয়ে আমার বাবা ঢাকায় আসেন। ঢাকা আমাদের বাড়ি আছে। আর আমাদের অন্যান্য ক্লোজরাও সব ঢাকায়। ওল্ড টাউনের (পুরান ঢাকা) ইসলামপুরে আমাদের মেইন বাড়ি ছিল আর আমাদের নিজস্ব বাড়ি ছিল লালবাগে। তো আমি যখন ইউনিভার্সিটি বা ঢাকা কলেজে পড়ি, তখন আমাদের ওই লালবাগের বাসা থেকেই পড়াশোনা করেছি। ওখান থেকেই বুয়েটে পড়াশোনা করেছি।
আপনার বাবার নাম কী?
সামসুল ওয়ারেস: আমার বাবার নাম আব্দুল ওয়ারেস।
উনি গেজেটেড অফিসার ছিলেন সমাজকল্যাণ বিভাগে?
সামসুল ওয়ারেস: সমাজকল্যাণ বিভাগে উনি (বাবা) সরকারি চাকরি করতেন। গেজেটেড অফিসার ছিলেন। আমার জন্মের পরই উনি তখন বহরমপুরে চাকরি করতেন—তখন তো একই ইন্ডিয়া ছিল। বহরমপুরে চাকরি করতেন, এরপর আবার পার্ক সার্কাসে, কলকাতায় সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টেরই আবার একটা কাজে আসেন। তো একদম ছোটবেলায় পার্ক সার্কাসে কিছুদিন কাটে আমার। তারপর ’৪৭-এর আগস্টেই, আগস্টের জাস্ট ১৪-১৫ আগস্টের পরপরই ১৬-১৭ (তারিখের) দিকে বাবা চলে আসেন। এসে তখন সঙ্গে সঙ্গে ওদের চাকরি কীভাবে যেন হয়ে যায়। উনি এসেই আবার চাঁদপুরে গিয়ে জয়েন করলেন। তখনকার আবার নিয়ম ছিল একদম জয়েনিং ডেটে জয়েন করতে হবে। এ রকম কিছু কম্পালশন ছিল। তো ওখানে জয়েন করলেন। আমরা কিছুদিন ঢাকা থেকেই ওখানে চলে গেলাম। তো আমার ওই শৈশবটা…পুরোই ম্যাট্রিক পাস পর্যন্ত চাঁদপুরে ছিলাম। উনি (বাবা) ওই সময় চাঁদপুরেই একটা লম্বা সময় ছিলেন আরকি...পোস্টিং।
চাঁদপুর তো খুব সুন্দর জায়গা। নদীর ধারে, ইলিশের জায়গা, সবুজ।
সামসুল ওয়ারেস: আমার তো খুব পছন্দের জায়গা। ইনফ্যাক্ট, ঢাকার চেয়ে চাঁদপুরই আমার বেশি হৃদয়ের কাছে, শৈশবের কারণে। আর আপনি যেটা বললেন ডাকাতিয়া নদী, পুরান বাজার, নতুন বাজার, তারপর ওখানের নদীর পাড়টা খুব সুন্দর। ওখানে ওই যে কলোনিয়াল বিল্ডিংগুলোও খুব সুন্দর। থানা, তারপর এসডিওর বাংলো, সব মিলেটিলে একটা সুন্দর জায়গা ছিল।
ইংরেজদের সুদূরপ্রসারী কল্পনা ছিল ভীষণ, যেটা আমার কাছে মনে হয়। যেমন রংপুর জিলা স্কুলে—আমি তো রংপুরের—অনেক বড় জায়গা, বিশাল বিশাল মাঠ। আর কারমাইকেল কলেজ তো একরের পর একর জায়গা। একটা বাংলো করে বা রাস্তাগুলো যে করেছে, রেললাইন যে করেছে, দুই ধারে যে জায়গা রেখেছে, আমাদের কালে তো আমরা এটা করলাম না।
সামসুল ওয়ারেস: এটা তো ধরেন ওরা ইনোভেটিভ ছিল এবং ওরা নিজেরা যখন রেল আবিষ্কার করল, এটা কি করা যায় —এগুলো যে ভেবেছে, তো সেইভাবে এসেছে। এটা তো ওই জন্মের থেকেই যে ওরা খুব প্রতিভাবান, সেটা নয়। ও কাজের মাধ্যমে তারা ডেভেলপ করে গেছে। যেকোনো জাতি, আমরাও যদি একটা কাজের মধ্যে পড়ে যাই তো ডেভেলপ করতে পারে, একটা লোক ডেভেলপ করতে পারে।
আমরা এটা নিয়ে আরেকটু পরে কথা বলব, আমরা শৈশবে আছি। আপনি বলছিলেন যে আপনার সহপাঠী হচ্ছে আর্টিস্ট মনিরুল ইসলাম।
সামসুল ওয়ারেস: মনিরুল ইসলামকে আমি পেয়েছি অবশ্য অনেক পরে। ও কিশোরগঞ্জে পড়াশোনা করত। কিশোরগঞ্জ থেকে পড়াশোনা করতে গিয়ে ও ম্যাট্রিকে দুবার বোধ হয় সুবিধা করতে পারেনি, ফেল করে যায়। তারপর ওর ভাই, বড় ভাই বলল যে চাঁদপুরে চলে আয়। ওর বড় ভাইয়ের আবার একটা বেকারি ছিল। বেকারি এবং বাসা একসঙ্গেই—সামনে বেকারি, পেছনে বাসা। ওখানে চলে এসে আমাদের ওই হাসান আলী হাইস্কুল তখন, জুবিলী স্কুলও বলে এটাকে, ওখানে হাশেম খানও একসময় পড়তেন।
আপনার সিনিয়র ছিলেন?
সামসুল ওয়ারেস: সিনিয়র ছিলেন। পিয়ারু বলে একজন আর্টিস্ট ছিলেন, জাদুঘরে ছিলেন। উনিও আমাদের দুই বছরের সিনিয়র। তো আমরা তিন-চারজনই ওখানে বেশ একটা ক্লোজ ছিলাম। তো মনির (মনিরুল ইসলাম) ছিল একেবারে আমার ক্লাসমেট। ওর সঙ্গে থেকে… আমার আবার একটু ছবিটবি আঁকার শখ ছিল। আমি ওই আমার ঘরটর সব ছবি এঁকে—এই যে সাদা ওয়াল—রাখতাম না।
আচ্ছা।
সামসুল ওয়ারেস: দেখে দেখে ছবি আঁকতাম। ম্যাগাজিন থেকে তুলে ফেলতাম এগুলো। আমার বাবা আবার একটু লিবারাল (উদার) ছিলেন। বললেন, তোমার আঁকতে ভালো লাগলে আঁকো। উনি বাধা দিতেন না। ফলে একটু লিবারালিজমটা (উদারবাদ) ওখান থেকে আসে। বাবার প্রশ্রয় পেয়েছি অনেক। হাতের লেখা সুন্দর করে লিখতে হবে, এই জিনিসগুলো উনি সবসময় বলতেন। ভালো করে কথা বলতে হবে। ওটা ওনার শিক্ষা আমরা পেয়েছি।
তো মনির আসলে পরে দেখি যে মনিরের অবস্থা ভালো না। ও ইংরেজি আর অঙ্কে খুব ঝামেলা করে। তো আমি এ দুটো তারে শেখাতে শুরু করলাম। আর ও আমাকে ছবি আঁকার আরও কিছু শেখাল—ও আমার থেকে ভালো ছবি আঁকে। তো আমাকে বলল যে এইটা কর। ওর দেখলাম যে ছবি আঁকার একটা বই আছে।
এখন তো স্যার, মনির ভাই, মনিরুল ইসলাম উনি বিমূর্ত ছবি আঁকেন। আগে ওনার অনেক পুরোনো কাজের মধ্যে ফিগার পাওয়া যায়।
সামসুল ওয়ারেস: না, ফিগারেটিভ তো একটা একাডেমিক (ব্যাপার), একাডেমিকের মধ্যে কিন্তু ফিগার থাকতেই হবে। অ্যাবস্ট্রাকশন প্রথমেই যদি করে তাহলে…
তখন তাঁর ড্রইং ভালো ছিল…
সামসুল ওয়ারেস: অ্যাবস্ট্রাকশন অব রিয়ালিটি। রিয়ালিটিটাই যদি সে না আঁকে, রিয়ালিটি না বোঝে, রিয়ালিটির বাদে অ্যাবস্ট্রাকশন হবে না। অ্যাবস্ট্রাকশন তাহলে অবান্তর হয়ে যাবে। রিয়ালিটিকে কীভাবে অ্যাবস্ট্রাকশন করব—ওই জিনিসটা পরে এসেছে। ও এখন অত্যন্ত সুন্দর স্পেস নিয়ে কাজ করে। তো তখন আমরা দুজন খুব ক্লোজ ছিলাম। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়ে যায়। ও পাস করে, ম্যাট্রিক পাস করে এসে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। অ্যাডমিশন টেস্টে ফার্স্ট হয়ে গেল। তো তখন আমার আবার দুইটা ইন্টারেস্ট। একটা হচ্ছে যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব—সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব অথবা আর্ট পড়ব, মনিরের সঙ্গেই আরকি। ওইটা অবশ্য আরেকটু পরে, ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর। কেন, ইন্টারমিডিয়েট পাস না করলে তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া যাবে না। তো তখন কিন্তু ম্যাট্রিক পাস করলে…
আপনি ওখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে এসে ইন্টারমিডিয়েট করলেন।
সামসুল ওয়ারেস: ইন্টারমিডিয়েট করলাম। ওই সময় আমার সঙ্গে ওর আসা-যাওয়া। আমি আর্ট কলেজে যাই। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় আমি ঠিক করলাম যে না, আর্টই পড়ব। পরে আবার আমার বাবা বললেন, ‘দেখো ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং এগুলো পড়লে ভালো হবে’। তখনো ওই যে আর্ট করে ভবিষ্যৎ ভালো হবে না এ রকম একটা অভিভাবকদের (ধারণা) ছিল। কিন্তু আমার তো শখ আছে, বলে ‘তোমার ভালো লাগলে পড়ো’। তো পরে ঠিক করলাম যে না, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ব। তো বুয়েটে যখন এলাম ইন্টারমিডিয়েট পাস করে, তো দেখলাম যে একটা আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্ট একটা খুলেছে। মাত্র খুলল, এক বছর আগে। ওখানে আমি ঘোরাঘুরি করে দেখলাম যে ওটার মধ্যে একটু ছবিও আঁকার বিষয় আছে। আবার ইঞ্জিনিয়ারিংও আছে। আমার মনে হলো যে এটাই তো আমার সাবজেক্ট। সঙ্গে সঙ্গে আমি মন ঠিক করলাম যে আর্কিটেকচারে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করব। ভর্তি পরীক্ষায় আমি আবার ফার্স্ট হয়ে গেলাম।
স্যার, আমি একটু বলি। আমার ক্ষেত্রে হলো আপনার অপজিটটা। আমি বুয়েটে সিভিলের পরীক্ষা দিলাম। ওটার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। আমার সিরিয়াল হলো ১০৫। আর আমি কোনো প্রস্তুতি, কোচিং-টোচিং কিচ্ছু করিনি। আমি আর্কিটেকচারের পরীক্ষা দিলাম। আমি ড্রয়িং করতে পারতাম। তারপর আমি ওখানে এইটথ হয়ে গেলাম। তখন আমার সামনে প্রশ্ন যে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব নাকি আর্কিটেকচার পড়ব? আমি গিয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হলাম। আর্কিটেকচারটা পড়িনি। এই দুঃখ আমার জীবনেও যাবে না। ওই ইকবাল হাবিব আমার বন্ধু, ওই ব্যাচের।
সামসুল ওয়ারেস: আচ্ছা, আচ্ছা হ্যাঁ।
তো আপনি স্যার আর্কিটেকচারে পড়লেন, এটা তো বিপ্লবী সিদ্ধান্ত।
সামসুল ওয়ারেস: ইঞ্জিনিয়ারিং আমি ভালো করতাম না, আমি পরে বুঝলাম। কারণ, আমি অঙ্কে অত ভালো ছিলাম না। স্কুলে ভালো ছিলাম, কিন্তু এরপর অত ইন্টারেস্ট পেতাম না। কিন্তু ওই ছবি আঁকার ব্যাপার থাকলে যা হয় আরকি! তো দেখলাম যে আমি আবার ফার্স্ট হয়ে গেলাম। দুই বছর আগে মনির অ্যাডমিশনে ফার্স্ট হয়ে ঢুকল, আমি ফার্স্ট হয়ে ঢুকলাম। আমাদের এটা একটা মজার ছিল।
কত সালে, স্যার? ১৯৬৪?
সামসুল ওয়ারেস: ’৬৩। হ্যাঁ, ’৬৩ সালে ওই অ্যাডমিশন টেস্টে ফার্স্ট ইয়ারে ঢুকলাম আরকি!
তখন তো বুয়েটে আর্কিটেকচার বিল্ডিং ছিল না।
সামসুল ওয়ারেস: না, এটা ওই যে মেইন বিল্ডিংটা হলুদ—কি বলে এখন—মাঝখানে হিউজ একটা বিল্ডিং আছে কোর্ট ইয়ার্ডসহ। ওই বিল্ডিংটাতেই একটা সেকশন নিয়ে আর্কিটেকচার ছিল।
আপনাদের শিক্ষকদের মধ্যে বিদেশি ছিলেন।
সামসুল ওয়ারেস: আমাদের তো সব শিক্ষক বিদেশি ছিলেন। প্রথম দিকে তিন-চার বছর সবাই আমেরিকান ছিল। কারণ, এটা আমেরিকান যে এইড, ইউএস এইড বলে, ওটার মাধ্যমে টেক্সাস এএন্ডএম স্কুল; এএন্ডএম হচ্ছে অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড মেকানিক্যাল বোধ হয়, কিন্তু ওখানে আর্কিটেকচারও ছিল। আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে আমাদের এই সরকারের একটা চুক্তি হয় এবং তাতে ওরা আসে। তো পাঁচজন টিচার চলে আসেন। ভ্রুম্যান ছিলেন তখন প্রধান, আমাদের ফ্যাকাল্টি ডিন—রিচার্ড ভ্রুম্যান। উনি আমেরিকান। উনি প্রথম আমাদের ডিন হলেন। আমাদের এটা ফ্যাকাল্টি হলো—ফ্যাকাল্টি অব আর্কিটেকচার অ্যান্ড প্ল্যানিং। তো আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টটা খুলল, প্ল্যানিংটা পরে খোলা হবে, এমন অবস্থা হলো। ভ্রুম্যান সাহেব এই নতুন বিল্ডিংটা করেন। আর্কিটেকচার ফ্যাকাল্টির যে আমাদের বিল্ডিংটা, ওটা উনি ডিজাইন করেন। তো ডিজাইন করে কনস্ট্রাকশন প্রায় শেষ হওয়ার সময় উনি চলে যান। ওনাদের টার্মটা শেষ হয়ে যায়। ওনারা পাঁচ বছরের জন্য এসেছিলেন।
আপনি স্টুডেন্ট হিসেবে ওই বিল্ডিং পাননি। টিচার হিসেবে পেয়েছেন।
সামসুল ওয়ারেস: না, টিচার হিসেবে। এক্সাক্টলি। ভ্রুম্যান সাহেব এবং ওনারা তখন আরও পাঁচজন টিচার আমাদের বাংলাদেশের—ওরা বেশির ভাগ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁদের পাঠালেন যে শর্ট কোর্স করে আর্কিটেকচার পড়ে সেখানে টিচার হবে। তো ওর মধ্যে জহিরউদ্দিন সাহেব ছিলেন। শাহ আলম জহিরউদ্দিন, মোবাশ্বের আলী—এরা চার-পাঁচজন আমাদের টিচার হলেন। তারপর আবার আমাদের সময় এল টিচিংয়ের। আমি পাস করে মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে দু-তিন বছর কাজ করেছি।
আপনি কি ১৯৬৮ সালে পাস করলেন?
সামসুল ওয়ারেস: হ্যাঁ, পাস করলাম।
বুয়েটে পড়ার সময় আপনি কি হলে ছিলেন, নাকি বাসা থেকে?
সামসুল ওয়ারেস: না, পুরোটাই বাসা থেকে। আমার লালবাগের বাসা।
বুয়েটে তখন কি স্যার কালচারাল অ্যাকটিভিটিজ হতো?
সামসুল ওয়ারেস: হ্যাঁ, কালচারাল অ্যাকটিভিটি তো আমাদের আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টে ছিল। আর ইউকসুর মাধ্যমে কিছু হতো। ও সময় ইউকসু বেশ পাওয়ারফুল ছিল।
আপনি কি অংশগ্রহণ করতেন?
সামসুল ওয়ারেস: হ্যাঁ, আমি যদিও কোনো পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে কখনো যাইনি।
কিন্তু বিতর্ক, বক্তৃতা, ছবি আঁকা এ-জাতীয় কাজ, দেয়ালপত্রিকা বের করা।
সামসুল ওয়ারেস: দেয়ালপত্রিকায় মাঝে মাঝে লিখেছি। খুব বেশি আমি ডিবেট-টিবেটে যাইনি। তখন ওই এক্সপোজারটা…
আপনি স্যার একটু মানে লাজুক ছিলেন, সঙ্ঘ লাজুক।
সামসুল ওয়ারেস: একটু ইন্ট্রোভার্ট। হ্যাঁ, বলতে পারবেন। একটু ইন্ট্রোভার্ট ছিলাম।
তারপর আপনি মাজহারুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করলেন।
সামসুল ওয়ারেস: রাইট। মাজহারুল ইসলাম তখন তো অনেক নামকরা আর্কিটেক্ট আমাদের, জানতাম। চেষ্টা করলাম যে ওনার সঙ্গেই থাকতে পারলেই ভালো হবে। তো উনিও খুব মজার। আমরা একদিন দুপুরবেলা—আমি, রবিউল তো চেনেন আপনি। আমি, রবিউল হুসাইন আর রশিদ, আব্দুর রশিদ—এরা কয়েকজন মিলে আমরা ঠিক করলাম যে মাজহারুল ইসলামের ওখানে যদি চাকরি পেয়ে যাই, তাহলেই সবচেয়ে ভালো হয়।
তো ওখানে গেলাম। তখন ওনার সুন্দর একটা কলোনিয়াল বিল্ডিং ছিল তখন, ৩ নম্বর পরীবাগে। ওখানে সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, কখন উনি ডাকবেন। হঠাৎ উনি এলেন। আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। বললেন, কী ব্যাপার, কী চাই। আমরা বললাম যে আমরা এবার পাস করেছি আর্কিটেকচারে। আমি আপনার অফিসে কাজ করতে চাই। উনি বললেন, ভালো কথা, আসেন। আমাদের বললেন যে এটা আপনার টেবিল, আপনার টেবিল—আমাদের তিনজনকে তিন টেবিল দিলেন। এরপর বললেন যে কাজ শুরু করেন। আমি বললাম, আমি পার্টিকুলারলি বললাম যে স্যার, আমরা ঠিক আজকেই প্রস্তুত হয়ে আসিনি। আমরা কালকে ঠিক সময়মতো ৯টায় আসি। আজকে ১১টা হয়ে গেছে। কালকে থেকে আমরা অফিস করি।
উনি বললেন, না না না, কালকে থেকে না, এখন। এখনই বসে যান।...চাকরি শুরু হয়ে গেল। উনি আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন না কিছু, কী করলাম, রেজাল্ট কী।
উনি যেসব নকশা করেছেন, যেমন আর্ট কলেজ, সেগুলো কোনোটা কি আপনি যখন কাজ করেন তখন ছিল?
সামসুল ওয়ারেস: আর্ট কলেজ ’৫৩-তে ডিজাইন করেছেন, ’৫৬-তে এটা কমপ্লিট হয়। রফিকুন নবী যখন ফার্স্ট ইয়ারে, তখন এই বিল্ডিং শুরু হয়।
আপনি তাঁর সঙ্গে যখন কাজ করলেন, তখন কোনো প্রজেক্ট করেননি?
সামসুল ওয়ারেস: জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি, চিটাগং ইউনিভার্সিটি, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটস—এগুলো আমি পেয়েছি। আমি ফার্নিচার-টার্নিচারও ডিজাইন করেছি। আমি বেশি কাজ করেছি চিটাগং ইউনিভার্সিটির। উনি ওই কাজগুলো আমাকে দিতেন। রবিউল করত বেশি জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির। আমরা একেকজন একেকটা…উনিই ডিজাইন করতেন, আমরা ওনারে হেল্প করতাম, আমরা ড্রয়িং করে দিতাম।
স্যারের তো নিশ্চয়ই নিজস্ব চিন্তাভাবনা ছিল, স্থাপত্য দর্শন—সেগুলোর প্রভাব কি আপনার ওপর পড়েছিল, স্যার?
সামসুল ওয়ারেস: অবশ্যই।
লাল ইটের কাজ এগুলো বাংলাদেশের স্থাপত্যের সঙ্গে ভালো যায়—এ রকম একটা ধারণা কি ওনার ছিল?
সামসুল ওয়ারেস: হ্যাঁ, উনি আর্ট কলেজ দিয়ে তো…আর্ট কলেজ তো ব্রিকের করা।
জাহাঙ্গীরনগরেও তাই।
সামসুল ওয়ারেস: জাহাঙ্গীরনগর তো অনেক পরে, ওটা সিক্সটিজ-এ। আর এটা তো ফিফটিজ-এ করেছেন। এরপর তো বিদেশিরাও এসে কিছু কাজ করল—লুই কান; এরা সবাই তো এলেন। সিক্সটিজ-এ এরা আসল। কিন্তু উনি ওই ফিফটিজে কিন্তু ব্রিকের বেশ কয়েকটা কাজ—চার-পাঁচটা বিল্ডিং করেছেন, অনেকগুলো কাজ করেছেন। অর্থাৎ প্লাস্টার না করে যে ব্রিক, এটা ওনার আগে কেউ এখানে করেনি এবং উনি এটা ইন্ট্রোডিউস করেন।এবং আমরা পরে দেখলাম যে ম্যাটেরিয়ালের যে এক্সপ্রেশন, একটা ম্যাটেরিয়াল সুন্দর, ব্রিকটা একটা সুন্দর কালার, তার একটা শেপ আছে, মডিউলার এবং ভালো করে লে করলে সুন্দর টেক্সচার দেয়। এটাকে ঢেকে ফেলার তো দরকার নেই—অনেস্ট এক্সপ্রেশন অব ম্যাটেরিয়াল। তখন আমরা এগুলো শিখলাম যে প্লাস্টার করলে আমরা হাইড করে ফেলি আসল ম্যাটেরিয়ালটা। যেটা দিয়ে কনস্ট্রাকশন করলাম, ওটা যদি আমরা এক্সপ্রেস করি, তাহলে এটা অনেস্টি হয়। আর তা ছাড়া অনেস্টির মাধ্যমে যেটা হয়, মানুষের কাছে বেশি অ্যাকসেপ্টেবল হয়। ওই আর্টিফিশিয়াল লাগে না। আপনি প্লাস্টার করেন, কাগজ লাগান, ওয়ালপেপার—তখন এটা আর্টিফিশিয়াল লাগে। অনেস্ট এক্সপ্রেশন কাঠকে কাঠের মতো, ইটকে ইটের মতো, কংক্রিটকে আমরা যে এখন কংক্রিট এক্সপোজ কংক্রিট করি, এটা একই কারণ হচ্ছে যে অনেস্ট এক্সপ্রেশন অব ম্যাটেরিয়াল। এটা আমরা নেচার থেকে শিখেছি। গাছের যে বাকল, গাছের পাতা, এর তো কোনো প্লাস্টার থাকে না। নিজস্ব যেটা থাকে।
স্যার, প্রকৃতিতে তো আমি লাইনও দেখি না, জ্যামিতিক শেপ, চাঁদ ছাড়া তো...
সামসুল ওয়ারেস: নেচার ডাজ নট ক্রিয়েট স্ট্রেট লাইনস, অর রাইট অ্যাঙ্গেল। স্ট্রেট লাইন মাঝে-মধ্যে পাওয়া যায় সুপারি গাছ-টাছ। কিন্তু নেচার ডাজ নট প্রডিউস রাইট অ্যাঙ্গেল। তার মানে হচ্ছে যে প্রকৃতিতে আমরা ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল পাই না, এটা একমাত্র মানুষ করে। মানুষ জ্যামিতির মাধ্যমে ওই অ্যাবস্ট্রাকশন করে নেচারকে বোঝার চেষ্টা করে। নেচার কিন্তু একটা প্রসেস। নেচার একটা প্রসেসের মধ্যে হয়। এটা ডেভেলপ করতে একটা বিচি লাগালেন, ওটা পানি দিলেন, কয়েক দিন পর একটা চারা হলো, পাতা ফুটল, পাতা হলো, এরপর আরও বড় হলো, ফল হলো, ফুল হলো। এটা তো এক জায়গায় থেমে নেই এবং একসময় এটা পাতা মরে যায়, গাছটা মরে যায়। আমরাও নেচার। তো নেচারের অংশ হিসেবে আমরাও ওই একই—মানে নিরন্তর পরিবর্তনশীল। সে জন্য মানুষের কাজ তো নিরন্তর পরিবর্তনশীল নয়। আমাদের একটা ফিক্স শেপে তৈরি করে দেয়। ওটা চলতে থাকে।
আচ্ছা, এই যে এটা বললেন যে প্রকৃতিতে রাইট অ্যাঙ্গেল নেই। কিন্তু এই ধরেন যে আমি তো বাংলাদেশের মানুষ, পূর্ব বাংলা বা বাংলা এই অঞ্চলটা পলি পড়ে হলো। আমার কাছে লাগে যে আমরা হচ্ছে মাটির সন্তান। মাটিতে জন্মগ্রহণ করে ওখানেই নদীর ধারে বসবাস করেছি। নৌকায় চলাচল করেছি, বর্ষাকালে নৌকা। তারপরে গরুরগাড়ি। আমরা কাঁচা ঘর বাঁশ দিয়েই বানাই, যেভাবেই বানাই; আমরা তো এই জিওমেট্রিক ফর্মের মধ্যেই থাকলাম। আবার আফ্রিকানরা দেখি অনেক গোল বাড়ি করে। এমনি স্যার স্ট্রেট লাইন এবং রেক্ট্যাঙ্গুলার জায়গায় থাকার জন্য তো সুবিধাজনক।
সামসুল ওয়ারেস: জ্যামিতির সাহায্যে আমরা স্ট্রাকচারটাকে যত সহজে বুঝি, একটা ফ্রি ফর্মের একটা ফর্মের মধ্যে স্ট্রাকচার কিন্তু ক্যালকুলেট করা বেশ কঠিন। ওটা লোড ভ্যারি করছে, স্পেস বাড়ছে, কমছে। তো ওটা আমাদের সুবিধা হয় না বলেই তো আমরা তো একটা সুবিধার জায়গায় আসব। সে জন্য জ্যামিতি আমাদেরকে সুবিধা দেয়। তার মানে এই নয়যে আমরা ফ্রি ফর্মে কাজ করি না। অনেক ফ্রি ফর্মেও কাজ হয় আজকাল। কংক্রিট হওয়ার পরে এবং উন্নত স্ট্রাকচারাল সিস্টেম হওয়ার পরে আমরা অদ্ভুত অদ্ভুত শেপে কাজ হচ্ছে এখন। কম্পিউটার হওয়াতে আরও সুবিধা হয়েছে। কম্পিউটারের অ্যানালাইসিস করে কন্টিনিউয়াসলি কার্ভ লাইন, মানে প্ল্যান কার্ভ, রুফে কার্ভ—নানান জিনিস করা হচ্ছে তো এখন। কিন্তু কনভিনিয়েন্স ছিল ওটা।
আর যে গোল করা হয়, গোল করা হয় সাধারণত এস্কিমরাও গোল করে বা শীতের দেশে গোল করে, তাতে হিট কনজার্ভ করতে পারে ভেতরে। ওই যে একটু আগুন জ্বালায় ওরা ওপর দিয়ে ধোঁয়া বের হয়। যেমন মঙ্গোলিয়াতে আছে, ওদেরকে ‘ঘের’ বলে, তো ওই সবেরই ওইটা। আর আমাদের ছিল বাতাস কীভাবে (আসবে), ওরা কিন্তু বন্ধ করে রাখে সব, ক্লোজড ফর্ম। ভেতরে গরমটা থাকে, বাইরে কিন্তু বরফ পড়ছে। আর আমাদের হলো যে জানালা-দরজা বন্ধ করে দিলে ভীষণভাবে গুমট হয়ে যায়। ফলে ভেন্টিলেশন লাগে। আমাদের তো সব পারফোরেটেড হলে ভালো। বাঁশের যে বেড়া, বাতাস আসে-যায় ওটাই কিন্তু আমাদের জন্য ভালো। আর গাছটাছ লাগিয়ে ছায়া দিতে পারলে…কাছে একটা গাছ থাকলে…
আগে তো খড় দিয়ে হোক, পাতা দিয়ে হোক, লতা দিয়ে হোক ছাদ করত তো, ওটাও তো গরম হতো না। পরে ঢেউটিনে আসার পরে গরমটা সমস্যা...
সামসুল ওয়ারেস: হ্যাঁ, ঢেউটিন একটা রং ম্যাটেরিয়াল। টোটালি রং ম্যাটেরিয়াল। শীতকালে ঠান্ডা বেশি আর গরমকালে অনেক গরম। তো ওটা কনভিনিয়েন্ট, অনেক দিন টিকে। তো মানুষের ইকোনমির কারণে এটা টিকে গেছে। কিন্তু ছনই ছিল, ছন বা টালি, মাটির টালি…
টালিটা খুব সুন্দর জিনিস ছিল, স্যার।
সামসুল ওয়ারেস: ওটা খুব সুন্দর কারেক্ট জিনিস ছিল। ওটা তো কালের বিবর্তনে ওটা প্রায় হারিয়েই গেছে। আর বিশেষ করে যে নতুন টেকনোলজি আসছে যে আরসিসি, ফ্ল্যাট স্ল্যাব আমরা করতে পারি। আরসিসি আসার পরে সারা পৃথিবীতেই পুরোনো ভার্নাকুলার আর্কিটেকচারটা বাদ পড়ে গেছে। এটা তো হবেই, এটা তো মানে নিয়ম। যেমন ধরেন ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি সারা পৃথিবী থেকে চলে গেছে। মোটরগাড়ি আর মোটরসাইকেল—ঘোড়ায় না চড়ে মোটরসাইকেল চালায়। ওটা কিন্তু নেগেটিভ না। যতই পরিবর্তন হবে, আমরা এর সঙ্গে সঙ্গে চলব। আবার ভুল হচ্ছে যে ধোঁয়া ছাড়ছে, কার্বন ছাড়ছে। এখন আমরা চাচ্ছি যে ইলেকট্রিক্যাল গাড়ি বানানো যায় কি না। সো, এটা কন্টিনিউয়াস প্রসেসে চলতে থাকবে। আরেকটা জিনিস হলো মানুষ তো বেড়ে গেছে। আমরা যে একতলা বাড়ি, তারপরে অনেক জায়গা নিয়ে একটা বাড়ি করব। আমাদের এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলে মানুষ একাত্তরে ছিলাম আমরা সাড়ে ৭ কোটি, এখন প্রায় ১৮-২০ কোটি। তো এই মানুষ একোমোডেট করতে হবে, জমি তো আর বাড়ছে না। তো ফলে আমাদেরকে ওই অল্প জায়গায় বেশি মানুষ রাখার ব্যবস্থা তো করতেই হবে। কম্প্যাক্ট প্ল্যানিংয়ে যেতে হবে।
আনিসুল হক :
আচ্ছা, মাজহারুল ইসলাম স্যারের প্রসঙ্গে ছিলাম। স্যার, তো বলতেন যে দেশটাকে একটু গুছিয়ে রাখি। আপনিও একটু আগে কথার মধ্যে বলছিলেন যে বাংলাদেশটাকে আমরা গুছিয়ে রাখতে পারলাম না। বিশেষ করে এই যে আমাদের বিমানবন্দরে আগুন লাগল—সেই প্রসঙ্গে আমরা রেকর্ডিংয়ের বাইরে কথা বলছিলাম। মাজহার ইসলাম স্যার সম্পর্কে আপনি আরেকটু বলেন।
সামসুল ওয়ারেস: মাজহারুল ইসলামের তো একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল যে এখানে আর্কিটেকচারটা উনি কী করবেন। উনি শিবপুরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভালো করেছিলেন এবং উনি বিএসসিও পাস করেছিলেন, বিএসসি—ব্যাচেলর অব সায়েন্স। এরপর শিবপুরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেন। এরপর একটা স্কলারশিপ পেয়ে তিনি আমেরিকা যাবেন, তখনই ’৪৭-এর পার্টিশনটা হলো। উনি ’৪৬-এ পাস করেছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শিবপুর থেকে। তো ওই এক বছরের মধ্যে আর যাওয়া হয়নি। তো উনার যেতে যেতে ’৫০ সাল লেগে যায়। আবার ওই স্কলারশিপটা আবার বাংলাদেশে চলে আসে, তখন ইস্ট পাকিস্তান। তো ইস্ট পাকিস্তান থেকে ১৯৫০ সালে গিয়ে উনি ’৫৩ তে ফিরে আসেন। ’৫৩-তে ফিরে আসার কারণেই কিন্তু ভাষা আন্দোলনটা উনি মিস করে গিয়েছিলেন ওই সময়। তো যাহোক, ওটা তাঁর একটা দুঃখের বিষয় ছিল। ওখান থেকে এসে ওনার দায়িত্বটা দাঁড়াল যে এই দেশে…বাংলাদেশের জন্য একটা আধুনিক স্থাপত্য তৈরি করতে হবে এবং তখন তো ভীষণ রকমের মানুষের মধ্যে…স্বাধীন হয়েছে, আমরা দেশটাকে গোছাব—একটা উত্তেজনা ছিল। একটা ভীষণ রকমের... দেশকে সাজাতে হবে। যাঁরাই শিক্ষিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই ব্যাপারটা ছিল আরকি যে দেশটাকে গোছাতে হবে। এ যে ‘গোছানো’ শব্দটা ওখানেই এসেছে। তো ‘গোছাতে’ গিয়ে উনার দায়িত্ব হলো যে আর্কিটেকচার দিয়ে উনি দেশটাকে গোছাবেন, আর্কিটেকচারের মাধ্যমে। তো তখন তিনি যা শিখে এলেন, সেটা এবং আমাদের দেশের যে আবহাওয়া—উনি আবহাওয়াটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এই ভার্নেকুলার আর্কিটেকচারে উনি যাননি। টিনের ঘর বা টালির ঘরে উনি যাননি। উনি দেখেছেন যে আমার নতুন যে টেকনোলজি আছে, সেটাকে ব্যবহার করতে হবে।
আমরাও যে পড়াশোনা করি বা আমিও শিক্ষকতা করি, এখন চারটা জিনিসে আমরা জোর দিই। ইসলাম সাহেবও (মাজহারুল ইসলাম) এটাই করতেন। সেটা হলো সোসাইটিটাকে ভালো করে বোঝা। কারণ, আল্টিমেটলি তো আমরা সোসাইটির জন্য কাজ করি। আর সোসাইটি বললে তো মানুষ, দেশ আসে। তো সোসাইটির ভেতর দিয়েই আর্কিটেক্টদের সোসাইটি। আমরা সোসাইটির জন্য কীকরছি? তো দেশ এবং স্থান সোসাইটির মাধ্যমে আসবে।
দ্বিতীয়ত, আমরা করি যে আবহাওয়া, ইকোলজি। আমার বিল্ডিংটা যাতে ইকোলজিক্যালি কারেক্ট হয়। আবহাওয়ার দিক থেকে মানুষ যাতে কমফোর্টেবল থাকতে পারে ইত্যাদি।
তৃতীয় হচ্ছে যে আমাদের যে একটা প্রোগ্রাম থাকে, আমরা বিল্ডিংয়ের মধ্যে কী করব। ফাংশনগুলো—সেগুলো ভালো করে অ্যানালাইসিস করে এবং কীভাবে এটা করলে বেস্ট হয়, সবচেয়ে ভালো হয়—সেটা।
আর চতুর্থ হলো যে একেবারে লেটেস্ট টেকনোলজি ব্যবহার করার একটা প্রবণতা থাকা। তা না হলে তো ব্যাকডেটেড হয়ে যায়। আপনি তো একবিংশ শতাব্দীতে ঊনবিংশ শতাব্দীর টেকনোলজিতে কাজ করতে পারেন না বা বিংশ শতাব্দীর টেকনোলজিতে কাজ করলে এটা ঠিক হবে না। সো মাজহারুল ইসলাম দেখলেন যে উনি যদি এখনকার আরসিসি ফ্ল্যাট প্লেটে কাজ করলেন। আর ফ্ল্যাট প্লেট কিন্তু প্রথম উনি করলেন। ফ্ল্যাট প্লেট কিন্তু বিম ছাড়া আগে বিল্ডিং করেনি কেউ। তো ফ্ল্যাট প্লেট করতে গিয়ে উনি ইঞ্জিনিয়ারই পাননি তখন। কেউ সাহস করে না। উনি বললেন, আমি বিমটিম দেব না। কারণ, আমি সুন্দর একটা তল চাই, যেটা ছাদ হিসেবে কাজ হবে। তো ওটা উনি ডিজাইন করলেন। উনি নিজেও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার। তো এ জন্য ওই সাহসটা ছিল যে করতেই হবে এটা। তো উনি করলেন। তো ওনার এই কাজগুলো হচ্ছে পাইওনিয়ার। যে উনি একটা ফ্ল্যাট প্লেট করলেন ইঞ্জিনিয়ারিং দিক থেকে, শুধু পিলোটিস দিয়ে, কোন কলামের মধ্যে কোন বেজ নেই, ক্যাপিটাল নেই। আধুনিক যে সিম্প্লিসিটি সহজভাবে তৈরি করা এবং সবাইকে, সব মানুষকে যদি আপনি স্থাপত্য দিতে চান, তাহলে তো আর ওই রাজার বাড়ির মতো করে, ফুল-লতাপতা করতে তো পারবেন না। সে জন্য মেশিন এস্থেটিক্সের একটা ব্যাপার আসছে। যে মেশিনের মতো করে কুইকলি করা। তো ওই জিনিসটা তখন তাঁর মাথায় ছিল এবং টেকনোলজির কারণেই আমরা পেছনে যেতে পারিনি। উনি ফরোয়ার্ড লুকিং মানুষ ছিলেন।
আপনি এরপর বুয়েটে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন কবে?
সামসুল ওয়ারেস: ওই ’৭১-এ। আমি তো মাজহারুল ইসলামের সঙ্গেই থাকব ঠিক করে ফেললাম। উনিও বললেন যে হ্যাঁ, আমরা যত দিন আছি, একসঙ্গে থাকব। তো আমাদের যখন স্বাধীনতাযুদ্ধ হলো, তখন তো মাজহারুল ইসলাম চলে গেলেন কলকাতায়। আমরা কয়েকজন থেকে গেলাম। রবিউল, আমরা উনার ফার্মটাকে পাহারা দিলাম কিছুদিন। এরপর আমরা যে মুক্তিযুদ্ধে ওই বিভিন্ন যে সাপ্লাই করা, টাকাপয়সা তোলা ইত্যাদি কানেক্টেড হয়ে আমরা কিছু কাজ করলাম। এই নদী পার হয়ে হয়ে এগুলো করা হতো তখন। মুক্তিযোদ্ধারা এখানে আসতেন। তো এটার একটা নেটওয়ার্ক ছিল। ওটার মধ্যে আমরাও ছিলাম। ওই যে একটা টিম ছিল ঢাকার ভেতরে থেকে নানা কাজ করত।
আরবান গেরিলা গ্রুপ?
সামসুল ওয়ারেস: কয়েকটা গ্রুপ ছিল। একটার সঙ্গে আমরা ছিলাম। তো যাহোক, ওগুলো করে ’৭১ পার হলো। ’৭২-এ ইসলাম সাহেব এলেন। তখন ’৭২-এ ইসলাম সাহেব যেসব কাজ করছিলেন—চিটাগং ইউনিভার্সিটি, জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি—এগুলো সবই গভর্নমেন্ট বাদ দিয়ে দেয়। ওনাকে বাদ দিয়ে দেয়। এটা কিছুটা ষড়যন্ত্র ছিল। আর তখন থেকেই কিন্তু সরকারে করাপশন আরম্ভ হয়। ওনাকে ডেকে ডেকে কাজ দেওয়া হতো যে আপনি এই কাজটা করেন। একমাত্র আর্কিটেক্ট ছিলেন। তো উনি খুব শকড হলেন যে আমার কাজগুলো নিয়ে গেল! ইভেন আওয়ামী লীগের আমলেও কিন্তু উনি কোনো কাজ পাননি। উনি তো প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন। উনি কাজের জন্য চেষ্টাও করেননি। কারণ, করাপশনের জন্য খুব মুশকিল। সব ফার্মে দেখা গেল যে গভর্নমেন্টের কাজ করছে, ওখানে টাকাপয়সার একটা ব্যাপার হয়। ইসলাম সাহেব তাঁর অনেস্টির কারণেই একেবারে বাদ পড়ে গেলেন। বাদ পড়ে যাওয়াতে উনি আমাদেরকে চিঠি দিলেন যে ‘ইওর সার্ভিসেস আর নো লংগার রিকোয়ার্ড’। একটা চিঠি দিয়ে, সাইন দিয়ে, আমাদেরকে সবাইকে দিয়ে দিলেন। আমরা বেকার হয়ে গেলাম হঠাৎ করে। আর ’৭২ সালে কোনো আর্কিটেকচারাল প্রজেক্ট নেই। ’৭২-’৭৩ সালে। যেগুলো হচ্ছিল, ওগুলো টুকটাক করে চলছিল। লোকজনেরও পয়সা নেই আর খুব দরিদ্র অবস্থা আমাদের। তখন আর কী করি? একটা চাকরি দরকার। ওই সময় বুয়েটে একজন টিচার চাইল। আমি অ্যাপ্লাই করলাম। তো আমাকে নিল আর কি! এই যে ঢুকলাম শিক্ষকতায় আর ছুটতে পারি না। কারণ, আমার উদ্দেশ্য ছিল একজন ভালো আর্কিটেক্ট হওয়া। টিচার হওয়ার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না।
কিন্তু আপনি তো টিচারই হলেন।
সামসুল ওয়ারেস: হয়ে গেলাম। এখন তো কিছু করার নেই। টিচার যখন হলাম, তখন আবার ভাবলাম যে না, এটা তাহলে একটু ভালো করেই করি। এভাবেই হয়তো টিচার হিসেবে একটু...ছাত্ররাই পছন্দ করে।
পরে কি স্যার আরও পড়াশোনা করেছিলেন?
সামসুল ওয়ারেস: না, আমি যেহেতু আর্কিটেকচারাল ডিজাইনে বেশি মাইন্ড ছিল যে ছবি আঁকাটাকা ইত্যাদি। ছবি আঁকায় ধরেন পিএইচডি করলে খুব একটা যে কাজ হয়, আমি বিশ্বাস করি না। যে পেইন্টার, অনেকের তো কোনো ডিগ্রিও নেই, ফেমাস আছে। আর্কিটেক্টের মধ্যেও দু-একজন আছে যাদের ডিগ্রি নেই, এখনো আছে, বর্তমান যুগেও আছে। তো এটা এমন, ডিজাইনটা হচ্ছে ইনটুইটিভ একটা বিষয়। ওটা একটা পার্টিকুলার সাবজেক্টে আপনি স্পেশালাইজ করে আসলে লাভ হয় না। আপনি দেখেন, যাঁরা পিএইচডি করে আসছে আর্কিটেকচার, ওরা কেউ আর্কিটেক্ট হিসেবে নাম নেই। ওরা টিচার হয়েছে ঠিকই আছে। এটা কিন্তু ক্রিয়েটিভ ইয়েতে…
রবিউল ভাই (রবিউল হুসাইন) কবি এবং আর্কিটেক্ট। আর্কিটেক্ট ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। রবিউল ভাই কিন্তু খুব ইনোভেটিভ ছিল। লিটল ম্যাগাজিন কতগুলো করতেন—উদ্ভট উদ্ভট মানে একদম পরীক্ষণ, এক্সপেরিমেন্টাল কাজ ওনার ছিল।
সামসুল ওয়ারেস: ওর ছিল যে…আমরা যখন আর্কিটেকচার পড়ি, তখন আমরা সব আর্টের মুভমেন্টটা পড়ি। আর ও তো নিজে কবি ছিল—মানে কলেজ লাইফ থেকেই সে কবিতা লেখে। ফলে ওই যে ডাডা, সুররিয়ালিজম—এগুলোর ভেতর দিয়ে তো আমরা গেলাম সবাই। তখন কামু আর কাফকা। সিক্সটিজে আমাদের তখন এক টাকা বারো আনা দিয়ে বই কিনতাম কাফকার আর কামুর বই—আলবেয়ার কামু। তো ওই সব বই আমরা যখন পড়ে ফেলাতে আমাদের…
অস্তিত্ববাদী দর্শন?
সামসুল ওয়ারেস: অস্তিত্ববাদী দর্শন আমাদের ভীষণ ইয়ে প্রভাবিত করে। পরে এই সুররিয়ালিস্টদেরও যে অবচেতন মনের বিষয়গুলো, এগুলো ফ্রয়েডিয়ান ব্যাপারগুলো আসে তখন। আর তখন সারা পৃথিবীতেই এগুলো বেশ কাজ করছিল আর কি। সে জন্য ওই যে ‘না’-টা কিন্তু ওই ডাডা, সুররিয়ালিজম এবং অস্তিত্ববাদীদের একটা মিশ্রণের ফলে…
‘না’ নামেই তার ম্যাগাজিনটা, লিটল ম্যাগাজিন!
সামসুল ওয়ারেস: না বলতে ওরা ‘নো টু নেগেটিভ থিংস।’ বা ‘নো টু কনভেনশনাল থিংস’ বলে।
আপনি কি এই রবিউল হুসাইনের ‘না’ পত্রিকায় নিজে লিখেছেন?
সামসুল ওয়ারেস: না, আমি কবিতা লিখিনি।
আর স্যার আপনার লুই কানের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কবে থেকে শুরু হলো?
সামসুল ওয়ারেস: আমি ওই ছাত্রবস্থায় ছয় মাসের মতো কাজ করেছিলাম। ... লুই কানকে তো আমরা পাইনি। লুই কানের এখানে একটা অফিস ছিল, এখানকার কাজগুলো দেখাশোনা করার জন্য।
ওনাকে আপনি দেখেননি?
সামসুল ওয়ারেস: না, দেখেছি। ওনাকে তো অনেকবারই দেখেছি। উনি তো আমাদের বুয়েটে এসেও লেকচার দিয়ে গেছেন।
সেটা তো পরে। যখন কাজ করেছেন তখন?
সামসুল ওয়ারেস: উনি মাঝেমধ্যে আসতেন, যখন-তখন দেখা হতো। কিন্তু ওই যে কাজ করার সময় ওনার সঙ্গে বসে বা ওনার গাইডেন্সে কাজ করা হয়নি। ওনার সেকেন্ড লোক যাঁরা ছিলেন এখানে, ভলমেয়ার একজন ছিলেন, ওনার সঙ্গে কিছু কাজ করেছি। ওনারা ছোট কাজটাজ দিতেন আমাদের। আমরা তো স্টুডেন্ট, ঠিক আর্কিটেক্টও না। কিন্তু এটাও অনেকটা কাজে লেগেছে আরকি, একধরনের কাজ।
আপনি বিয়ে করলেন কবে?
সামসুল ওয়ারেস: আটাত্তরে।
৩২ বছর বয়সে?
সামসুল ওয়ারেস: হ্যাঁ, একটু লেটে। লেট বলতে পারেন।
আপনার পাঁচ ছেলেমেয়ে। ওনারা সবাই বিদেশে থাকেন। আপনি এখানে ভাবিকে নিয়ে ভালোই আছেন তো। সুন্দর, বাসাটা খুব সুন্দর।
সামসুল ওয়ারেস: হ্যাঁ, আপনার তো আমার নেইবার হওয়ার কথা ছিল। আসলে ভালোই হতো। নেইবার ভালো হলে লাইফ বিকামস বেটার।
লুই কান সম্পর্কে আমরা তো ‘মাই আর্কিটেক্ট’—লুই কানের ছেলে নাথানিয়েল কান যখন এলেন বসুন্ধরাতে, প্রথম প্রদর্শনীটা দেখতে গেলাম। দেখে তো খুবই মর্মস্পর্শী কাহিনি যে লুই কান তাঁর, নাথানিয়েল কানের মায়ের সঙ্গে থেকেছেন কিন্তু…
সামসুল ওয়ারেস: ম্যারিড ছিলেন না।
অন্যত্র তাঁর স্ত্রী ছিল। স্ত্রীকে রেখে এই বাসাটায়, খুব সুন্দর একটা জঙ্গলের মধ্যে সুন্দর বাসা, মাঝেমধ্যে আসতেন। ওই দিনের ভিডিওটা করা আছে যে লুই কান তাঁদের সঙ্গে খেলতেন, খেলেছিলেন। তারপর অবাক কাণ্ড যে লুই কানের, মানে নাথানিয়েল কানের মা শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন যে একদিন না একদিন লুই কান ফিরে আসবেন তাঁর কাছে, না? তারপরে তাঁর ছেলে, যাঁর পিতৃপরিচয় মানে বৈবাহিক ছিল না, বাবাই তো। বাবার অন্বেষণে যখন বের হলেন, সারা পৃথিবীতে যেখানে লুই কানের কাজগুলো আছে দেখতে গেলেন, তাই না? গ্রিস, ইসরায়েল, ইন্ডিয়া, নানা দেশ ঘুরে বাংলাদেশে এসে দেখাচ্ছেন, বাংলাদেশের বুড়িগঙ্গা, সেখান থেকে আমাদের জাতীয় সংসদ ভবনের লেকটা, পানিগুলো। তারপরে বিল্ডিং। তারপরে জিজ্ঞেস করছেন লুই কান সম্পর্কে কে কী জানেন? এই বিল্ডিংয়ের আর্কিটেক্ট কে? একজন বলছেন…
সামসুল ওয়ারেস: লুই ফারা খান।
হ্যাঁ, লুই ফারা খান। তারপরে এলেন আপনার কাছে। আপনাকে জিজ্ঞেস করলেন লুই কান সম্পর্কে। তখন তো আপনি মর্মস্পর্শী বক্তৃতা, কথা বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেললেন। যে লুই কান আমাদের গণতন্ত্রের প্রতীক। মনে আছে স্যার আপনার?
সামসুল ওয়ারেস: হ্যাঁ, অনেক আগে। এটা ২০০৩ সালে, ডকুমেন্টারিটা হয়েছিল।
তারপর আপনি কী বলেছিলেন সেটা মনে আছে? লুই কান সম্পর্কে ওই ক্যামেরায়?
সামসুল ওয়ারেস: আপনি বলেন।
আপনি বলেছেন, লুই কান সম্পর্কে তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছ? তুমি জানো লুই কান কে? লুই কান আমাদের দেশের গণতন্ত্রের প্রতীক। এই যে এটা, এটা আমাদের—বলতে বলতে আপনি কাঁদতে শুরু করলেন।
সামসুল ওয়ারেস: অনেক পরে, হ্যাঁ।
যখন কাঁদতে শুরু করলেন, আমি ওই যে বললাম যে বসুন্ধরা থিয়েটারে আমরা এটা দেখছি, আমরা সবাই কেঁদেছি। কারণ, নাথানিয়েল কান তাঁর বাবাকে খুঁজে পেলেন। বাবাকে খুঁজে পেলেন বাংলাদেশে এই স্থাপত্যে এবং আপনার অশ্রুতে। এবং তিনি কিন্তু স্যাটিসফায়েড হলেন। তাঁর অন্বেষণটা, সার্চটা—ফর হিজ ফাদার, এইটা এসে মিলল জাতীয় সংসদ ভবনে। লুই কানের অমর কীর্তি, না? তো স্যার, লুই কান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? আরকি, এতটুকুন তো জানি। আর্কিটেক্ট হিসেবে কেমন?
সামসুল ওয়ারেস: আর্কিটেকচার তো একটা ব্যবহারিক শিল্প, বেসিক্যালি ব্যবহারিক শিল্প। শিল্পের তো ধরেন কবিতাও শিল্প, লিটারেচারের সবই শিল্প, গান শিল্প। তো আপনার নাটক, ড্রামা, মিউজিক সবকেই আমরা আর্টে ফেলি। তো আর্টের মধ্যে আমরা যেটা বলি আরকি, সব আর্টই কবিতা হতে চায়। কারণ হলো, যখনই আমরা সুন্দর একটা চিত্র দেখি, পেইন্টিং দেখি, তখন আমরা বলি যে কম্পোজিশন সুন্দর, কালার দেখি। আমরা বলি, পোয়েটিক। তো এই পোয়েটিক হওয়াটা লাগে, যেকোনো শিল্পে। ইভেন আমরা ওই যে ভিজ্যুয়াল পোয়েট্রি পেইন্টিংকে বলি। তো পোয়েট্রি আবার হতে চায় মিউজিক। পোয়েট্রি হতে চায় মিউজিক। আর মিউজিক হতে চায় স্পিরিচুয়াল। যেকোনো শিল্পেরই আলটিমেটলি কিন্তু স্পিরিচুয়াল। পোয়েট্রি, মিউজিক পার হয়ে ওই স্পিরিচুয়াল জায়গায় যেতে হয়। আমরা একটা সুন্দর বাড়ি দেখলে বলি, ইটস ভেরি পোয়েটিক। তাজমহলকে তো পোয়েটিক বলাই যায়। তো তাজমহলকে আবার আমরা বলি ফ্রোজেন মিউজিক, অনেকেই বলে।
হিমায়িত সংগীত।
সামসুল ওয়ারেস: এবং গ্যেটে একবার বলেছিলেন আর্কিটেকচার সম্পর্কে যে আর্কিটেকচার ইজ ফ্রোজেন মিউজিক। ওখান থেকেই তাজমহলের কথাটা আসছে। আর্কিটেকচার ইজ ফ্রোজেন মিউজিক, মিউজিক ইজ লিকুইড আর্কিটেকচার। এটা কিন্তু ১৮২৬ সালে উনি বলে গেছেন। আর্কিটেকচার সম্পর্কে এত সুন্দর করে আর কখনো কেউ বলেনি। এই লেভেলে আর কেউ বলেনি। কারণ, এটা ব্যবহারিক শিল্প তো। তাই তাকে অত উচ্চ স্থান গ্যেটে দিয়েছিলেন। কারণ, গ্যেটে ওই গথিক চার্চ দেখে উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে জমাটবাঁধা সংগীত হয় ভালো আর্কিটেকচার।
তো লুই কানের কথা বললেন। লুই কান কয়েকটা জিনিসের ওপর খুব জোর দিতেন। একটা হচ্ছে সাইলেন্স। উনি মনে করতেন, সাইলেন্স হচ্ছে সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট জিনিস মানুষের। সাইলেন্সের ভেতর দিয়েই মানুষের বোধিসত্তাটা আসে। আর মিউজিকের চেয়েও বেশি ইম্পর্ট্যান্ট হচ্ছে সাইলেন্স। অনেক রকম চিন্তা থাকে তো। মোৎজার্ট কিন্তু একবার বলেছিলেন, মোৎজার্টকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে আপনি তো গ্রেট মিউজিশিয়ান। তো আপনার মিউজিকের কোন জায়গাটা ভালো লাগে? উনি বলছিলেন যে নো মিউজিক। নো মিউজিক বলতে উনি পজ বুঝিয়েছিলেন। কারণ, উনি একটা বাজিয়ে আবার একটু থেমে যান। ওই পজটাকে উনি বললেন যে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। কারণ, তখন মিউজিকের অনুরণনটা হয়। মিউজিকটা আমি তখন ভালো বুঝি। যখন মিউজিক হয় তখন না। গ্যাপে আমি বুঝি। এ ধরনের মানুষের তো বোধের ব্যাপারগুলো...
তো লুই কানকে আপনি ভালো আর্কিটেক্ট বললে ঠিক বলা হবে না। উনি অ্যাকচুয়ালি মিউজিশিয়ান এবং স্পিরিচুয়াল একটা লোক ছিলেন। আপনি যদি ভালো করে অ্যাসেম্বলি বিল্ডিংয়ে ঢোকেন, আপনি কথা বলতে বলতে ঢোকেন, আপনি দেখবেন যে আপনি আর কথা বলতে পারছেন না। আপনি পারবেন না—এটা এক্সপেরিয়েন্স করতে পারেন। আপনারা তিন-চারজন যান, কথা বলতে বলতে ঢুকছেন, ঢোকার পরে দেখবেন যে সাডেনলি আপনারা আর কথা বলতে পারছেন না। সো অ্যাবজরবিং স্পেস! এবং এটা সাইলেন্স! সাইলেন্স করে দেয় আপনাকে। উনিও বলেছিলেন যে সাইলেন্স—মানে ধরেন আপনি যদি অ্যাসেম্বলি বিল্ডিংয়ের ভেতরের দেয়ালে ফ্লোরে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে অনেকক্ষণ থাকেন তো দেখবেন যে হুসইপার হয়। সাইলেন্স বিগিনস টু টক। তো এই যে জিনিসগুলো লুই কান এ ধরনের ভাষাই ব্যবহার করতেন। ওঁর আর্কিটেকচারটা অন্য লেভেলের, একটা স্পিরিচুয়াল কন্টেন্টে কাজ করেছেন। অ্যাসেম্বলি বিল্ডিংয়ের ভেতরে লাইটের যে খেলা আছে, তার যে হিউজনেস আছে, সেখানে আপনাকে একেবারেই ছোট্ট করে ফেলে। আপনি যখন একদম ছোট হয়ে যান, দেন ইউ স্টার্ট রিয়ালাইজিং গ্রেটার আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব দ্য ওয়ার্ল্ড। যেমন ধরেন আপনি সমুদ্রের পাড়ে গেলে, বিশাল পাহাড় হিমালয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে যেটা হয় আরকি। তো আমরা, আমার মনে হয় যে ওনার ওই অ্যাসেম্বলি বিল্ডিং ওই কোয়ালিটির একটা। সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালে যা হয়, হিমালয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে যা হয়—ওই টাইপের একটা বিষয়। স্পিরিচুয়াল।
খুবই ভালো লাগল স্যার কথাগুলো। এফ আর খানের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হয়নি?
সামসুল ওয়ারেস: হ্যাঁ, এফ আর খান ঢাকায় এলে আমি প্রথম—যদিও উনি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার, আমি তখন ইনস্টিটিউটের সেক্রেটারি ছিলাম। ইনস্টিটিউটে আবার প্রেসিডেন্টও ছিলাম। ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ। ওটা আমরা মাজহারুল ইসলাম, আমি এবং আরও কয়েকজন মিলে আমরা এটাকে প্রথম এস্টাবলিশ করি, ফাউন্ডার মেম্বার আরকি আমরা। তো আমি তখন…
এটা কত সালের কথা স্যার?
সামসুল ওয়ারেস: বাহাত্তর। বাহাত্তরে। বাংলাদেশ হওয়ার পরপরই, ফেব্রুয়ারিতেই।
...আমাদের তো ছিল ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস, পাকিস্তান। তো ওটাকে আবার নতুন করে সাজালাম। মাজহারুল ইসলাম প্রেসিডেন্ট হলেন, আমি ট্রেজারার হলাম। এরপর যখন সেক্রেটারি হলাম, ব্রাঞ্চ সেক্রেটারি, তখন একবার এফ আর খান এলেন ঢাকায়। তখন তাড়াতাড়ি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে আমি একটা লেকচারের ব্যবস্থা করি ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে। তখন আমাদের অডিটরিয়াম ছিল না। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দোতলায় তখন ছিল সেমিনার রুম, এখনো আছে ওটা। তো ওইটাতে আমরা অ্যারেঞ্জ করেছিলাম। ওইভাবে ওনার সঙ্গে খুব ক্লোজ ছিলাম, যেহেতু আমি জেনারেল সেক্রেটারি, ওনাকে ইনভাইট করে এনেছি। এবং উনি ছিলেন একেবারে মাটির মানুষ। এত নামকরা ইঞ্জিনিয়ার, আমি তো ভয়ই পেতাম যে কথাটথা বলা যাবে কিনা। উনি দেখতাম যে মুড়িটুড়ি (মাখিয়ে খেতেন)…রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারতেন। অসাধারণ লোক ছিলেন।
ওনার যে ওই বিখ্যাত উক্তিটা স্যার, ‘দ্য টেকনিক্যাল ম্যান মাস্ট নট বি লস্ট ইন হি ওন টেকনোলজি। হি মাস্ট নো টু অ্যাপ্রিশিয়েট লাইফ অ্যান্ড লাইফ ইজ মিউজিক, ড্রামা, আর্ট অ্যান্ড মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি পিপল।’ ওটার মধ্যে তো মিউজিকের কথাটা ভালোমতোই আছে। ড্রামা কথাটা আলাদাভাবে বলেছেন এবং আর্ট।
সামসুল ওয়ারেস: ওইটাই আমি বলছি যে অ্যাকচুয়ালি সায়েন্সের কাজ হলো টু নো হোয়াট ইট ইজ। ওয়ান্স ইউ নো হোয়াট ইট ইজ জব অব সায়েন্স ওভার। পানি কী—সায়েন্স বের করল, এটা হলো H2O। H2O-এর পরে আর কিছু করার নেই, পানি H2O হয়ে গেল। কিন্তু আর্টের কাজ হলো যখন সায়েন্স এটাকে বলে দিল যে দিস ইজ দিস, দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট দিস—তখন কিন্তু এটাকে কোশ্চেন করাই হচ্ছে আর্টের কাজ। আর্টের মূল কাজ কিন্তু ওইখানে। সো, আর্ট—অ্যানি আর্ট বিগিনস হোয়েন সায়েন্স স্টপস, এন্ডস।
সায়েন্সের লোকেরা আমার ওপর রাগ করবে এগুলো শুনলে। কিন্তু ব্যাপারটা এ রকম। এ জন্য আপনার ইঞ্জিনিয়ারিং, যেমন ধরেন আপনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, একটা বিল্ডিং বানালে আপনার কিন্তু সোসাইটি নিয়ে চিন্তা করার ব্যাপার না। আপনার হলো যে আর্থকোয়েকটা কেমনে সলভ করব, ফাউন্ডেশনটা কীভাবে দেব, দেয়ালের বা কলামের ওপর স্লবটা রাখতে পারব কি না—এটা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় হলে আপনার একই কনসিডারেশনে, একই সিস্টেমে করে যাবেন।
আপনার কিন্তু ওই যে আজকে কী বার, সকাল না বিকাল—এগুলো দরকার নেই, তাই না? তো ইঞ্জিনিয়ারিং জিনিসটা হচ্ছে ম্যাথমেটিক্যাল এবং আপনার যে সমাজ বা টাইম, টাইমের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন ধরেন টু প্লাস টু ইকুয়াল টু ফোর—এটা সাধারণ অঙ্ক আরকি। এটা হাজার হাজার বছর যাবৎ টু প্লাস টু ইকুয়াল টু ফোরই আসে।
জানি স্যার, আপনি কী বলতে চাচ্ছেন। মানে আমাদের বলত যে ধরেন ১৪ তলা বিল্ডিংয়ের ওপরে এখানে একটা এক টন পাথর রাখা হয়েছে। এটা নিচের ধরা যাক কলামে বা বিমের মধ্যে কত ওজনটা পড়বে। তো এটার তো একটা ফর্মুলা আছে। করতে করতে এসে সামথিং উত্তর হবে সবার জন্য সেইম, ঠিক আছে। কিন্তু আর্কিটেকচার বা কবিতা বা শিল্পী...
সামসুল ওয়ারেস: যেহেতু নিজেও একজন…খুব মজার একটা মানুষ আপনি। কারণ, আপনি একদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং জানেন, সায়েন্স ভালো জানেন, আবার আরেক দিকে আপনি সাহিত্যিক।
কিছুই জানি না, যাহোক। ওই জন্য বিস্ময়বোধটা আছে, স্যার।
সামসুল ওয়ারেস: এই যে আপনি তো লেখক হিসেবে নাম আছে আপনার। তো এই যে দুটো জিনিসকে আপনি ভালো বুঝতে পারেন। তো আর্কিটেকচারাল লোকেরা কিন্তু এই দুইটার মধ্যে বিচরণ করি আমরা। আমাদের বিল্ডিং তো খালি এঁকে দিলে হবে না। আমাদের খেয়াল রাখতে হয় যে স্ট্রাকচারটা কেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল হয়। একটা আজব জিনিস তো করতে পারি না।
ওই যে জিনিসগুলো আরকি…সায়েন্স অ্যান্ড আর্টসের একটা ডায়ালেক্টিক্যাল রিলেশনশিপ আছে আর কি, দ্বান্দ্বিক।
আমরা বলছিলাম স্যার এফ আর খান খুব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। উনি একাত্তর সালে আমাদের জন্য কাজ করেছেন। ছবি পাওয়া যায় এবং মনে হয় ভিডিও-ও পাওয়া যায়, উনি মেঝেতে বসে আমেরিকায় রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন।
সামসুল ওয়ারেস: রবীন্দ্রসংগীত আমার সামনেও গেয়েছেন। এবং মুড়ি আর শিঙাড়া খেয়ে খুব খুশি হলেন। তো উনি ওই যে কখনো আমেরিকান, আমেরিকান যে কী বলে—ওই জিনিসটা আরকি যেটা অনেকেই করে—একদমই ছিলেন না। ঢাকায় এলে উনি একেবারে মনে হয় যে এই আমাদের এখানেই সারা জীবন ছিলেন। এত সুন্দর অ্যাডজাস্ট করতে পারতেন। আবার ওখানে গেলে কিন্তু কড়া লোক। উনি কিন্তু পার্টনার ছিলেন এসওএমের—স্কিডমোর, ওউইংস, মেরিল। Skidmore, Owings & Merrill (SOM) সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্কিটেকচারাল ফার্ম। বড় বড় প্রজেক্ট আমেরিকারগুলোই করে ওরা এবং সারা দুনিয়াতে করে। উনিও তো অনেক প্রজেক্ট করতেন। হজ টার্মিনাল করলেন জেদ্দাতে, মালয়েশিয়াতে, সিঙ্গাপুরে ওনার অনেক কাজ আছে। আর আমেরিকার টলেস্ট বিল্ডিং উনিই করেছেন ডিজাইন।
উইলিস টাওয়ার? আমি দুইবার গেছি।
সামসুল ওয়ারেস: ওখানে এফ আর খানের একটা ম্যুরাল আছে, দেখছেন বোধ হয়, গোল্ডেন কালারের।
হ্যাঁ, ওইখানে এই কথাটা লেখা ছিল।
সামসুল ওয়ারেস: উনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একজন মহিরুহ মানুষ।
স্যার, ওনাকে আইনস্টাইন অব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বলা হয়।
সামসুল ওয়ারেস: বলা হয়, রাইট, আইনস্টাইন অব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বলা হয়। কিন্তু মজাটা হলো যে আইনস্টাইন কিন্তু বেহালা বাজাতেন। মানে ওই লেভেলে গেলে, আমি যেটা বলছিলাম আরকি, যে আপনি একটা স্পিরিচুয়াল লেভেলে গেলে তখন কিন্তু আপনি বুঝতে পারেন যে লাইফের আসল ব্যাপারটা কী।
ইঞ্জিনিয়ারিং খুবই ইম্পর্ট্যান্ট জিনিস। আবার আর্টও। এই দুটোর মিশ্রণ কিছু কিছু ব্যক্তির মধ্যে হয়। এফ আর খান কিন্তু ও রকম ছিলেন। লুই কান ও রকম ছিলেন। আইনস্টাইন ওরকম ছিলেন। উনি (আইনস্টাইন) যখন জার্মানি থেকে চলে আসেন আমেরিকায়, তখন ওনার একটা ছোট্ট স্যুটকেস ছিল, টিনের। আমাদেরও কিন্তু ছোটবেলায় টিনের স্যুটকেস ছিল। টিনের স্যুটকেস আর একটা বেহালা। এক হাতে বেহালা, আরেক হাতে টিনের স্যুটকেস—এইভাবে আমেরিকায় গিয়ে উপস্থিত…
আপনার চুলের সঙ্গে গোঁফের সঙ্গে মিল আছে আইনস্টাইনের।
সামসুল ওয়ারেস: কিছুটা।
এফ আর খান (ফজলুর রহমান খান) সম্পর্কে আর কোনোস্মৃতি আছে স্যার?
সামসুল ওয়ারেস: না, এফ আর খান তো খুব অল্প বয়সে মারা গেলেন। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগেও আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ঢাকায় উনি আসতেন। আমি আর রবিউল দুজন মিলে ওনার সঙ্গে দেখা করে বললাম, আমরা তো ঢাকার একটা মাস্টারপ্ল্যান করতে চাই। তো কী করা যায়? ওটা বোধ হয় সেভেন্টিজের শেষের দিকে—’৭৬-’৭৭ ওই সময়। এফআর খান তো মারা গেলেন ’৮২-তে বোধ হয়। তো ওই সময় ওনার সঙ্গে দেখা করে আমরা বললাম, এফআর খানের সঙ্গে আবার আত্মীয়তা ছিল রাশেদ খান মেননের ছোট ভাই একজন আর্কিটেক্ট আছে। ওনার নাম তো মনন। ...মননকে ধরলাম যে এফআর খানের সঙ্গে একবার দেখা করাও, আমার কথা আছে। তো আমরা তিনজন গিয়ে বললাম। উনি বললেন, ঠিক আছে। তো উনি পুরো ঢাকার মাস্টারপ্ল্যান করে পাঠিয়েছিলেন আমাদের কাছে।
সেটা কই?
সামসুল ওয়ারেস: উনি বলছিলেন যে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী তোমাদের এখানে যদি করে, তাহলে তোমরা যাবা, আমার ওখানে ট্রেনিং নিবা, এখানে এসে আবার করবা। বড় ধরনের একটা চিন্তা করেছিলাম। পুরো চিন্তাটা যখন ডিআইটিতে গিয়ে বললাম যে আমরা এরকম করতে চাই এফআর খানের মাধ্যমে... ইত্যাদি। পুরো ডকুমেন্ট দিলাম। তো চেয়ারম্যান তখন বলল, আমি চেয়ারম্যানের নাম তো ভুলে গেছি ও সময়ের, খুঁজে বের করতে হবে ওই সময় কে ছিল। আমাদের তো খুব অল্প বয়স তখন, ’৭৬-’৭৭-এ তিরিশের ঘরে বয়স আমাদের। তো ওই সময় আমরা তো সরল বিশ্বাসে ওটাকে দিয়ে আসছি। এরপর আবার যখন দেখা করতে গেছি, খুঁজেই পায় না আমাদের ডকুমেন্টটা।
আহারে! আমাদের অমূল্য সম্পদ নষ্ট করল।
সামসুল ওয়ারেস: আমরা এত লজ্জায় পড়ছি যে এফ আর খানকে আর আমরা আর... যোগাযোগ করতে ভয় পেয়ে গেছি। তো এই ওখানে ওটা শেষ হয়ে গেছে।
কিন্তু উনি একটা সুন্দর, খুব সুন্দর একটা ওয়ার্কআউট করেছিলেন। কিন্তু উনি ভেবেছিলেন যে আমরা হয়তো এটারে পারব এখানে করতে। আমরা যে এত কাঁচা ছিলাম, আমরাও বুঝি নাই যে এত কাঁচা কাজ হয়ে গেছে। ডিআইটি এটা পাত্তাই দেয় নাই। ফেলে দিয়েছে আরকি।
এখনকার ঢাকায় স্যার আপনি তো ’৪৬-এ জন্মগ্রহণ করেছেন। অনেক দিন ধরে ঢাকার মানুষ। এই ঢাকা দেখে আপনার দুঃখ হয় না?
সামসুল ওয়ারেস: না। অ্যাকচুয়ালি দুঃখ হয় না। কারণ, ঢাকায় অনেক সুন্দর জিনিস হয়েছে। আবার অনেক জিনিস উল্টাপাল্টা হয়েছে।
আপনি তো যখন প্রথম জীবনে আর্কিটেকচার প্র্যাকটিস করতে শুরু করলেন, অনেক বাড়ি বানিয়েছিলেন, একতলা-দোতলা বাড়ি। সেসব বাড়ি তো ভেঙে ফেলেছে।
সামসুল ওয়ারেস: আমার কোনো দুঃখবোধ নাই এজন্য। এটা তো একটা মানে সময়ের...সময়টা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। স্থান এবং কাল—এ দুটিই হচ্ছে মানুষের, মানে বিশেষ করে আর্টের ব্যাপারে এটা বেশি লাগে। সায়েন্সে তো সময়কালের বাইরে কাজ করতে হয়।
আপনি ব্রিটিশদের বানানো বিল্ডিংগুলোকে বলছেন কলোনিয়াল বিল্ডিং। তার মানে আপনার একটা উত্তর-আধুনিক, উত্তর-ঔপনিবেশিক মন আছে বোঝাই যাচ্ছে।
সামসুল ওয়ারেস: না, কলোনিয়াল বিল্ডিং তো এটা আইডেন্টিটি। এটা তো আমার মনের সাথে সম্পর্ক নাই। এটা আপনাকেও বলতে হবে।
আমাদের কাছে যেসব স্থাপনা বিউটিফুল, সবগুলো তো বিদেশিরা বানিয়ে দিয়ে গেছে। মোগলরা—মোগলদের যদি বিদেশি না-ও বলি। তারপর বানাল ইংরেজরা। এখনো যদি ওই মেডিকেল কলেজের ওই রাস্তাগুলোতে যাই, এখনো বড় বড় গাছ। বা রমনা পার্কটা ওরা বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। বুদ্ধদেব বসুর সুন্দর বর্ণনা আছে যে প্রাচ্যের উদ্যান নগরী হচ্ছে ঢাকা।
সামসুল ওয়ারেস: বুদ্ধদেব বসু সেগুনবাগিচায় থাকতেন।
তারপর আইয়ুব খান…শেরেবাংলা নগর। শেরেবাংলা নগরটা এখনো কিছুটা আমরা নষ্ট করছি। ওটা আইয়ুব খান বা পাকিস্তানি আমলে হলো। মুক্তিযুদ্ধের পরে আমরা কী করলাম স্যার? আমরা কি কিছু করতে পেরেছি?
সামসুল ওয়ারেস: না, অ্যাকচুয়ালি আপনার অনেকগুলো ব্যাপার আছে এখানে—পজিটিভ-নেগেটিভ আছে। ঢাকা শহরের মেট্রোপলিটন এরিয়া নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন এরিয়ার ১০ ভাগের ১ ভাগ। জাস্ট ওয়ান টেনথ। মানুষ হচ্ছে নিউইয়র্কে ১৮ মিলিয়ন আর আমাদের ২২ মিলিয়ন হয়ে গেছে এখন ২ কোটি ২০ লাখ।
এত অল্প জায়গায় এত মানুষ!
সামসুল ওয়ারেস: তো আমি বলছি, এই একটা পয়েন্টেই কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে যে এটা কিছুটা আনম্যানেজেবল থাকবে। বাই নেচার এটা হবে। আমাদের তো খুব কনজেস্টেড, কম্প্যাক্ট প্ল্যানিং। অল্প জায়গায় বেশি লোক থাকার একটা প্ল্যানিং আমাদের লাগবে। এগুলো করতে গেলে তো একটা দেশ, দেশের সরকার, তারপর স্থপতি—সবাই মিলে করতে হয়; শুধু স্থপতি এটা করতে পারেন না। আমাদের এখানে সবাই মিলে কোনো কাজ হয়নি। সরকার একেবারেই করে নাই। একটা রাজউক করে দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে দায়িত্ব সব। রাজউকে মানুষই নাই, অল্প কয়টা লোক দিয়ে চলে। এবং তারা তো…আপনি জানেন, আমার চাইতে ভালোই জানেন কী করে ওরা। তো এখন আমি যেটা বলতে চাই, আমেরিকায় যে লোক আছে এই ৫০টা স্টেটে, এরা যদি সবাই টেক্সাসে এসে যায়, সব মানুষ, তখন টেক্সাসের যে ডেনসিটি হবে, ল্যান্ড ভার্সেস মানুষ, সেটা আমাদের বাংলাদেশের মতো।
আরেকটা হিসাব আছে স্যার। পৃথিবীর সব মানুষকে যদি বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্বে বসানো যায়, আমেরিকার অর্ধেকটাতে তা এঁটে যাবে।
সামসুল ওয়ারেস: হ্যাঁ, এইগুলো তো রিয়ালিটি, আমাদের জানতে হবে। প্রবলেমটা হলো আমরা ভালো একটা শহর বললেই আমরা মনে করি আমেরিকা, ইউরোপ। এইভাবে আসলে কম্পেয়ার করা…
কলকাতাটাও তো গুছিয়ে ফেলেছে।
সামসুল ওয়ারেস: আমার মনে হয় না। ওদের আর্কিটেকচার তো অনেক পুওর।
ওদের নতুন বিল্ডিংগুলো খুবই…বেশ একটু দুঃখজনক চেহারা।
সামসুল ওয়ারেস: খারাপ, খারাপ। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি যে যদি আপনি ওই ভাবে কম্পেয়ার করেন, কলকাতায় কিন্তু একটা সময়, ১৯৫০ সালে ছয় গুণ বেশি লোক ছিল ঢাকার থেকে। এখন কলকাতায় লোকসংখ্যা ছয় গুণ থেকে আমাদের চাইতে কমে গেছে। ওরা সময় ও স্পেস পেয়েছে গোছানোর। আমাদের কিন্তু হঠাৎ ’৭২-এর পর অসম্ভব রকমের কনজেশন হয়েছে, এক নম্বর। দুই নম্বর হচ্ছে আমরা কিন্তু এখন ফোর্থ লার্জেস্ট মেগাসিটি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। এগুলো তো হঠাৎ করে হয়ে গেছে। আমরা তো প্রস্তুত না। আমাদের ইকোনমি প্রস্তুত না। আমাদের টেকনোলজি তো নাই। আমরা তো কিছুই, মানে আমরা একটা স্ক্রু-ও বানাই না এখনো। একটা সুই কিনতে হয় চায়না থেকে। তো আমাদের টেকনোলজি ডেভেলপ করে নাই। কিন্তু মানুষ বেড়ে গেছে। তা-ও আমি এটা বলি যে কিছু ভালো আর্কিটেক্ট হওয়াতে কিছু বিল্ডিংয়ের অন্তত চেহারা ভালো হচ্ছে।
বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে আপনার কাছে কার কার কাজ ভালো লাগে?
সামসুল ওয়ারেস: কাশেফের (স্থপতি কাশেফ চৌধুরী) কাজ ভালো। মেরিনার (স্থপতি মেরিনা তাবাশ্যুম) কাজ ভালো। এটা তো ওয়ার্ল্ড রিকগনাইজড হয়ে গেছে। ওয়ার্ল্ডের বেস্ট বিল্ডিং হয়েছে তো কাশেফের, আপনি বোধ হয় জানেন, বেস্ট বিল্ডিং ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।
কোনটা এটা?
সামসুল ওয়ারেস: ওটা হচ্ছে খুলনার কাছে একটা জায়গায়, নামটা মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে। ওই বিল্ডিং সারা পৃথিবীর সবচেয়ে নামকরা আর্কিটেক্টদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ওয়ার্ল্ডের বেস্ট বিল্ডিং হয়েছে ২০২২ সালে। সেটা দুই বছর পরপর হয়। ইংল্যান্ডে তাদের হেডকোয়ার্টার। তারা সারা ইউরোপের আর্কিটেক্ট, অন্য নামকরা আর্কিটেক্টদের জুরি করে এটা করে। সেখানে সেটা হয়েছে। তো আমাদের আছে।
আপনারা ওই গাইবান্ধার কাজটাও যদি দেখেন। ওর একটা স্টুডেন্টস কমিউনিটি আছে। ওই বিল্ডিং, আপনি হয়তো দেখেননি। এ ছাড়া এখন কিন্তু অনেকেই সুন্দর সুন্দর কাজ করছে। বাংলাদেশি মডার্নের অনেক ভালো ভালো কাজ আছে।
পুরো শহরে আপনি যদি বলেন আমেরিকাতে হাঁটলেও ভালো বিল্ডিং আপনার চোখে পড়বে না, কলকাতায়ও। ওই যে সবাই কবি নয়, কেউ কেউ—ব্যাপারটা তো থাকবেই। পুরো বিল্ডিং হবে না কখনো। তবে কলকাতার প্ল্যানিং আমাদের চাইতে ভালো। ওদের প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্টগুলো ভালো। অনেকটা সাহেবরা তৈরি করে দিয়েছিল। আমাদের প্ল্যানিং সবচেয়ে পুওর। ঢাকার কোনো প্ল্যানিং হয় নাই। সেজন্য বিল্ডিং কিছু সুন্দর হচ্ছে, কিন্তু প্ল্যানিং—এই যে ট্রান্সপোর্টেশন বলেন। প্ল্যানিং মানে কী? প্ল্যানিং হচ্ছে কতটুকু জায়গা আপনি দেবেন মানুষ থাকার জন্য, কতটুকুতে আপনি বন করবেন, মানে আপনার পার্ক এরিয়া লাগবে কতটুকু, আপনার স্কুল-কলেজে লাগবে কতটুকু। এগুলোর তো একটা রেশিও (অনুপাত) লাগবে। এই যে আমাদের এখানে স্কুলগুলোর কোনো খেলার মাঠ নাই। এগুলোই তো প্রবলেম। এটা তো ধরেন আর্কিটেক্ট বা কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রবলেম না। আমাদের এত লোক যে আমরা ওই মাঠকেও ভাগ করে প্লট করে ফেলছি অনেক সময়। ঢাকার যে কিছু মাঠ ছিল, সেটাও ভাগ হয়েছে। আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে এগুলো। এগুলো তো আমরা থামাতে পারি নাই। আমরা ব্যর্থ সে হিসেবে। সমস্ত জাতি ব্যর্থ যে একটা শহরকে যে যে জিনিসগুলো…এবং সেটার জন্য দরকার ছিল ভালো একটা কমিটি। আজ পর্যন্ত কোনো কমিটি নাই, যেমন আমাকে কোনো দিন সরকার ডাকে নাই যে আসেন, কী করা যায় ঢাকা শহর নিয়ে। আমরা তো করতে পারতাম। আমরা না পারি, আমরা দুজন এক্সপার্ট আনতে পারতাম, কথা বলতে পারতাম। মানে এগুলো তো নিয়ম আছে করার। আমরা যে চায়না থেকে জিনিস আনি, এখান থেকে আনি, আমাদের অনেক কাজ করি। বিদেশের এক্সপার্ট আনি না কেন? তো আমরা না পারলে করব না? আমাদের এখানে লোকজন চলে যায় চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়াতে, থাইল্যান্ডে। তো ওই রকম ব্যাপার। একটা সময় থাকবে, আমাদের লাগবে না।
পাঁচ বছর পরপর যে সরকার বদলায়, নিয়ম ছিল যে এখানে সরকার এসে এই উচ্চতায় নিয়ে ছেড়ে দেবে। আবার এখানে একটা সরকার আসবে, এইখান থেকে এখানে নিয়ে ছাড়বে। পাঁচ বছর পরপর ফাইভ ইয়ার্স প্ল্যানিং বলে আরকি। কিন্তু আমাদের কিছুই তো হয় না, বিশেষ করে এই যে ফিজিক্যাল প্ল্যানিং।
একটা গ্রাম, আদর্শ একটা গ্রাম—আজকে খুব ইচ্ছা আমাদের একটা গ্রাম ডিজাইন করার। কেউ তো আমাদের অফার দেয় না। আমি তো নিজে গিয়ে একটা গ্রামের মধ্যে বলতে পারি না; মেরে ভাগিয়ে দেবে। আমি ওই জিনিসগুলো আসলে…এখন এগুলো দোষাদোষি করা যাবে না।
আমাদের রিয়ালিটিটা ভালো করে বুঝতে হবে। রিয়ালিটি হলো আসল। এই রিয়ালিটিকে ঠিক করার জন্য সবচেয়ে বড় যারা কাজ করে, তারা হলো পলিটিশিয়ান। তারপর আসে অন্যান্য এক্সপার্টিজ যারা আছে, বিভিন্ন টেকনিক্যাল লোকেরা আসে। আমাদের ওই যে স্তরে স্তরে যে কাজগুলো করার কথা ছিল, সেটা সামহাউ হয়নি। বিক্ষিপ্ত কিছু কাজ হয়েছে।
আর্ট নিয়েও তো স্যার আপনার আগ্রহ। আপনি আর্ট ক্রিটিক। বাংলাদেশে কোন কোন আর্টিস্টের কাজ আপনার মনের মধ্যে বেশি?
সামসুল ওয়ারেস: না, আর্টিস্টদের মধ্যে তো ধরেন জয়নুল আবেদিনের কথা আসবেই। কারণ, ওনার মতো স্পিডে স্কেচ করা…
স্কেচের মধ্যে যে স্পিড।
সামসুল ওয়ারেস: স্কেচের মধ্যে স্পিড আর কারও নাই। তো একেকজন একেকভাবে ভালো। উনি একটা লাইন টানলে ওই লাইনের মধ্যে এত কথা বলতে পারেন। একদম জ্যান্ত লাগে আবার এত কুইকলি আঁকার মধ্যে। ওয়ার্ল্ড ক্লাস, মাস্টার ক্লাসের একজন স্কেচমাস্টার। পেইন্টার হিসেবে আমি অত বড় বলব না। কিন্তু স্কেচে একদম মানে মাস্টারলি ওয়ার্ক আছে তাঁর।
কামরুল হাসানের কাজ ভালো লাগে। কারণ, কামরুল হাসানের যে গরুগাড়িতে মধ্যে মানুষ যাচ্ছে, এত মায়া ধরতে পারে। বাংলাদেশটির একদম অন্তরের কথা বলতে পারে। ওনার মতো অত সুন্দর করে কিন্তু…ওনার যে কাজগুলো আছে গরু, মানুষ—সবার চোখ এক রকম করে আঁকছে কিন্তু। আপনি খেয়াল করে দেখবেন যে মানুষের আর গরুর চোখ এক। তারা একটু অসহায়, যাচ্ছে, কষ্ট করছে। কীভাবে যেন উনি পারতেন এটা! ওনাকে অনেকে ওই যে কিউবিস্ট, টিউবিস্ট বলে। এগুলো আসল কথা নয়। ওনার যে জিনিসটা হচ্ছে যে উনি একদম ন্যাচারালিজম করে না। রিয়ালিজম করে, রিয়ালিস্টিক ছবি। কিন্তু ওর মধ্যে যে ওনার নিজস্ব একটা স্টাইল আছে, নিজস্ব একটা ব্যঞ্জনা আছে বা এক্সপ্রেশন আছে, সেটা কিন্তু ওনার নিজস্ব এবং এটা আর কোনো শিল্পীর অত স্ট্রংলি নিজস্ব একটা ক্যারেক্টার আমাদের দেশে নাই। বেশিরভাগই অন্যান্য জায়গা থেকে, সোর্স থেকে নেওয়া কিছু ছবি। নিজস্ব ক্যারেক্টার তৈরি করার মধ্যেই দুজন প্রথম আসবে।
এরপর আরও আছেন আপনার ট্যাপিস্ট্রি করতেন যে রশিদ চৌধুরী। রশীদ চৌধুরীর কিছু কিছু ট্যাপিস্ট্রি আছে, অসাধারণ কাজ। আমাদের বাংলাদেশের যে কালচার, বিশেষ করে ফিগারের ভেতর দিয়ে ফ্লেইম লাইক কতগুলো ছবি উনি এঁকেছেন। এর ভেতর দিয়ে একটা দেশজ ক্যারেক্টার উনি কিন্তু আনতে পেরেছেন। আর তা ছাড়া ওনাকে ট্যাপিস্ট্রির জনক বলা যায় বাংলাদেশে। এখনো তো আর নাই। উনি একাই ছিলেন এবং একটা স্কুলও করতে চেয়েছিলেন। অকালে মারা গেলেন, অল্প বয়সে মারা গেলেন।
মনির আমাদের তো ওয়ার্ল্ড ক্লাস পেইন্টার। তার ছবির মধ্যে স্পেস অ্যান্ড কালারের যে ব্যঞ্জনা—অসাধারণ। আরও অনেকেই ভালো কাজ করেন এখন।
এতক্ষণ আমরা কথা বলছিলাম বাংলাদেশের একজন প্রধান অগ্রগণ্য স্থপতি, শিল্পভাবুক এবং আমি বলব, স্থাপত্যের দার্শনিক সামসুল ওয়ারেস স্যারের সঙ্গে। এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। স্যার আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সামসুল ওয়ারেস: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।