
দেশের গরিবদের খুব বেশি ‘চাওয়া’ নেই, সচিবদের ‘পাওয়া’ অনেক। গরিব ও সচিবদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে প্রথম আলোর দুটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে এই লেখা শুরু।
রিকশাচালক সোহাগ মিয়া বরিশাল শহরে রিকশা চালান। তাঁর দুটি শিশুসন্তান আছে। একটি মেয়ে, একটি ছেলে। তাঁর স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। যে বস্তিতে সোহাগ থাকেন, সেখানে শিশুসন্তান দুটিকে রেখে আসার উপায় নেই। তাই তাদের নিয়েই রিকশা চালান সোহাগ। একটি শিশু থাকে তাঁর কোলে বসে। আরেকটি রিকশার পাদানিতে জবুথবু হয়ে থাকে।
বরিশাল শহরে গত শ্রাবণের একদিন এই দৃশ্য চোখে পড়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদক এম জসীম উদ্দীনের। তিনি লিখে ফেলেন, ‘বটতলায় থেমে থাকা রিকশায় এক বাবার জীবনসংগ্রামের ছবি’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন (২ আগস্ট, ২০২৫)।
সোহাগ দিনে ৫০০-৬০০ টাকা আয় করেন, তার ৩০০ টাকা দিতে হয় রিকশার মালিককে। তাঁর চাওয়া খুব বেশি নয়, বলছিলেন, ‘যদি নিজের একটা রিকশা থাকত, তয় ওগো (দুই সন্তান) জন্য কিছু করতে পারতাম।’
প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশের পর একজন প্রবাসী সোহাগকে একটি রিকশা কিনে দেন। শিশু দুটির পড়াশোনারও একটি ব্যবস্থা হয়েছে। সোহাগ যেদিন রিকশা হাতে পান, সেদিন মুখে ছিল হাসি।
সোহাগকে নিয়ে ছোট একটি প্রতিবেদন নিয়ে হয়তো আলোচনা তেমন হয়নি, কিন্তু সেটা একজন মানুষের জীবনে পরিবর্তন এনেছে; যা ক্ষুদ্র নয়, ছোট নয়।
এবার বলি সচিবদের ‘পাওয়ার’ কথা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ সরকার প্রভাবশালী আমলাদের ঢাকায় প্লট দিয়েছে। তারপরও অনেক সচিব ঢাকা উড়ালসড়ক প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্পে একেবারে কম দামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়েছিলেন। বিষয়টি অজানা ছিল। গত ১৪ জুন ‘সরকারি জমিতে সস্তায় ফ্ল্যাট নিয়েছেন সচিবেরা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয়। লেখক প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন। এরপর সরকার তদন্ত কমিটি করে এবং বাতিল করা হয় ফ্ল্যাটের বরাদ্দ।
প্রথম আলোর ছোট ও বড় বহু প্রতিবেদন এভাবে মানুষের জীবনে ছোট ও বড় পরিবর্তন এনেছে, বহু প্রভাবশালীকে রুষ্ট করেছে। প্রথম আলো ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেছে, সরকারি নীতির ভালো-মন্দ মানুষকে জানিয়েছে, মানুষের সমস্যা তুলে ধরেছে। মানুষের বিজয়ের কথা, দেশের এগিয়ে যাওয়ার কথাও এসেছে সমানভাবে।
রাষ্ট্রশাসন ও সংবাদপত্র নিয়ে আইরিশ লেখক অস্কার ওয়াইল্ডের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। বক্তব্যটি মোটামুটি এমন, আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট শাসন করেন চার বছর। সুশাসনে সাংবাদিকতার অবদান থাকে চিরকাল।
কথাটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য পুরোপুরি ঠিক, যেখানে গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণ্য করা হয়। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম কখনো ঘুমিয়ে যায় না। প্রথম আলো বিগত সরকারের আমলে স্বাধীন সাংবাদিকতা করেছে। এ কারণে ক্ষমতাসীনদের ‘শত্রুতে’ পরিণত হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেছে, সেটা প্রতিবেদনে, মতামতে, সম্পাদকীয়তে।
আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে অনেক কিছু লিখে দেন। সংবাদমাধ্যম আর ফেসবুকিং ও ইউটিউবিংয়ের মধ্যে পার্থক্য হলো, সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রমাণ থাকতে হয়। যখনই আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে একজন উপদেষ্টা ও একজন সচিব নিজের জেলার জন্য বড় প্রকল্প নিয়েছেন, তখনই আমরা প্রকাশ করেছি ‘বৈষম্যবিরোধী উপদেষ্টার জেলাপ্রীতি, মন্ত্রিপরিষদ সচিবও একই পথে’ শিরোনামের প্রতিবেদন (২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫; আরিফুর রহমান)।
যখনই আমরা প্রমাণ পেয়েছি, তখনই জুলাই শহীদদের তালিকায় ভুয়া নাম নিয়ে লিখেছি। প্রথম আলোর প্রতিবেদক মাহমুদুল হাসানের লেখা ‘জমির বিরোধে খুন, দুর্ঘটনায় মৃত্যু, তবু তাঁরা জুলাই শহীদ’ শিরোনামের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় গত ১৫ সেপ্টেম্বর। প্রতিবেদনে ৫২ জনের নাম ছিল। সে নামগুলো নিয়ে এখন সরকার তদন্ত করছে। যদিও এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রথম আলোর বিরুদ্ধে মানববন্ধন হয়েছে, সংবাদ সম্মেলন হয়েছে।
‘কমিশনার থাকেন ঢাকায়, সড়ক বন্ধ করে ঢোকেন গাজীপুরে’ শিরোনামে নজরুল ইসলামের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় গত ২৪ আগস্ট। প্রতিবেদনটি তুলে ধরেছিল, গাজীপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলেও পুলিশ কমিশনার ঢাকায় থাকেন। এই প্রতিবেদনের পর প্রথম আলোর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার হয়। কিন্তু সরকার পুলিশ কমিশনারকে সরিয়ে দেয়।
বিটিসিএলের ফাইভ-জি প্রকল্প নিয়ে ‘কেনাকাটা আটকে দিয়েছিলেন নাহিদ, তোড়জোড় ফয়েজের’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিও আলোচনা তৈরি করে। গত ২৭ জুলাই প্রকাশিত নুরুল আমিনের এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, যে প্রকল্পে আওয়ামী লীগ আমলে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, তাতে এ আমলেও একই প্রক্রিয়ায় কেনাকাটার চেষ্টা চলছে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর ফেসবুকে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার হয়, প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সংবাদ সম্মেলন করেন। প্রতিবাদ পাঠান। কিন্তু কেনাকাটা আগানোর খবর পাওয়া যায়নি।
সরকারি প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলের জ্বালানি তেল চুরি নিয়ে দুই পর্বের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় গত ১৮ ও ২০ অক্টোবর। শিরোনাম ছিল ‘“তেল চুরি”, ব্রাজিল বাড়ি ও তাঁদের আয়েশি জীবন’ এবং ‘তেল চুরি হয় ধাপে ধাপে, জাহাজ থেকে ডিপোতে’। মো. মহিউদ্দিনের লেখা এই প্রতিবেদনের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযান চালিয়েছে। সরকার তদন্ত করছে এবং চুরি ঠেকাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
‘আত্মসমর্পণকারীরা দস্যুতায় ফিরছে’ শিরোনামে ২০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ইমতিয়াজ উদ্দীনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর সুন্দরবনে অভিযান জোরদার করেছে কোস্টগার্ড।
একটি ছোট প্রতিবেদন বা বড় প্রতিবেদনে সরকারের নীতি বদলানো, মানুষের সমস্যা সমাধান অথবা জীবন বদলানোর এমন উদাহরণ আরও দেওয়া যায়। ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর যাত্রা শুরুর পর থেকে এমন প্রতিবেদন তৈরি এবং প্রকাশ করেই পাঠকপ্রিয়তায় সবার ওপরে উঠেছে প্রথম আলো।
প্রথম আলো ৪ নভেম্বর ২৮ বছরে পা দিয়েছে। সুসাংবাদিকতা, সাহসী সাংবাদিকতা চলবে—আমরা সেটাই আবারও বলছি।
রাজীব আহমেদ, হেড অব ডিপ নিউজ
প্রথম আলো