
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির জানাজার সময় ছিল বেলা দুইটা। কিন্তু সকাল থেকেই রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জড়ো হতে থাকেন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মানুষ। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সংসদ ভবনের দুটি প্রবেশপথ খুলে দেওয়া হলে ভেতরে ঢুকতে শুরু করেন তাঁরা। ফলে জানাজা শুরুর দেড় ঘণ্টা আগেই সংসদ ভবনের সামনের মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে মানুষের ভিড়। জানাজায় শরিক হন লাখ লাখ মানুষ। গতকাল শনিবার জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয় শহীদ ওসমান হাদির জানাজা।
ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ জানাজায় অংশ নেন। হাতে, মাথায় ও শরীরে জাতীয় পতাকা জড়িয়ে জানাজায় অংশ নেন তাঁরা। কেউ ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, আবার কেউ হাদি হত্যার বিচার দাবি করে স্লোগান দেন। ‘আমরা সবাই হাদি হব, যুগে যুগে লড়ে যাব’, ‘হাদি ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ ইত্যাদি স্লোগান দেন তাঁরা।
জানাজা উপলক্ষে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের প্রবেশপথগুলোতে সকাল থেকেই বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিন স্তরের তল্লাশি করে জানাজায় আসা মানুষদের ভেতরে ঢোকানো হয়। সংসদ ভবনসহ আশপাশের এলাকায় বিপুলসংখ্যক সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়।
বেলা সোয়া একটার দিকে ওসমান হাদির মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স আসাদগেট–সংলগ্ন সংসদ ভবন গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। বেলা দেড়টার দিকে উপস্থিত সবাই সেখানে জোহরের নামাজ পড়েন। বেলা দুইটার দিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত হলে শুরু হয় জানাজার কার্যক্রম। জানাজার আগে ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন এবং হাদির জীবনী পড়ে শোনান। এরপর ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবের বক্তব্য দেন।
জাবেরের পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘বীর ওসমান হাদি, তোমাকে আমরা বিদায় দিতে আসিনি এখানে। তুমি আমাদের বুকের ভেতরে আছ এবং চিরদিন, বাংলাদেশ যত দিন আছে, তুমি সকল বাংলাদেশির বুকের মধ্যে থাকবে। কেউ সরাতে পারবে না।’
ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ করার ঘটনার এক সপ্তাহ পেরোলেও হত্যাকারী গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন আবদুল্লাহ আল জাবের। তিনি বলেন, ‘ওসমান হাদিকে ১৬৮ ঘণ্টা আগে গুলি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত খুনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে? আমরা মনে করছি, খুনি একজন নয়, পুরো একটা খুনি চক্র কাজ করেছে। খুনি, খুনের পরিকল্পনাকারী, সহায়তাকারী, পুরো খুনি চক্রকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি জানিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা (জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী) ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীকে (খোদাবক্স চৌধুরী) জনসমক্ষে এসে জানাতে হবে তাঁরা কী পদক্ষেপ নিয়েছেন। যদি না পারেন, তাহলে পদত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি বলেন, ‘সিভিল-মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের (সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা) মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা আওয়ামী সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করুন। আমরা ওসমান হাদির রক্ত বৃথা যেতে দেব না। ওসমান হাদির রক্তের মাধ্যমে এ দেশে ইনসাফ কায়েম হবে।’ কোনো ধরনের সহিংসতার উসকানিতে সাড়া না দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এরপর বক্তব্য দেন ওসমান হাদির বড় ভাই বরিশালের বাঘিয়া আল আমিন কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবু বকর সিদ্দিক। তিনি বলেন, শহীদ ওসমান হাদি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দেশের ১৮-২০ কোটি মানুষের কাছে একটি বার্তা দিয়েছিলেন—কীভাবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হয়।
ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রসঙ্গে বড় ভাই বলেন, ‘সাত থেকে আট দিন হয়ে গেল; দিবালোকে, প্রকাশ্যে রাজধানী ঢাকায় জুমার নামাজের পরে খুনি যদি প্রকাশ্যে গুলি করে পার পেয়ে যায়, এর চেয়ে লজ্জার আমাদের আর কিছু নাই। (খুনি) যদি বর্ডার পার হয়ে যায়, পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা সময়—তারা কেমন করে গেল? এই প্রশ্ন জাতির কাছে রেখে গেলাম।’ বড় ভাইয়ের বক্তৃতার সময় জানাজায় উপস্থিত অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে তিনি হাদির জানাজায় ইমামতি করেন।
সংক্ষিপ্ত বক্তব্য পর্ব শেষে হাদির জানাজায় অংশ নেন সবাই। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান ও সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া মো. গোলাম পরওয়ার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা অংশ নেন। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁনসহ ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারাও জানাজায় অংশ নেন।
জানাজা শেষে সংসদ ভবনের সামনে থেকে ওসমান হাদির মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ–সংলগ্ন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিস্থলে নেওয়া হয়। জানাজা শেষে ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাদির মরদেহ নিয়ে যান। অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে ছিলেন এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, ডাকসুর ভিপি আবু সাদিক কায়েম।
বেলা ৩টা ৫০ মিনিটের দিকে মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স কবি নজরুল ইসলামের সমাধিস্থলে পৌঁছানোর পর দাফন সম্পন্ন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান, সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশা, সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) মামুন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ এম জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য মো. লুৎফর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ, আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, ডাকসুর জিএস এস এম ফরহাদ এবং হাদির পরিবারের সদস্যরা দাফনের সময় উপস্থিত ছিলেন। দাফন শেষে দোয়া পরিচালনা করেন হাদির বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক।
দাফন শেষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে উপাচার্য নিয়াজ আহমদ খান বলেন, হাদি এখন আর শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি ইতিহাস, বাংলাদেশের ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি করে তিনি বলেন, এই নির্মম হত্যাকাণ্ড কোনো সাধারণ অপরাধ নয়; এটি একটি আদর্শকে স্তব্ধ করার অপচেষ্টা। দ্রুত সময়ের মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে পূর্ণাঙ্গ বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিন ১২ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে ওসমান হাদিকে মাথায় গুলি করে দুর্বৃত্তরা। প্রথমে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৫ ডিসেম্বর দুপুরে ওসমান হাদিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার তিনি মারা যান। তাঁর মরদেহ গত শুক্রবার সিঙ্গাপুর থেকে দেশে আনা হয়। রাখা হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের মর্গে। গতকাল সকালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে আবার হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। পরে সেখানে গোসল শেষে মরদেহ জানাজার জন্য সংসদ ভবন এলাকায় নেওয়া হয়। হাদির মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখাসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়।