সামাজিক শিক্ষাকেন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শামিয়ানা টানিয়ে জরাজীর্ণ শ্রেণিকক্ষে চলছে পাঠদান। ২০১৪ সালে (বাঁয়ে)। জরাজীর্ণ শ্রেণিকক্ষের স্থানেই নির্মিত হচ্ছে ছয়তলা ভবন (ডানে)
সামাজিক শিক্ষাকেন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শামিয়ানা টানিয়ে জরাজীর্ণ শ্রেণিকক্ষে চলছে পাঠদান। ২০১৪ সালে (বাঁয়ে)। জরাজীর্ণ শ্রেণিকক্ষের স্থানেই নির্মিত হচ্ছে ছয়তলা ভবন (ডানে)

‘গরিবের বিদ্যালয়টি’ এখন ছয়তলা ভবন হচ্ছে

টিনের চালার জরাজীর্ণ ও ভাঙাচোরা দু-একটি কক্ষ। কখনো শামিয়ানা (ত্রিপল) টানিয়ে অল্পবিস্তর শিক্ষার্থী নিয়ে এসব কক্ষে ভুতুড়ে পরিবেশে চলে ক্লাস—এমন চিত্র নিয়েই বছরের পর বছর ধরে চলেছে বিদ্যালয়টি। ছিল মামলা-মোকদ্দমাও। আরও কিছু সমস্যার কারণে রাজধানীর বেইলি রোডে বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশন চত্বরে থাকা ৬৩ বছরের পুরোনো ‘সামাজিক শিক্ষাকেন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি’র এমন ভগ্নদশা হয়েছিল।

বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা মূলত শ্রমজীবী ও অসচ্ছল পরিবারের সন্তান। এ কারণে এটি ‘গরিবের বিদ্যালয়’ বলে পরিচিত। তবে গতকাল বুধবার সরেজমিনে অন্য রকম চিত্র দেখা গেছে। বিদ্যালয়টির জায়গায় এখন ছয়তলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আগের সেই জরাজীর্ণ টিনের চালা আর নেই। গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশনের অভ্যর্থনাকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা একজনকে বিদ্যালয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ওই ভবনটি দেখিয়ে দেন। পরে নির্মাণাধীন ভবনে গেলে সেখানকার দায়িত্বরত একজন প্রকৌশলী বলেন, ভবনটি সামাজিক শিক্ষাকেন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্যই নির্মাণ করা হচ্ছে।

শিক্ষকেরা বলেন, বিদ্যালয়টির পরিবেশের কারণে অনেকেই ভর্তি হতে চায় না। মূলত শ্রমজীবী ও অসচ্ছল পরিবারের সন্তানেরাই এখানে আসে। বিদ্যালয়ের নতুন ভবন হওয়ার পর সেখানে স্থানান্তর হলে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়বে বলে তাঁরা আশা করছেন।

প্রায় বিলীন হওয়ার পথে ‘গরিবের বিদ্যালয়টি’ এখন শুধু ঠিকঠাক করাই হচ্ছে না, বরং ভালো অবকাঠামো নিয়েই চালু হচ্ছে। বর্তমানে অস্থায়ীভাবে পার্শ্ববর্তী বেসরকারি বিদ্যালয়ের একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। তবে বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম। প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থী মাত্র ৩৩ জন।

শিক্ষকেরা বলেন, বিদ্যালয়টির পরিবেশের কারণে অনেকেই ভর্তি হতে চায় না। মূলত শ্রমজীবী ও অসচ্ছল পরিবারের সন্তানেরাই এখানে আসে। বিদ্যালয়ের নতুন ভবন হওয়ার পর সেখানে স্থানান্তর হলে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়বে বলে তাঁরা আশা করছেন। এ জন্য আশপাশের এলাকায় উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রমও চালাবেন তাঁরা।

বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশন ও বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬২ সালে গাইড হাউস বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করে। পরে ১৯৭৩ সালে অন্যান্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে এই বিদ্যালয়টিও সরকারীকরণ হয়। এরপর বিদ্যালয়টি অধিগ্রহণ করা হয়। তখন থেকে সেটি প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রথম দিকে কোনো সমস্যা না থাকলেও ১৯৮৯ সালে গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে এই বিদ্যালয়টি সরিয়ে নিতে অনুরোধ করা হয়। মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানায়, বিদ্যালয় স্থানান্তরের সুযোগ নেই। একপর্যায়ে বিষয়টি আদালতে গড়ায়। তবে শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে বিদ্যালয়টি আগের জায়গায় অর্থাৎ বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশন চত্বরে থেকেই কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

একাধিক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের ছুটির পর এখন বিদ্যালয় খুলেছে। শ্রমজীবী পরিবারের অনেকেই ছুটি কাটিয়ে এখনো ঢাকায় ফেরেনি। এ জন্যই মূলত উপস্থিতি কম। আবার বিদ্যালয়ের পরিস্থিতির কারণে ভর্তিও কম হয়।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শম্পা রাণী পাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের রায়ের পর ২০২২ সালে নামজারি হয়। এরপর সরকারি উদ্যোগে ২০২৩ সালের নভেম্বরে এখানে ছয়তলা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ জায়গার ওপর ছয়তলা নির্মাণাধীন এই ভবনের প্রতিটি তলায় দুটি কক্ষ থাকছে। শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকদের জন্য অফিসকক্ষ মিলিয়ে প্রতিটি তলা সাজানো হবে। এখন গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ফটক দিয়ে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে হলেও নতুন ভবনে প্রবেশের জন্য পাশে আরেকটি ফটক নির্মাণ করা হবে। এ ভবনটি নির্মাণকাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ২৯ লাখ টাকার বেশি।

সংকট নিয়ে চলছে পড়াশোনা

নতুন ভবন হতে চললেও এখনো নানামুখী সংকট নিয়ে চলছে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম। বর্তমানে পার্শ্ববর্তী বেইলী প্রিপারেটরি স্কুলের একটি কক্ষ মাসে পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে অস্থায়ীভাবে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। শিক্ষক আছেন পাঁচজন। বর্তমানে মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রাক্‌-প্রাথমিকে (শিশু শ্রেণি নামে পরিচিত) ৬ জন, প্রথম শ্রেণিতে ৬, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৬, তৃতীয় শ্রেণিতে ৭, চতুর্থ শ্রেণিতে ২ এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ৬ জন শিক্ষার্থী আছে। তবে গতকাল উপস্থিতি একেবারেই নগণ্য দেখা গেছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে একজন ও পঞ্চম শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থীকে ক্লাসে দেখা গেছে।

একাধিক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের ছুটির পর এখন বিদ্যালয় খুলেছে। শ্রমজীবী পরিবারের অনেকেই ছুটি কাটিয়ে এখনো ঢাকায় ফেরেনি। এ জন্যই মূলত উপস্থিতি কম। আবার বিদ্যালয়ের পরিস্থিতির কারণে ভর্তিও কম হয়। এখন বেইলী প্রিপারেটরি স্কুলটি ছুটির পর বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত তাদের ক্লাস হয়।

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক শম্পা রাণী পাল আশা প্রকাশ করে বলেন, নির্মাণকাজ শেষে এ বছরের মধ্যে নতুন ভবনে বিদ্যালয়টি স্থানান্তর করতে পারলে আগামী বছর থেকে শিক্ষার্থী ভর্তিও বাড়বে। তখন আশপাশের অসচ্ছল ও শ্রমজীবী মানুষের সন্তানদের পড়াশোনার সুযোগও বাড়বে।