আদালত ভবন থেকে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আসামিদের
আদালত ভবন থেকে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আসামিদের

হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরানো হলো মেনন–গাজীসহ চারজনকে, মশারি চাইলেন আতিকুল

কাঠগড়ায় সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। লোহার রেলিং ধরে চুপচাপ বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তাঁর বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ।

মেননের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক। তিনিও কাঠগড়ার লোহার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে। তাঁর বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম।

এ সময় বনানী থানার একটি হত্যা মামলায় মেনন, দস্তগীর, পলক ও আতিকুলকে গ্রেপ্তার দেখানোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে থাকেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটার শামসুদ্দোহা।

শামসুদ্দোহা বলেন, ‘মাননীয় আদালত, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো রাশেদ খান মেনন, আতিকুল ইসলাম, গোলাম দস্তগীর গাজী ও জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী। গত বছরের ১৯ জুলাই বনানীর মহাখালীর উড়ালসড়কের কাছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া শাহজাহানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই আসমিরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত। তাঁরা হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত।’

শামসুদ্দোহা বলেন, আন্দোলন চলাকালে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র–জনতাকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কেবল বনানী নয়, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরাসহ সারা দেশে দুই হাজারের বেশি ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন হাজার হাজার মানুষ।

আদালত ভবনে হাতকড়া, হেলমেট ও বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে আনা হয় গোলাম দস্তগীর গাজী, রাশেদ খান মেনন, জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক ও আতিকুল ইসলামকে

রাষ্ট্রপক্ষে পিপি শামসুদ্দোহা যখন এসব যুক্তি আদালতের কাছে তুলে ধরতে থাকেন, তখন কাঠগড়ায় দাঁড়ানো গোলাম দস্তগীর গাজী মাথা নিচু করে এসব বক্তব্য শুনতে থাকেন। মেনন, পলক ও আতিকুল বিচারকের দিকে চেয়ে থাকেন।

রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য শোনার পর ঢাকার সিএমএম আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট এই চারজনকে শাহজাহান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর অনুমতি দেন। পরে এজলাস ত্যাগ করেন বিচারক।

দুই হাত পেছনে নিয়ে তাঁদের হাতে হাতকড়া

হাস পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে এজলাস থেকে বের করা হয় আসামিদের

বেলা ১১টার পর এজলাস থেকে বিচারক চলে যান। তখন কাঠগড়ায় ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম তাঁর আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, ‘কারাগার কর্তৃপক্ষ মশারি অ্যালাউ (অনুমতি) করেছেন। আপনি ছয়টি মশারি কিনে কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।’

আতিকুল যখন তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে এ কথা বলছিলেন, তখন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা রাশেদ খান মেননের দিকে এগিয়ে আসেন একজন পুলিশ কনস্টেবল। মেননের মাথায় হেলমেট পরিয়ে দেন তিনি। এরপর মেনন তাঁর দুই হাত পিঠের দিকে নিলে পুলিশ কনস্টেবল হাতকড়া পরিয়ে দেন। মেননের পেছনে তখন দাঁড়িয়ে ছিলেন গোলাম দস্তগীর গাজী। তিনিও তাঁর দুই হাত পেছনের দিকে নিয়ে রাখেন। তখন আরেকজন পুলিশ কনস্টেবল তাঁর দুই হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দেন। একইভাবে আতিকুল ও পলকের দুই হাতেও হাতকড়া পরিয়ে দেয় পুলিশ। এরপর তাঁদের ছয়তলার আদালতকক্ষ থেকে বের করে সিঁড়ির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় অন্তত ২০ জন পুলিশ সদস্য তাঁদের ঘিরে রাখেন। সেখান থেকে তাঁদের পাঁচতলায় নামিয়ে লিফটে করে নিচে নিয়ে আসা হয়। তখন গোলাম দস্তগীর গাজী মাথা নিচু করে ছিলেন। জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক সাংবাদিকদের উদ্দেশে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তখন একজন পুলিশ কনস্টেবল পলকের মাথায় থাকা হেলমেটের গ্লাসটি চেপে ধরেন। তাই তিনি আর কোনো কথা বলেননি তখন। পরে তাঁদের দ্রুত হাঁটিয়ে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

হাতকড়া পরানোর বিষয়ে পুলিশ প্রবিধানের ৩৩০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বা তদন্তস্থলে পাঠানোর জন্য পুলিশ বন্দীর পালানো রোধে যা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি কড়াকড়ি উচিত নয়। হাতকড়া বা দড়ির ব্যবহার প্রায় ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ও অমর্যাদাকর। এতে আরও বলা হয়েছে, বয়স বা দুর্বলতার কারণে যাঁদের নিরাপত্তা রক্ষা করা সহজ ও নিরাপদ, তাঁদের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করা উচিত হবে না।

প্রিজন ভ্যানে বাঁয়ে গোলাম দস্তগীর গাজী ও রাশেদ খান মেনন। ৮ অক্টোবর

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে একটি নীল রঙের প্রিজন ভ্যান আদালতের হাজতখানা থেকে বের হয়ে আসে। ভ্যানের এক কোনায় বসে ছিলেন পলক। তাঁর বিপরীত পাশে লোহার বেঞ্চে চুপচাপ বসে ছিলেন গোলাম দস্তগীর গাজী, রাশেদ খান মেনন ও আতিকুল ইসলাম। তাঁদের মধ্যে গোলাম দস্তগীর গাজীকে বিমর্ষ দেখা যায়। এরপর পলক বসা থেকে উঠে তাঁর দুই হাত উঁচু করে প্রিজন ভ্যানের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকেন।

আসামিপক্ষের আইনজীবী তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থান করা সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের ঢাকা মেডিকেলে মৃত্যুর ঘটনায় জুনাইদ আহ্‌মেদ পলকসহ অন্যরা চিন্তিত ও আতঙ্কিত। কারাগারে থাকার সময় ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হন নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। আমির হোসেন আমু, কামাল আহমেদ মজুমদার ও গোলাম দস্তগীর গাজী বয়সজনিত সমস্যায় নানাবিধ শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তাঁরাও কারাগারে সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী তরিকুল ইসলাম।

গত সোমবার ঢাকার সিএমএম আদালতের কাছে সুচিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ করেন কাশিমপুর মহিলা কারাগারে থাকা সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি। সেদিন তিনি আদালতকে বলেছিলেন, ‘আমাদের কি মরিয়া প্রমাণ করিতে হবে, আমরা অসুস্থ।’

তবে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগী সাবেক যেসব মন্ত্রী ও এমপি আছেন, তাঁদের প্রত্যেকে সুচিকিৎসা পাচ্ছেন। আদালত এসব আসামিকে কারাবিধি অনুযায়ী চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন।’

হাতকড়া, হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরানোর বিষয়ে সম্প্রতি ওমর ফারুক ফারুকী প্রথম আলোকে বলেছিলেন, নিরাপত্তার স্বার্থেই আসামিদের এসব পরানো হয়।