ভৌগোলিক কারণে আগে–পরে পাকে আম
আমের ভালো দাম নিশ্চিত করতে হলে অঞ্চল–৪ এলাকায় (নওগাঁ, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়) চাষ বাড়াতে হবে।
কক্সবাজারের টেকনাফ অঞ্চলের গুটি আম ইতিমধ্যে পাকতে শুরু করেছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে তা বাজারে আসা শুরু হবে। মে মাসের মাঝামাঝি কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার আমও পাকতে শুরু করবে। কাছাকাছি সময়ে পাকবে সাতক্ষীরার গোবিন্দভোগ আমও।
দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল আম। সারা দেশেই উৎপাদন বাড়ছে ফলটির। গুরুত্বের কারণে আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ বলে সরকার ঘোষণা করেছে।
বিজ্ঞানীরা কোন আম কোন সময়ে কেন পাকে, তার একটি বিজ্ঞানসম্মত সময়কাল বের করেছেন। ওই সময় ধরে আম পাড়া হলে এবং বাজারে তুললে তাতে সুমিষ্ট ফলটির পুষ্টিগুণ ঠিক থাকবে। দামও ভালো পাওয়া যাবে। তাঁরা মনে করছেন, এতে ফল নষ্ট কম হবে।
‘কোন এলাকার আম কখন এবং কেন পাকে, তা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা আগে হয়েছে বলে শুনিনি। সাধারণত বেশি মুনাফার আশায় কৃষকেরা আগেই পেড়ে নিয়ে আম রাসায়নিক দিয়ে পাকান। এতে আমের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়। এ ছাড়া আধা পাকা অবস্থায় পাকানোর কারণেও নষ্ট হয়। এমন অবস্থায় আমাদের গবেষণার সুপারিশের ভিত্তিতে আম সংগ্রহ করা যেতে পারে।’মো. শরফ উদ্দিন, বারির গবেষক
এ গবেষণা প্রবন্ধ অতি সম্প্রতি মর্যাদাপূর্ণ বিজ্ঞান সাময়িকী সাসটেইনিবিলিটিতে প্রকাশিত হয়েছে। কানাডার সেইন্ট মেরি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ও ভারতের প্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইআইটি যৌথভাবে গবেষণাটি করেছে। এতে বাংলাদেশে আম যথাসময়ে ও যথাস্থান থেকে পাড়তে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সাধারণভাবে ধারণা আছে, জাতের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একেক আম একেক সময়ে পাকে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, আম কেবল জাতগত বৈশিষ্ট্যের কারণে পাকে না। পাকে ভৌগোলিক অবস্থান ও আবহাওয়াগত কারণেও। যেমন একই আম্রপালি সাতক্ষীরায় এক সময়, চট্টগ্রামে আরেক সময়ে এবং সবার শেষে উত্তরাঞ্চলে পাকে। একই জাতের আম পাকার ক্ষেত্রে এলাকাভেদে দুই মাস পর্যন্ত ব্যবধান হতে পারে।
গবেষণা দলের অন্যতম প্রধান বারির গবেষক মো. শরফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোন এলাকার আম কখন এবং কেন পাকে, তা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা আগে হয়েছে বলে শুনিনি। সাধারণত বেশি মুনাফার আশায় কৃষকেরা আগেই পেড়ে নিয়ে আম রাসায়নিক দিয়ে পাকান। এতে আমের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়। এ ছাড়া আধা পাকা অবস্থায় পাকানোর কারণেও নষ্ট হয়। এমন অবস্থায় আমাদের গবেষণার সুপারিশের ভিত্তিতে আম সংগ্রহ করা যেতে পারে।’
‘দেশে ফলের মধ্যে আমের উৎপাদন সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে। এর পুষ্টিগুণও অন্য ফলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তাই কোন সময়ে কোন এলাকার আম পাকে, তা বিজ্ঞানসম্মতভাবে জানার ফলে আমাদের জন্য এখন সিদ্ধান্ত নিতে এবং বাস্তবায়ন করতে সুবিধা হবে। প্রয়োজনে অসময়ের আম কোনগুলো, তা চিহ্নিত করতে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারব। তবে সবার আগে কৃষকদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।’মেহেদি মাসুদ, পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক
কোন এলাকার আম কখন, কেন পাকে
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাটির গুণাগুণ ও আবহাওয়াগত কারণেই মূলত একেক জেলার আম একেক সময়ে পাকে। এ ক্ষেত্রে আমের জাত কোনো বড় বিষয় নয়। ফলে জাতের চেয়ে প্রতিবেশ ও আবহাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে দেশের প্রধান আম উৎপাদনকারী এলাকাগুলোকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে এ গবেষণা সম্পন্ন করা হয়েছে। যেমন অঞ্চল-১: চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি; অঞ্চল-২: যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা; অঞ্চল-৩: নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং অঞ্চল-৪: নওগাঁ, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়।
এসব অঞ্চলে আম উৎপাদন ও সংগ্রহের ওপর প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্ত (মাটির আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, সমুদ্র সমতল থেকে উচ্চতা, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ ও ভূ–উপগ্রহের তথ্য) সংগ্রহ করা হয়েছে। সব তথ্য-উপাত্ত যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায়, অঞ্চল-১–এ সবচেয়ে আগে আম পাকে। আর সবশেষে আম পাকে অঞ্চল-৪ এলাকায়।
গবেষণায় ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মৌসুমে কোন আম কখন পাকে এবং ওই সময়ের আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। একই সঙ্গে আম উৎপাদনের ওই চার অঞ্চলের ভৌগোলিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। তাতে দেখা যায়, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাটি ভৌগোলিকভাবে বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী হওয়ায় এবং সেখানকার মাটির ধরনের কারণে গ্রীষ্ম মৌসুমে তাপমাত্রা বেশি থাকে। এ ছাড়া গ্রীষ্মকালেও যে সামান্য বৃষ্টিপাত হয়, তা ওই এলাকায় বেশি হয়। এই অনুকূল আবহাওয়ার কারণে সেখানকার আম দ্রুত পাকে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সেখানকার আম পাকতে দেখা গেছে।
কাছাকাছি সময়ে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত সাতক্ষীরা, খুলনাসহ অঞ্চল–২–এর অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোর আম পাকতে শুরু করে। ওই এলাকার ভূমির সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা, পানি ও মাটির ধরন এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। মের শুরুতে ওই এলাকায় বৃষ্টিপাত বেড়ে যায়। এ ধরনের আবহাওয়া আম পাকার পক্ষে অনুকূল। ফলে ওই এলাকায় যে জাতের আমের চারা রোপণ করা হোক না কেন, সেখানকার আম মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মধ্য জুনের মধ্যে পেকে যায়।
উত্তরাঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সবচেয়ে উঁচু বা পেছনে। সেখানকার মাটি মূলত লাল ও মিশ্র ধরনের। আর সেখানে বৃষ্টি শুরু হয় জুন থেকে। চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ফলে অঞ্চল–৩ ও অঞ্চল–৪–এর অন্তর্ভুক্ত উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে আম সবার শেষে পাকে।
তবে বেশ কয়েকটি জাতের আম কাছাকাছি সময়ে পাকে। যেমন ফজলি, বারি-৪। সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের বেশির ভাগ এলাকায় ওই আমের জাতগুলো পেকে যায়। অন্যদিকে ল্যাংড়া, বারি-২ ও হাঁড়িভাঙ্গা একই সময়ে পাকে। এই জাতগুলো দুই থেকে ছয় দিনের ব্যবধানে পাকতে শুরু করে।
এবার কী পরিমাণ আম হবে
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছর দেশে ১ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে ২৩ লাখ টন আম উৎপাদন হয়েছিল। এবার তা বেড়ে ২ লাখ হেক্টর জমিতে ২৫ লাখ টন আম হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আম হতে পারে নওগাঁ জেলায়। এরপরই রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। এ দুটি জেলায় রয়েছে নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ আম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাতক্ষীরার আম বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে।
প্রতি হেক্টরে আমের ফলনের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে নওগাঁ জেলা। এ জেলায় প্রতি হেক্টরে ১৫ থেকে ১৮ টন আম হয়। কিন্তু আমের জন্য বিখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতি হেক্টরে আম হয় ৮ থেকে ৯ টন।
দেশের অন্য জেলায় প্রতি হেক্টরে ৫ থেকে ১০ টন আম হয়ে থাকে। মূলত নওগাঁর চাষিরা সাত-আট বছর ধরে বেশি করে আমবাগান করছেন। তাঁরা উন্নত পদ্ধতি ও ফলন বেশি দেয়, এমন জাতের আম চাষের দিকে উৎসাহী হয়ে পড়েছেন। যে কারণে সেখানে দ্রুত আম চাষ বাড়ছে। উৎপাদনও ভালো হচ্ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, আম দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ফসল। পৃথিবীর মোট উৎপাদনের প্রায় ৮০ ভাগ আম এ অঞ্চলে হয়। সারা বিশ্বের মোট চাহিদার অধিকাংশ সরবরাহ হয় এশিয়া থেকে। বাংলাদেশও আম উৎপাদনে এগিয়ে আছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশি-বিদেশি চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতিবছরই বাংলাদেশে আম চাষাবাদের এলাকা ও উৎপাদন বাড়ছে। এ দেশের সুস্বাদু আম রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ২৩টি দেশে।
গবেষকেরা বলছেন, আমের ভালো দাম পেতে হলে অঞ্চল-৪ এলাকায় চাষ বাড়াতে হবে। কারণ, ওই এলাকায় আমের মৌসুমের শেষ সময়ে উন্নত মানের এবং বেশি পরিমাণে আম উৎপাদন হয়।
সঠিক সময়ে আম সংগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ
গবেষকেরা বলছেন, আমের ন্যায্যমূল্য পেতে হলে রপ্তানির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সঠিক সময়ে আম সংগ্রহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে আমের প্রাপ্তিকাল কম হওয়ার কারণে রপ্তানির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হয় না।
গবেষকেরা বলছেন, যে আম যে সময়ে পাকবে, সেই আম সেই সময়ে রপ্তানির পরিকল্পনা করতে হবে। আম পাকার সময়কে মাথায় রেখে রপ্তানির পরিকল্পনা করতে হবে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্বের প্রধান আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনামের আম মার্চ মাসে পাকে। থাইল্যান্ডের আম এপ্রিলের শুরুতে, ভারত ও বাংলাদেশের আম এপ্রিলের শেষের দিকে পাকা শুরু করে। মিসরের আম পাকা শুরু করে জুন থেকে।
গবেষক দলটি বলছে, গত এক যুগে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরিপক্ব আম রাসায়নিক দিয়ে পাকানোর ঘটনা উদ্ঘাটন করেছে। প্রতি মৌসুমেই বিপুল পরিমাণ অপরিপক্ব আম জব্দ ও নষ্ট করা হয়। জরিমানার শিকার হন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
এই গবেষণা সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মেহেদি মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে ফলের মধ্যে আমের উৎপাদন সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে। এর পুষ্টিগুণও অন্য ফলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তাই কোন সময়ে কোন এলাকার আম পাকে, তা বিজ্ঞানসম্মতভাবে জানার ফলে আমাদের জন্য এখন সিদ্ধান্ত নিতে এবং বাস্তবায়ন করতে সুবিধা হবে। প্রয়োজনে অসময়ের আম কোনগুলো, তা চিহ্নিত করতে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারব। তবে সবার আগে কৃষকদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।’
আরও পড়ুন
-
পৃথিবীর কোন দেশে সেন্ট্রাল ব্যাংকে ঢুকতে পারছে অবাধে: ওবায়দুল কাদের
-
পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীশাসনে হাজার কোটি টাকা বাড়তি চায় চীনা ঠিকাদার
-
রাঙামাটিতে এলোপাতাড়ি গুলিতে ইউপিডিএফের কর্মীসহ দুজন নিহত
-
বিশ্বের সেরা এয়ারলাইনস আট মাসের বেতনের সমান বোনাস দিচ্ছে
-
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সিরিজের ভেন্যুতে ঝড় বয়ে গেছে