জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

দেশে মানবাধিকার কমিশন এখনো অকার্যকর

মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ জারি হয়েছে। নতুন আইনের অনেক বিষয় ইতিবাচক হলেও কিছু প্রশ্নও তৈরি হয়েছে।

বিশ্ব মানবাধিকার দিবস আজ বুধবার। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মানবাধিকার আমাদের প্রতিদিনের অপরিহার্য বিষয়’। অথচ বাংলাদেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এক বছরের বেশি সময় ধরে অকার্যকর।

আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম সব ঘটনার পর জুলাই অভ্যুত্থান মানুষকে করে তুলেছিল আশাবাদী। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত বছরের নভেম্বরে মানবাধিকার কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদসহ সব সদস্যকে পদত্যাগ করতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। আওয়ামী লীগ আমলে এই মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকাও অবশ্য ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

এরপর গত মার্চে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল মানবাধিকার কমিশন আইন সংস্কার করে মাসখানেকের মধ্যে নতুন কমিশন গঠনের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর আট মাস গড়িয়ে গেলেও মানবাধিকার কমিশন এখনো গঠিত হয়নি। এর মধ্যে এক মাসের বেশি সময় আগে মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ জারি হয়। নতুন আইনের অনেক বিষয় মানবাধিকারকর্মীরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলেও কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্নও তৈরি হয়েছে।

সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুলাই চেতনার মূল বিষয় ছিল রাষ্ট্রের পীড়নের হাত থেকে যথাসম্ভব সুরক্ষা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি।’

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস—এই ১০ মাসে যতজন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন, গত পাঁচ বছরের কোনো বছরে তা ঘটেনি।

মানবাধিকার পরিস্থিতি

অন্তর্বর্তী সরকার গুমসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিচারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলেও মব আক্রমণ, পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস—এই ১০ মাসে যতজন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন, গত পাঁচ বছরের কোনো বছরে তা ঘটেনি।

আসকের হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গণপিটুনিতে নিহত হন ১৬৫ জন। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৮ জন, ২০২২ সালে ৩৬ জন, ২০২৩ সালে ৫১ জন, ২০২৪ সালে ১২৮ জন। ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার আসে। এ সরকারের আমলে অর্থাৎ ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে শুরু করে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ২৬১ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন।

‘মব’ সৃষ্টি করে চাঁদাবাজি, আক্রমণ, ঘেরাও, নারীদের হেনস্তা করার নানা অভিযোগ এই সময়ে ছিল আলোচিত। এসব ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের নির্লিপ্ততার অভিযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি দায়িত্বশীল কারও কারও বক্তব্য এর প্রতি সমর্থনসূচক বলে সমালোচনাও ওঠে।

জুলাই চেতনার মূল বিষয় ছিল রাষ্ট্রের পীড়নের হাত থেকে যথাসম্ভব সুরক্ষা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি।
শাহদীন মালিক, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

আসকের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, কোথাও মব তৈরি করে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে, আবার কোথাও মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তা করা হচ্ছে, কোথাও নারীর পোশাকের স্বাধীনতা ও খেলাধুলার অধিকার হরণ করার চেষ্টা হচ্ছে, কোথাও শিল্প-সংস্কৃতির অধিকার রোধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার ওপর সরাসরি আঘাত।

অন্তর্বর্তী সরকারের সময় গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা (১৪ মাসে ৪০ জন) কমে এলেও অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বেড়েছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশের অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের সংখ্যা ছিল ৩৫২। ২০২৪ সালে ছিল ৫০৪ জন। আর চলতি বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৫৮৬।

এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে এসব লাশের পরিচয় মিলত। কিন্তু এখন পুলিশ বা কেউ তা নিয়ে কিছু বলে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাউকেও কিছু বলতে শুনিনি।’

সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপপ্রয়োগের অভিযোগ অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধেও উঠেছে।

কারা হেফাজতে মৃত্যুও বাড়ছে দেশে। আসকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৮৩ জন কারা হেফাজতে মারা গেছেন। গত বছর ছিল ৬৫ জন, ২০২৩ সালে ১০৬ জন এবং ২০২২ সালে ৬৫ জন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মোট মারা গেছেন ১১২ জন।

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নও অব্যাহত রয়েছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ২ হাজার ৬৭৩টি সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৮২ হত্যা, ৪৪টি ধর্ষণের ঘটনা।

ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ প্রথম আলোকে বলেন, সংখ্যালঘুদের হামলা কখনোই থামেনি। তবে বর্তমান সরকার ধর্মীয় উগ্রবাদকে আশকারা দিয়ে পরিস্থিতি ভয়ানক করে তুলেছে। বাংলাদেশের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের আর্চবিশপ বিজয় ডি ক্রুজ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায় এখন সত্যিই অনিরাপদ বোধ করছে।

সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপপ্রয়োগের অভিযোগ অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধেও উঠেছে।

ক্ষমতার বেশির ভাগ সময় এই সরকার মানবাধিকার কমিশনকে অকার্যকর রেখেছে। এখন একটি আইন সংশোধন করে আর বিস্তর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নির্লিপ্তভাবে দেখে সময় পার করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সাঈদ আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যুরোপ্রধান, এসএএফএইচআর

নতুন অধ্যাদেশ

মানবাধিকার সুরক্ষার লক্ষ্য নিয়ে জারি হয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫। গত ৩০ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের পর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছিলেন, আগে মানবাধিকার কমিশন দুর্বল ছিল; নিয়োগ পদ্ধতিতে ত্রুটি এবং এখতিয়ারে মারাত্মক ঘাটতি ছিল। নতুন অধ্যাদেশের লক্ষ্য হলো কমিশনকে সত্যিকারের ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, যাতে এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

কমিশন আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধ নিয়ে কোনো তদন্ত করতে পারত না। সরকারের কোনো দপ্তরের কাছে কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যা বা প্রতিবেদন চাইলে তা পাওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। নতুন অধ্যাদেশে সেই ক্ষমতা পেয়েছে কমিশন।

এসব ভালো কিছু বিষয় অধ্যাদেশে থাকলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমত, পরবর্তী সরকার এই অধ্যাদেশ পাস না করলে কী হবে? দ্বিতীয়ত, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হওয়ার কথা থাকায় তার আগে হয়তো নতুন কমিশন হবে না।

কলম্বোভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়ার মানবাধিকারকর্মীদের নেটওয়ার্কের (এসএএফএইচআর) বাংলাদেশ ব্যুরোপ্রধান সাঈদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতার বেশির ভাগ সময় এই সরকার মানবাধিকার কমিশনকে অকার্যকর রেখেছে। এখন একটি আইন সংশোধন করে আর বিস্তর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নির্লিপ্তভাবে দেখে সময় পার করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এটা একধরনের দায় মোচন।