পাঠকের লেখা–৭০

বৃষ্টির দিন ও এক অচেনা দম্পতি

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: readers@prothomalo.com

বছর দুই আগের কথা। বাংলা ১৪৩০ সনের ২০ আষাঢ়।

বৃষ্টিস্নাত ওই দিনে মেয়েকে স্কুলে নেওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার। মেয়ে পড়ে মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়ে, পঞ্চম শ্রেণিতে। আর আমাদের বাসা মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়া। বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার।  

ভোর থেকে বজ্রবৃষ্টি হচ্ছিল। পৌনে পাঁচটার দিকে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ি। এরপর মেয়েকে ডেকে তুলি। মেয়েও নামাজ শেষে স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে।

সাতটায় ক্লাস শুরু হয়। আমাদের বাসা থেকে বের হতে হয় সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যে। বাসা থেকে বের হলাম স্কুলের উদ্দেশে। কিন্তু রাস্তায় যেতেই দেখি সুনসান নীরবতা। কোনো রিকশা না পেয়ে বাবা-মেয়ে হেঁটে চলছি স্কুলের পথে। খুঁজছি আমাদের বাহন রিকশা, যা ওই দিন ছিল রীতিমতো সোনার হরিণ। অবশেষে একটি পেয়েও যাই; কিন্তু সেটি আমাদের গন্তব্যে যেতে রাজি নয়। বাধ্য হয়ে আবারও আমাদের হন্যে হয়ে খুঁজতে হয় রিকশা।

বৃষ্টির মধ্যে এক ছাতার নিচে বাবা-মেয়ের চলতে কষ্ট হচ্ছিল। যে করেই হোক একটি রিকশার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি।

এমন সময় হঠাৎ একটি প্রাইভেট কার উচ্চ শব্দে হর্ন বাজিয়ে ঠিক আমাদের পেছনে এসে দাঁড়ায়। দরজা খুলে একটি মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে গাড়িতে থাকা ভদ্রমহিলা আমার মেয়েকে মা বলে সম্বোধন করলেন। আমাকেও সহৃদয়ে বললেন, ‘আপনার আপত্তি না থাকলে আপনার মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতে পারি। সঙ্গে আমার দুটো মেয়ে আছে, ওদের সঙ্গে যাবে।’

ইউনিফর্ম দেখে আশ্বস্ত হলাম। তারাও মনিপুর স্কুলে পড়ে। তারপরও ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু সময়ের জন্য আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। মেয়েকে গাড়িতে তুলে দেব, না রিকশার পেছনে ছুটব। ওদিকে হাতেও পর্যাপ্ত সময় নেই। অগত্যা ভদ্রমহিলার গাড়িতে তুলে দিলাম মেয়েকে। দেখে মনে হলো, গাড়ি চালাচ্ছেন ভদ্রমহিলার স্বামী।

এভাবে অচেনা লোকের গাড়িতে মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে কিছুতেই মনকে আশ্বস্ত করতে পারছিলাম না। বিষয়টা বাসায় গিয়ে স্ত্রীকে কীভাবে বলি, তা-ও ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই বাধ্য হয়ে রাস্তাতেই পায়চারি করতে থাকলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর দেখলাম নীল রঙের সেই গাড়ি ফিরছে। আমাকে দেখে তাঁরা গাড়ি থামিয়ে গ্লাস খুলে বললেন, ‘আপনার মেয়েকে স্কুলে রেখে এসেছি।’ শুনে মনে হলো, বুকের ভেতর এতক্ষণ যে পাথরটা ভর করে ছিল, তা সরে গেছে। কিন্তু তারপরও মন মানছিল না। একটা চাপা কষ্ট নিয়ে বাসায় ফিরলেও তা কারও সঙ্গে শেয়ার করলাম না।

স্কুল ছুটি হওয়ার বেশ কিছু সময় আগে গিয়ে হাজির হলাম। অবচেতন মনে বুকের ভেতরটা যেন কেমন করছে। ছুটির ঘণ্টা বাজার পর মেয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালে আবেগাপ্লুত হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। মেয়ে আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, ‘বাবা, জানো গাড়ির ওই আন্টিটা অনেক ভালো। গাড়ি থেকে নেমে তিনি ছাতা দিয়ে আমাকে তাঁর মেয়েদের মতো স্কুলে পৌঁছে দিয়েছেন। আমার বিস্তারিত জেনে প্রশংসাও করেছেন।’

এ তো গেল দুই বছর আগের কথা।

চলতি বছরের শ্রাবণের একটি বৃষ্টিস্নাত দিন। মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি। আমাদের দেখেই চিনে ফেললেন তাঁরা। ঠিক পেছনে এসে গাড়ির হর্ন বাজিয়ে আমাকে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘ভাইয়া, আপনার মেয়েকে আমাদের সঙ্গে দিয়ে দিন।’ 

মেয়ে এখন একটু বড় হয়েছে, ক্লাস সেভেনে পড়ে। তাই ওকে একা ছেড়ে দিতে মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু ভদ্রমহিলার পীড়াপীড়িতে রাজি হয়ে গেলাম।

এবারও বাসায় এসে বিষয়টি স্ত্রীর সঙ্গে শেয়ার করলাম না। শুধু নিজের মধ্যে কষ্টটা চেপে রাখলাম। মনে একটা অজানা ভয় নিয়ে মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গেলাম। ছুটি শেষে সে যখন আমার সামনে এল, আমার মনপ্রাণ প্রশান্তিতে ভরে গেল।

চারদিকে নানা অঘটনের মধ্যে নিজের জীবনে এমন সুখকর স্মৃতির মুখোমুখি হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করলাম। আর সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।

সময়ের সংক্ষিপ্ততায় ওই দম্পতির নাম-ঠিকানা আর জানা হয়নি। তাই তাঁদের ঋণও আর শোধ করতে পারিনি। তবে এখনো আমি নগরীর ব্যস্ততম সড়কে খুঁজে বেড়াই ওই দম্পতির নীল রঙের...নম্বরের গাড়িটি। জানি না কবে আসবে ঋণ পরিশোধের সেই ক্ষণ।

আজাদ বিশ্বাস, মধ্য পাইকপাড়া, মিরপুর, ঢাকা