
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই কিছু নাটকের অংশবিশেষ চোখে পড়ে, যেখানে বৃদ্ধ বাবা-মাকে উটকো উপদ্রব মনে করে সন্তান বা তার জীবনসঙ্গী; নানাভাবে তাদের নিগ্রহ করে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের শেষ পরিণতি হয় বৃদ্ধাশ্রম।
নাটকের দৃশ্য হলেও এগুলো সমাজেরই বাস্তব ছবি। আসলে একদিকে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, অন্যদিকে বন্ধ হয়ে গেছে বা কমে গেছে বয়স্কদের আয়। অথচ বেড়ে গেছে তাঁদের বিবিধ খরচ, বিশেষ করে চিকিৎসা ব্যয়। পাশাপাশি কমছে পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তা, দেখা দিয়েছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। সব মিলিয়ে নানা শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সময় পার করছেন প্রবীণেরা।
‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন পাবলিক হেলথ’-এর এক গবেষণা সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী জনসংখ্যা ২০১৫ সালে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। ১৯৯০ সালে আয়ু ৫৭ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ৭২ দশমিক ৩ হয়েছে। বয়সীদের আনুপাতিক হারও বাড়ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রতি ১০ জনের একজন হবেন প্রবীণ, ২০৫০ সালে এই সংখ্যা হবে ৫ জনে ১ জন। বয়স্ক জনসংখ্যার প্রভাব স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শ্রমবাজার, ভোগ, সঞ্চয়, বিনিয়োগ, অবসরভাতার ওপর পড়বে। প্রবীণেরা গড়ে দরিদ্রতমদের মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র। প্রবীণদের এই বর্ধিত সংখ্যার জন্য বাংলাদেশের আরও সহায়তার প্রয়োজন হবে।
প্রবীণদের একটা বড় সমস্যা হলো নিঃসঙ্গতা। তরুণ-তরুণীরা তাঁদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। এ ধরনের মিথস্ক্রিয়া প্রবীণদের গোধূলিবেলাকে করে তোলে রঙিন।
বেশির ভাগ বয়স্ক মানুষ গ্রামাঞ্চলে বাস করেন। সেখানে স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনৈতিক পরিষেবা এবং কাজের সুযোগ কম। ক্রমবর্ধমান বয়স্কদের জন্য পর্যাপ্ত যত্ন এবং সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশ একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদের হার নাটকীয়ভাবে বাড়ছে, এটি ‘একাকী’ প্রবীণ জনসংখ্যার বৃদ্ধি করবে। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৯৫ শতাংশ বয়স্ক ব্যক্তির বেশির ভাগই একাধিক স্বাস্থ্যজটিলতায় ভোগেন; যা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ।
আমার মধ্যচল্লিশে, ছেলে-মেয়ে যখন বাইরে পড়তে গেল, হঠাৎ মনে হলো, যদি কখনো ওরা ফিরে না আসে! এমন এক সামাজিক পরিমণ্ডলে আমি বড় হয়েছি, যেখানে ছেলেমেয়েরা বয়স্ক মা-বাবার সঙ্গে থাকে। কিন্তু বর্তমানে পারিবারিক ব্যবস্থা দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছে। জীবনমান উন্নয়নের জন্য শিক্ষা, কাজ ও বৈবাহিক কারণে অনেকে গ্রাম থেকে শহরে, দেশ থেকে দেশের বাইরে আবাস গড়ে তুলছে। এসব চিন্তা থেকেই মনে হলো আমার ছেলেমেয়েরাও সেখানে স্থায়ী হয়ে গেলে আমাদের ভবিষ্যৎটা কেমন হবে! উন্নত দেশে এ ধরনের লোক, বিশেষ করে গরিবদের জন্য অনেক কমিউনিটি রয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে তো তেমন কিছুই নেই।
তাই যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে একবার মেয়েকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দিয়ে বোস্টনের কাছে ব্রুকলিনের একটা ‘গডার্ড হোম’ (বয়স্কদের আবাস) দেখতে যাই। তাদের পরিচালনা পদ্ধতি ও অন্য কাগজপত্র নিয়ে পড়াশোনা করি। তখন থেকেই শুরু প্রবীণনিবাসের স্বপ্ন।
প্রথমে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্তদের কথা মাথায় রেখে বৃদ্ধাশ্রমের পরিকল্পনা করি। কিন্তু পরিকল্পনাটা খুবই ব্যয়বহুল মনে হলো। ঢাকার জমি আমাদের নাগালের বাইরে। আমার স্বামী ধামরাইয়ের বাড়িটি কাজে লাগানোর জন্য উৎসাহ দেন। গ্রামের বাড়ির স্বাদ নিতে একটু জমি কিনে ছোট বাড়িটা করেছিলাম।
শুভাকাঙ্ক্ষীদের উৎসাহ নিয়ে কাজ শুরু করি। তত দিনে শরীরে রোগব্যাধি ও দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। যাঁদের অবস্থা আমার চেয়েও নাজুক, মনে হলো তাঁদের জন্য দ্রুত কিছু করা জরুরি। তখনই দরিদ্রদের জন্য প্রবীণনিবাস গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিই, বিনা মূল্যে যেখানে তাঁদের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করাটা খুব সহজ ছিল না!
তহবিলের জন্য বিভিন্নভাবে কাছের বন্ধুদের সঙ্গে চিন্তা, চেষ্টা ও যোগাযোগ অব্যাহত রাখি। সৌভাগ্যই বলতে হবে, অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীকে পাশে পেয়েছি। খুব বড় কিছু দাতা আর হাজারো ছোট দাতা, সবার উৎসাহ ও সহযোগিতায় এগিয়ে চলে শৈলান প্রবীণনিবাস-এর কাজ।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অনুযায়ী উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের জীবনমানের ভিত্তিতে আলাদা মানের ব্যবস্থা রেখে বৃদ্ধাশ্রম করা যেতে পারে। প্রয়োজনের ভিত্তিতে প্রবীণদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়—শারীরিকভাবে চলাচলে সক্ষম ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থ বা চলাচলে অক্ষম। আমরা মূলত চলাচলে সক্ষম অসহায় ও দুস্থ প্রবীণদের চিন্তা মাথায় রেখে গড়ে তুলি আমাদের প্রবীণনিবাস।
স্থানীয়দের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুরু থেকেই এখানে স্থানীয় লোকদের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণও সর্বতোভাবে কাজ করেছে। দুজন স্থানীয় স্বনামধন্য ব্যক্তিও আমাদের ট্রাস্টি হিসেবে সব স্থাপনা তৈরির কাজ দেখভাল করেছেন। স্থানীয় নবীনেরাও রাখছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
বাসিন্দা পাওয়াও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পারিবারিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয়—বাধা হয়ে দাঁড়ায় নানা বিষয়। পাছে লোকে কিছু বলে, সমাজের লোকদের মধ্যে এ ধরনের চিন্তাভাবনা কাজ করে। আছে কিছু ধর্মীয় নীতি, বুড়ো মা-বাবার দেখভাল ছেলেদের দায়িত্ব। রাষ্ট্রীয় নিয়মে ছেলেমেয়েরা মা–বাবার দায়িত্ব না নিলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব কারণে প্রবীণ পেতে আমাদের সমস্যা হচ্ছিল। আমরা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকি। আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবও কাজ করতে থাকে। অবশেষে ২০২২ সালের ২৬ মার্চ ২ জন প্রবীণকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে শৈলান প্রবীণনিবাস।
নিবাস চালু করার পর ঠিকঠাক চালিয়ে নেওয়াটাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে আমাদের ট্রাস্টিদের সবাই প্রায় বয়োবৃদ্ধ। তাই নতুনদের এগিয়ে আসতে হবে, যারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে প্রবীণদের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করতে আগ্রহী।
এখন এখানে ৫০ জনের বেশি প্রবীণ রয়েছেন। প্রত্যেকের জীবনেই গল্প রয়েছে, কিছু কিছু খুবই হৃদয়বিদারক। এখানে ছদ্মনাম ব্যবহার করে দুজনের কথা বলতে চাই।
চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর সালমাকে শারীরিক-মানসিকভাবে অত্যাচার করত ছেলে ও বউ। প্রায় তিন বছর আগে বাড়িওয়ালা তাঁকে এখানে রেখে যান। আজও কেউ তাঁর খোঁজ নিতে আসেনি। তাই মনের দুঃখে দরখাস্ত জমা দিয়ে রেখেছেন, মৃত্যুর পর কাউকে না জানিয়েই আমরা তাঁর কবরের ব্যবস্থা করতে পারব। ভাবুন, কতটা কষ্ট পেলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত দিতে পারে মানুষ।
আমাদের আরেক বাসিন্দা আলম ছিলেন ঠিকাদার। দুই ছেলেকেই প্রকৌশলী বানিয়েছেন। বয়স্ক বাবার চলাফেরা-খবরদারিও হয়তো সহ্য করতে না পেরে কথায়, আচরণে অপমান করত ছেলেরা। শিক্ষিত বাবা জানতেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও মা-বাবার দেখভাল না করলে সন্তানদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। প্রবীণনিবাসে আসার আগেই তাই নিকটবর্তী থানায় গিয়ে ছেলেদের নামে না-দাবি কাগজে স্বাক্ষর করে এসেছেন, ছেলেরা ভবিষ্যতে যাতে কোনো আইনি জটিলতায় না পড়ে। বাবা মৃত্যুশয্যায় জানানোর পরও আলম সাহেবকে দেখতে আসেনি ছেলেরা। আমাদের এখান থেকে আইনের কথা মনে করিয়ে চিঠি গেলে এসে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় খুবই কান্নাকাটি করে। কিন্তু আড়াই বছরে একবারও আসেনি।
আমাদের নিবাসে বিভিন্ন সময় এক মাস থেকে দুই বছর অবস্থানের পর পরিবার ফেরত নিয়ে গেছে, এমন কেস ১০০-এর মতো। এটাকে আমরা ইতিবাচক অর্জন বলে মনে করি। কারণ, পরিবারই বয়স্কদের জন্য আদর্শ স্থান।
ঘরে ঘরে অবহেলিত প্রবীণ রয়েছেন। সামাজিক দিক বিবেচনা করে উন্নত দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
মূলত গরিব, অসহায় কিন্তু চলাফেরায় সক্ষম প্রবীণদের আমরা নিয়ে থাকি। সবার সঙ্গে সময় কাটিয়ে বুঝতে পারি অসচ্ছলতা বা আর্থিক সমস্যা একমাত্র কারণ নয়। ছেলে, মেয়ে, বউরা নিগ্রহ করে। অনেক ক্ষেত্রে প্রবীণদেরও কিছু ভুলত্রুটি থাকে। পুরুষাধিপত্যও কখনো কখনো অশান্তির কারণ হয়। কারণগুলো বের করে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা সমাধানের চেষ্টা আমাদের করতে হবে। ধৈর্য, সহনশীলতা, মানিয়ে চলা, ত্যাগ করার মানসিকতার মাধ্যমে কিছুটা হলেও পারিবারিক মূল্যবোধ হয়তো ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আজকের ছেলেমেয়েদের কাছে মুরব্বিদের অবদানের কথা ধরতে হবে। প্রচারণার মাধ্যমে পারিবারিক মূল্যবোধ ও বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে।
সচ্ছলদের জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রবীণনিবাস করা যায়, সেবাগ্রহীতা যেখানে পূর্ণ ব্যয় বহন করবে। ব্যাংক বা বিমাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে লগ্নি করতে পারে। উৎসাহ প্রদানের জন্য এ ধরনের লগ্নি থেকে আয়কে কর রেয়াত দিতে পারে সরকার।
অসচ্ছলদের জন্য স্বল্প বা বিনা মূল্যে প্রবীণনিবাস, যার আংশিক বা সম্পূর্ণ দায়ভার বহন করবেন দানশীল ব্যক্তিরা। সরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা পরিচালিত হতে পারে।
যত প্রবীণনিবাস এ পর্যন্ত হয়েছে, সব কটির নিবন্ধন দিয়ে সরকার যদি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে, প্রবীণেরা আশ্বস্ত হতে পারবেন।
প্রবীণেরা শুধু পরিবারেরই না, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সেই চিন্তা থেকেই সরকার প্রবীণদের জন্য প্রবীণ ভাতা চালু করেছে। তাঁদের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহে যা একেবারেই অপ্রতুল। এর পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে।
আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তরুণদের স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করা। নবীনদের বোঝাতে হবে তাদের নিজেদেরও একদিন এই পর্যায়ে যেতে হবে।
বাসস্থান, খাদ্য, পোশাক, চিকিৎসা ছাড়াও প্রবীণদের একটা বড় সমস্যা হলো নিঃসঙ্গতা। স্কুল-কলেজের তরুণ-তরুণীরা স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দুস্থ প্রবীণদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। আমরা দেখেছি এ ধরনের মিথস্ক্রিয়া প্রবীণদের উৎফুল্ল করে, তাদের গোধূলিবেলাকে করে তোলে রঙিন।
প্রবীণনিবাস সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দূর করতে হবে। না হলে অসংখ্য প্রবীণ ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকবেন।
দিলরুবা কবির: প্রতিষ্ঠাতা, শৈলান প্রবীণনিবাস