
নির্জন কবরস্থানের এক কোণে ছোট্ট একটি কবর। মাটি এখনো নরম, ভেজা। কবরে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে কালো ফিতা দিয়ে আটকানো সাদা কাগজে লেখা—‘বেবী অফ আঁখিমনি-রন্টি (কন্যাসন্তান)’। দাফনের তারিখ ১২ নভেম্বর।
নারায়ণগঞ্জে ভুঁইগড়ের মামুদপুর কবরস্থানে নামহীন শিশুর এই কবরের পাশে দাঁড়ালে বোঝার উপায় নেই যে মৃত্যুর আগে বা পরে এই কন্যাসন্তান তার মা–বাবা বা কোনো স্বজনকেই কাছে পায়নি। তার চিকিৎসা ও দাফনের ব্যবস্থা করেছে ডা. মুজিব নিউবর্ন ফাউন্ডেশন।
নারায়ণগঞ্জে ভুঁইগড়ের মামুদপুর কবরস্থানে নামহীন শিশুর এই কবরের পাশে দাঁড়ালে বোঝার উপায় নেই যে মৃত্যুর আগে বা পরে এই কন্যাসন্তান তার মা, বাবা বা কোনো স্বজনকেই কাছে পায়নি।
৫ নভেম্বর রাত ৩টার দিকে কে বা কারা নবজাতকটিকে শ্বাসকষ্টসহ শারীরিক সমস্যা নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড মোড়ের বাংলাদেশ নবজাতক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করেন। এ সময় শিশুটির ওজন ছিল এক কেজির মতো। ভর্তির কাগজে মায়ের নাম লেখা ছিল—আঁখিমনি-রন্টি। ভর্তির পর থেকেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে আর খুঁজে পায়নি। যোগাযোগের যে নম্বর দেওয়া ছিল, সেই নম্বরে কেউ ফোন ধরেননি।
মুজিব নিউবর্ন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চিকিৎসক অধ্যাপক মজিবুর রহমান। তিনি মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক, পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত বাংলাদেশ নবজাতক হাসপাতালে চিফ কনসালট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ভবিষ্যতে আইনি ঝামেলা এড়াতে নবজাতক উদ্ধার এবং মারা গেলে থানা ও প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। সকালে এই নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুমতি নিতে নিতে লাশ দাফন করতে বিকেল হয়ে গেছে। জন্ম, মৃত্যু—সব জায়গাতেই ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে নবজাতকটিকে।মজিবুর রহমান, মুজিব নিউবর্ন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চিকিৎসক
মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কন্যাসন্তানটিকে ভর্তির সময় মায়ের নাম আঁখিমনি-রন্টি বলে উল্লেখ করা ছিল। তাই তার কবরের ওপরে—বেবী অফ আঁখিমনি-রন্টি (কন্যা সন্তান) লিখে রাখা হয়েছে।
মজিবুর রহমান আরও বলেন, রাজধানীর বাইরে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে না। তাই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ভবিষ্যতে আইনি ঝামেলা এড়াতে নবজাতক উদ্ধার এবং মারা গেলে থানা ও প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। সকালে এই নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে অনুমতি নিতে নিতে লাশ দাফন করতে বিকেল হয়ে গেছে। জন্ম, মৃত্যু—সব জায়গাতেই ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে নবজাতকটিকে।
এই নবজাতকের মৃত্যুর কয়েক দিন পর ১৪ নভেম্বর রাজধানীর মেরুল বাড্ডার রাশমনা আপনঘর বৃদ্ধাশ্রমে থাকা ৯৫ বছর বয়সী মো. আবদুল আজিজ চৌধুরী মারা যান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) তাঁর মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর আগে তিনি বারবার স্বজনদের মুখ দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেউ আসেননি। এমনকি মৃত্যুর পর খবর দেওয়ার পরও তাঁর লাশ নিতে আসেননি কেউ। বৃদ্ধাশ্রমের প্রশাসন আইনি ঝামেলা সামলে আজিমপুর কবরস্থানে তাঁর দাফনের ব্যবস্থা করেছে।
রাশমনা আপনঘর বৃদ্ধাশ্রম ও ডা. মুজিব নিউবর্ন ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন জন্ম ও মৃত্যু যেন কারও না হয়।
বেসরকারি উদ্যোগ ‘ভালো কাজের হোটেল’-এর পাশাপাশি রাশমনা আপনঘর বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা মো. আরিফুর রহমান ১৪ নভেম্বর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, গত মাসের ৮ তারিখ থেকে আবদুল আজিজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তখন থেকেই তাঁর পরিবারের সদস্যদের বেশ কয়েকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তাঁরা কেউ দেখতে আসেননি। এমনকি মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরও লাশ নেওয়া তো দূরের কথা তাঁর পরিবারের কেউ দেখতে আসেননি।
আরিফুর রহমান বলেন, ‘নিজের পরিবার অস্বীকার করলেও রাশমনা আপনঘরের পরিবার তাঁকে অস্বীকার করেনি। আমরা তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানের দাফন করেছি।’
তিন বছর ধরে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা আবদুল আজিজের পরিচয় ছিল ‘কবি কাকা’। বৃদ্ধাশ্রমের সবাই তাঁকে এই সম্বোধনেই ডাকতেন। তিনি কবিতা লিখতেন। আচরণ ও কথাবার্তায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষের ছাপ স্পষ্ট থাকলেও নিজের পরিচয় জানাতে চাইতেন না।
আরিফুর রহমান বলেন, তিন বছর ধরে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা আবদুল আজিজের পরিচয় ছিল ‘কবি কাকা’। বৃদ্ধাশ্রমের সবাই তাঁকে এই সম্বোধনেই ডাকতেন। তিনি কবিতা লিখতেন। আচরণ ও কথাবার্তায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষের ছাপ স্পষ্ট থাকলেও নিজের পরিচয় জানাতে চাইতেন না।
আবদুল আজিজের এক ভাই, এক বোন আর এক ভাগনের মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করেছিল বৃদ্ধাশ্রম কর্মৃপক্ষ। এবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ার কথা বলেছিলেন। সে সময় এবং মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের যে সদস্যদের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফোন কেটে দেন তাঁরা। আবদুল আজিজের ভাগনে ‘রং নম্বর’ জানিয়ে ফোন কেটে দেন জানিয়েছেন আপনঘর বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা।
নিজের পরিবার অস্বীকার করলেও, রাশমনা আপনঘরের পরিবার তাঁকে (আবদুল আজিজ) অস্বীকার করেনি। আমরা তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানের দাফন করেছি।আরিফুর রহমান, আপনঘর বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দেওয়া মৃত্যুসনদে আবদুল আজিজের বয়স লেখা ৯৫ বছর। তবে বৃদ্ধাশ্রমে কর্মরতারা বলছেন, বয়স এর চেয়ে কম হবে। চিকিৎসা-সংক্রান্ত কাগজপত্র, মৃত্যুসনদ ও আজিমপুর কবরস্থানের দাফন-সংক্রান্ত নথিতে রাশমনা আপনঘর বৃদ্ধাশ্রমের নাম লেখা হয়েছে।
বৃদ্ধাশ্রমে ভর্তির সময় দেওয়া তথ্যে লেখা ছিল—আবদুল আজিজের স্থায়ী ঠিকানা দিনাজপুর। অস্থায়ী ঠিকানা রংপুরের বদরগঞ্জ। বাবার নাম আমিনুল হক চৌধুরী ও মায়ের নাম ফরিদা আমিন চৌধুরী।
বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আবদুল আজিজের পরিবারের সদস্যদের মুঠোফোন নম্বর নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কথা বলা হয়। ভাই পরিচয় স্বীকার করলেও ওই ব্যক্তি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ফোন কেটে দেন।
আর নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোন পরিচয় দেওয়া একজন নারী বলেন, তাঁরা সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। নিজের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় ভাইয়ের দায়িত্ব নেওয়া বা ভাইয়ের লাশ আনা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁদের মা-বাবাও মারা গেছেন।
এই নারী আরও বলেন, তাঁর ভাই আবদুল আজিজ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। লেখালেখি করতেন। পৈতৃক ভিটা সম্পত্তি ভাগ–বাঁটোয়ারা হয়নি। তবে ধানি জমি ভাগের টাকা তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন।
বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আবদুল আজিজ খুব সম্ভবত সিনেমাও বানিয়েছিলেন। বৃদ্ধাশ্রমে আসা অধিকাংশ মানুষের মনে চাপা কষ্ট থাকে। অভিমান বা যেকোনো কারণে তাঁরা নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চান না।
আবদুল আজিজের শারীরিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পচন ধরেছিল। দুটি হাসপাতালে টানাটানি করতে হয়েছে। মারা যাওয়ার পরও তাঁর লাশটা পরিবারের কেউ নিতে আসেননি। এমন মৃত্যু কোনোভাবেই কারও কাম্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন আরিফুর রহমান।
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরেক নবজাতক কন্যাসন্তানকে রেখে তার পরিবার উধাও হয়ে যায় বলে ৭ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। হাসপাতালের পঞ্চম তলায় শিশু ওয়ার্ডের বেডে তাকে রেখে যান স্বজনেরা। হাসপাতালের ভর্তি রেজিস্ট্রারে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়—ইনছুয়ারা, শাহিনুর, আলাদিপুর, ফুলবাড়ী।
পঞ্চাশোর্ধ্ব এক দম্পতি নানা-নানি পরিচয় দিয়ে নবজাতকটিকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন। পরে তাঁদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আবদুল আজিজের পরিবারের সদস্যদের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফোন কেটে দেন তাঁরা। তাঁরা ‘রং নম্বর’ জানিয়ে ফোন কেটে দিয়েছেন।
শিশুটির পাশে একটি বাজারের ব্যাগ রেখে যাওয়া হয়েছিল। কিছু ওষুধ ছাড়াও জন্মের তারিখ লেখা ছিল ওই ব্যাগের ভেতর মায়ের ফেলে যাওয়া চিরকুটে। লেখা ছিল—‘আমি মুসলিম। আমি একজন হতভাগী। পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে বাচ্চা রেখে গেলাম। দয়া করে কেউ নিয়ে যাবেন। বাচ্চার জন্মতারিখ ৪ নভেম্বর ২০২৫ (মঙ্গলবার)। এগুলো সব বাচ্চার ওষুধ...।’
প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশের পর অনেকেই শিশুটিকে দত্তক নিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বর্তমানে শিশুটি দিনাজপুরের অরবিন্দু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
মুজিব নিউবর্ন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মজিবুর রহমান বলেন, সামাজিক বা পারিবারিক কোনো কারণে এই নবজাতকদের তাদের পরিবার ফেলে রেখে যায়। তারা বেঁচে থাকতেই মা, বাবা বা অন্য কোনো অভিভাবক পাওয়া যায় না। আর মারা গেলে তো আরও পাওয়া যায় না। তাই কন্যাসন্তানটির পরিচয় জানার আর কোনো উপায় নেই।
মুজিব নিউবর্ন ফাউন্ডেশন রাস্তায় ফেলে যাওয়া নবজাতকদের উদ্ধার করে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ হওয়ার পরে আদালতের মাধ্যমে অভিভাবক খুঁজে পেতে সহায়তা করে। হাসপাতালটিতে এই ধরনের বেওয়ারিশ নবজাতকদের জন্য আলাদা একটি বিভাগ আছে। ২০২২ সাল থেকে এ পর্যন্ত উদ্ধারের পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় আট নবজাতক মারা গেছে। হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন আরও সাত নবজাতক। অনেককে নতুন পরিবারের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন মজিবুর রহমান।