সৈয়দ আবদুল হামিদ
সৈয়দ আবদুল হামিদ

অভিমত

অ্যাম্বুলেন্স–সেবাকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে হবে

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অবহেলিত একটি খাত হলো অ্যাম্বুলেন্স–সেবা। রোগীর জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে অনেক সময় হাসপাতালে পৌঁছানোর প্রতিটি মিনিট অমূল্য হয়ে ওঠে।

অথচ দেশের বাস্তবতায় অ্যাম্বুলেন্স–সেবা একটি বিশৃঙ্খল, সিন্ডিকেট-নিয়ন্ত্রিত এবং অনিয়ন্ত্রিত খাতে পরিণত হয়েছে। রোগীর পরিবারগুলো বিপদের মুহূর্তে চড়া ভাড়া দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স নিতে বাধ্য হয়, কিন্তু বিনিময়ে অনেক ক্ষেত্রে ন্যূনতম সেবাটুকুও পায় না।

এ অবস্থার উত্তরণের জন্য বহুদিন ধরেই একটি বিষয় আলোচনায় রয়েছে—অ্যাম্বুলেন্স–সেবাকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনা জরুরি। স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনও এ বিষয়ে সুপারিশ করেছে। একটি শক্তিশালী জাতীয় কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে, যারা সারা দেশের অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনা করবে এবং এর কার্যক্রমে শৃঙ্খলা আনবে। এই কর্তৃপক্ষের অধীনে প্রতিটি অ্যাম্বুলেন্সকে নিবন্ধিত হতে হবে। একই সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের ফিটনেস, নিরাপত্তা এবং ন্যূনতম মানদণ্ড নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক হবে।

এই সেবাকে যদি নেটওয়ার্কভিত্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা যায়, তবে তা শুধু সিন্ডিকেট ভাঙবেই না; বরং দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে একটি নতুন মাত্রা দেবে। রোগীরা বিপদের মুহূর্তে নিরাপদ, ন্যায্য ও মানসম্মত সেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা পাবেন।

বর্তমানে আমাদের দেশে অধিকাংশ অ্যাম্বুলেন্সই আসলে প্রকৃত অর্থে অ্যাম্বুলেন্স নয়। অনেক মাইক্রোবাসকে কেবল বাহ্যিক সাজসজ্জা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করা হয়। ভেতরে জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার মতো কোনো সুবিধাই থাকে না। অথচ যখন একজন রোগী এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে যান, তখনো তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকেন। অর্থাৎ তাঁকে তাঁর অবস্থান পরিবর্তনের পুরো সময়ে ধারাবাহিক চিকিৎসাসেবার প্রয়োজন হয়। অ্যাম্বুলেন্সে ন্যূনতম চিকিৎসা–সুবিধা থাকা আবশ্যক, যেমন অক্সিজেন, প্রাথমিক জীবন রক্ষাকারী যন্ত্রপাতি এবং অবশ্যই একজন প্রশিক্ষিত ‘মেডিকেল পারসনের’ উপস্থিতি।

এ জন্য প্রয়োজন স্পষ্ট সংজ্ঞা। অ্যাম্বুলেন্স বলতে কী বোঝানো হবে? ন্যূনতম সেবা কী থাকবে? সর্বোচ্চ মানের সেবা কীভাবে প্রদান করা যাবে? এসব মানদণ্ড নির্ধারণ করবে প্রস্তাবিত কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে তারা ভাড়া নির্ধারণ করবে—কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া হোক কিংবা নির্দিষ্ট সেবাভিত্তিক ভাড়া হোক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই নির্ধারিত ভাড়ার বাইরে আর কোনো অর্থ নেওয়া যাবে না এবং সেটি ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে জনসাধারণকে জানাতে হবে। প্রয়োজনে রেটিং–ব্যবস্থার মাধ্যমে অ্যাম্বুলেন্স–সেবার মান পর্যালোচনার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।

বর্তমানে রোগীর পরিবারই ব্যক্তিগতভাবে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দেয়। ভবিষ্যতে সারা দেশের অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনার মোট ব্যয় নিরূপণ করে সরকার সেই ব্যয় বহন করতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে সরকারের স্বাস্থ্য বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা গেলে দুর্ঘটনা বা জরুরি অবস্থায় সাধারণ মানুষ প্রায় বিনা মূল্যে বা অত্যন্ত স্বল্প মূল্যে অ্যাম্বুলেন্স–সেবা পেতে পারবে।

তবে বর্তমান বাস্তবতায় সরকারের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে পুরো খরচ বহন করা সম্ভব নয়। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে বেসরকারি খাতের অ্যাম্বুলেন্সকে অবশ্যই নেটওয়ার্ক ও শৃঙ্খলার আওতায় আনতে হবে। এভাবে অন্তত ভাড়া, মানদণ্ড ও সেবার বিষয়ে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

অ্যাম্বুলেন্স–সেবা কেবল একটি পরিবহনসেবা নয়, এটি রোগীর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই সেবাকে যদি নেটওয়ার্কভিত্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা যায়, তবে তা শুধু সিন্ডিকেট ভাঙবেই না; বরং দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে একটি নতুন মাত্রা দেবে। রোগীরা বিপদের মুহূর্তে নিরাপদ, ন্যায্য ও মানসম্মত সেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা পাবেন।