
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এসেছিল কঠিন পথে; অসংখ্য মানুষের ত্যাগে ও সংগ্রামে, নানা রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক উদ্যোগে। গুরুত্বপূর্ণ সেসব ঘটনা নিয়ে এ আয়োজন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি সেনারা স্থলপথে মুক্তিসেনাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছিল। কিন্তু আকাশপথ ছিল আক্রমণের জন্য উন্মুক্ত। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের ১৯৭১: ভেতরে বাইরে বইয়ে জানা যায়, ১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি তিনিসহ বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ বৈমানিক মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। তাঁরা মুক্তিবাহিনীর বিমান শাখা গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতির সঙ্গে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে এ বিষয়ে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।
আগস্ট মাসের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারসহ ভারত সরকারের সচিব কে বি লাল, এয়ার মার্শাল হরি চান্দ দেওয়ান ও ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা অশোক রায়ের সঙ্গে বিমানবাহিনী গঠন বিষয়ে সভা করেন।
ভারতীয়দের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়, বাঙালি বৈমানিকেরা ভারতীয় বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে পারেন। গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে কয়েকটি বিমান, কিছু যুদ্ধ সরঞ্জাম আর প্রশিক্ষণ ও অভিযানের জন্য একটি বিমানঘাঁটি দেওয়ার জন্য ভারতীয়দের অনুরোধ করেন।
কিলো ফ্লাইটের অভিযান শুরুর কথা ছিল ২৮ নভেম্বর। অভিযানের জন্য দুটি বিমান ডিমাপুর থেকে সীমান্তসংলগ্ন বিমানঘাঁটিগুলোতে চলে আসে। জোরহাটে নিয়ে বৈমানিকদের প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দেওয়া হয়। তবে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে অভিযানের আগমুহূর্তে সেটি স্থগিত হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী, উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার এবং ভারতীয় প্রতিনিধিদল মিলিত হয়ে বিমানবাহিনী গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। সভায় ভারত বাংলাদেশকে তিনটি বিমান দিতে রাজি হয়। বিমানবাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরকে নির্বাচন করা হয়।
ডিমাপুরে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তৈরি একটি পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটি ছিল। সেখানে ছিল ৫ হাজার ফুটের রানওয়ে ও এটিসি ভবন। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সেখানে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। শুরুতেই ৯ জন বৈমানিক আর ৪৭ জন বিমানসেনা বিমানবাহিনীর নতুন ইউনিটে যোগ দেন। তাঁদের সঙ্গে প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন ভারতীয় বিমানবাহিনীর চারজন কর্মকর্তা।
২৮ সেপ্টেম্বর ডিমাপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারসহ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বৈমানিক ও গ্রাউন্ড ক্রুরা উপস্থিত ছিলেন। এ কে খন্দকার তাঁর ১৯৭১: ভেতরে বাইরে বইয়ে এ ঘটনাকে এভাবে বলেছেন, তিনটি বিমান নিয়ে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম বিমানবহর জন্মলাভ করল।
কিলো ফ্লাইট ছিল মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের প্রথম ইউনিট। এখানে কিলো নামটি এসেছে বিমানবাহিনীর তৎকালীন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের নামের খন্দকার থেকে।
কিলো ফ্লাইটের অভিযান শুরুর কথা ছিল ২৮ নভেম্বর। অভিযানের জন্য দুটি বিমান ডিমাপুর থেকে সীমান্তসংলগ্ন বিমানঘাঁটিগুলোতে চলে আসে। জোরহাটে নিয়ে বৈমানিকদের প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দেওয়া হয়। তবে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে অভিযানের আগমুহূর্তে সেটি স্থগিত হয়।
কিলো ফ্লাইটের সদস্যদের একজন সামসুল আলম। তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে জুন মাসের দিকে তিনি কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে করাচিতে যান, পরে কৌশলে চলে আসেন ঢাকায়। কিন্তু ঢাকায় আসামাত্র তাঁকে আটক করা হয়। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সরকার ১৯৭১ সালে আটক বন্দীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। তিনি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তি পান। পরে ভারতে গিয়ে বিমান উইংয়ে যোগ দেন।
২০২১ সালে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সামসুল আলম বলেছেন, ‘৩ ডিসেম্বরের বিকেলে ভারতীয় একজন অফিসার এসে জানালেন, সে রাতেই আমাদের অভিযান পরিচালনা করতে হবে।…রাত পৌনে আটটায় ইঞ্জিন চালু করে আটটায় যাত্রা শুরু করলাম। প্রথমে এক হাজার ফুট উঁচু দিয়ে উড়তে শুরু করি। পাকিস্তানি রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য ধীরে ধীরে উচ্চতা কমিয়ে এক শ ফিটে নিয়ে আসি। পানিতে চাঁদের আলোর প্রতিফলন দেখে বুঝতে পারলাম যে আমরা বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে গেছি। এরপর আমরা বাঁয়ে মোড় নিয়ে তেল শোধনাগারের দিকে রওনা হলাম। আমরা যখন সীতাকুণ্ড পার হচ্ছি, তখন হঠাৎ করে দুটি বড় সার্চলাইট জ্বলে ওঠে। তারা সম্ভবত বিমানের আওয়াজ শুনতে পায়। আমরা সার্চলাইট এড়ানোর জন্য আরও নিচ দিয়ে উড়তে শুরু করি। কিছু দূর ওড়ার পর চাঁদের আলোয় বিমানবন্দরের রানওয়ে দেখতে পেলাম। আরও দেখতে পেলাম আমাদের লক্ষ্যবস্তু—সারি সারি তেলাধারগুলো।’
কিলো ফ্লাইট ছিল মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের প্রথম ইউনিট। এখানে কিলো নামটি এসেছে বিমানবাহিনীর তৎকালীন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের নামের খন্দকার থেকে।
কিলো ফ্লাইটের আরেক সদস্য সাহাবউদ্দীন আহমেদ। সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে বইয়ে অভিযানের সবিস্তার বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে (তখন ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ৩ ডিসেম্বর) মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের বীর বৈমানিক মুক্তিযোদ্ধারা বিমানের সাহায্যে পাকিস্তানিদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আক্রমণ করেন। ভারতের তেলিয়ামুরা থেকে অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার আক্রমণ চালায় নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপোতে। হেলিকপ্টার দলে সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম ও আমি ছিলাম। প্রথম অপারেশনে আমি ছিলাম না। আমাকে স্ট্যান্ডবাই হিসেবে রাখা হয়। সুলতান মাহমুদ ও বদরুল আলম নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পৌঁছে তেলের ট্যাংকারের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেন। এর পরের অপারেশনে আমি অংশ নিই।’
৬ ডিসেম্বর স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদের সঙ্গে সিলেট, মৌলভীবাজার ও কুশিয়ারা নদী হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অভিযান পরিচালিত হয়। এ দিন পাকিস্তানি বাংকার লক্ষ্য করে ১৪টি রকেট নিক্ষেপ করা হয়। ব্যবহার করা হয় মেশিনগানও। কুশিয়ারা নদীতে পাকিস্তানি দুটি বার্জের ওপর দুটি রকেট ও ২০০টি গুলি চালিয়ে ডুবিয়ে দেন বিমানসেনারা।
৭ ডিসেম্বর গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিংকে নিয়ে সাহাবউদ্দীন আহমেদ এলাকা পর্যবেক্ষণে উড়াল দেন। শত্রুদের বিরুদ্ধে কয়েকবার আক্রমণ করেন ৮ ডিসেম্বরেও। সিলেটে শত্রুর সদর দপ্তরে আক্রমণ করেন সরাসরি। পাকিস্তানি বাহিনীর ট্যাংক ধ্বংস হয়। সিলেট থেকে ভৈরব বাজারগামী পাকিস্তানি কনভয়ের ওপর পরিচালিত সার্থক হামলা এগুলোর অন্যতম। পরদিন মৌলভীবাজারে হামলার সময় হেলিকপ্টারটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নিরাপদে কৈলাসহর বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ১০ ডিসেম্বর দাউদকান্দির কাছে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভারতীয় বিমান থেকে প্রাণ রক্ষার্থে প্যারাস্যুটে লাফিয়ে পড়া পাইলটকে সফলভাবে উদ্ধার করেন বিমানসেনারা।
৭ ডিসেম্বর গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিংকে নিয়ে সাহাবউদ্দীন আহমেদ এলাকা পর্যবেক্ষণে উড়াল দেন। শত্রুদের বিরুদ্ধে কয়েকবার আক্রমণ করেন ৮ ডিসেম্বরেও। সিলেটে শত্রুর সদর দপ্তরে আক্রমণ করেন সরাসরি। পাকিস্তানি বাহিনীর ট্যাংক ধ্বংস হয়।
উল্লেখযোগ্য আক্রমণটি ছিল ১১ ডিসেম্বর নরসিংদীতে। সাহাবউদ্দীন আহমেদ লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া ত্যাগ করার সময় ভৈরব ব্রিজটি ধ্বংস করে দেয়। ফলে…মিত্রবাহিনী নরসিংদীতে হেলিকপ্টার দিয়ে সেনাদের অবতরণ করাচ্ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী মিত্রবাহিনীর সেনাদের অ্যামবুশ বা ঘিরে ফেলার আশঙ্কা দেখা দিলে ভারতীয় সেনারা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। এ সময় ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ রেডিওযোগে আমাদের কাছে সহায়তা চেয়ে বার্তা পাঠায়। এ মিশনে বদরুল আলম ও আমি ছিলাম। আমাদের সঙ্গে ছিল একজন গানার। আমরা অস্ত্র, গোলাবারুদে সজ্জিত একটি হেলিকপ্টার নিয়ে বেশ নিচুতে নেমে আক্রমণ চালাই। বেশি নিচে নামার কারণে পাকিস্তানি বাহিনীও আমাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। আমরা সব বাধা অতিক্রম করে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর সফল অভিযান চালাতে সক্ষম হই। আমাদের আক্রমণে ওই দিন ২০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও ২০-২৫ জন সেনা আহত হয়। বাকিরা নরসিংদী ছেড়ে পালিয়ে যায়।’
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পর মুক্তিবাহিনীর অটার ও অ্যালুয়েট বৈমানিকেরা হেলিকপ্টারে করে আগরতলা থেকে তেজগাঁওয়ের বিমানবন্দরে এসে অবতরণ করেন।
তথ্যসূত্র:
১. ১৯৭১: ভেতরে বাইরে, এ কে খন্দকার, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৪
২. সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে, সম্পাদক: মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৫
৩. প্রথম আলো, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১