নতুন কোম্পানির ছাড়পত্র ও নিবন্ধন থেকে শুরু করে বর্তমান কোম্পানির বিলুপ্তি—এর মাঝখানে অনেক ধাপ রয়েছে। প্রতিটি ধাপেই আছে নানা ধরনের মাশুল বা ফি। মাশুলেরও রয়েছে আবার বিভিন্ন ধরন। যেমন নামের ছাড়পত্রের আবেদন, নিবন্ধন, স্ট্যাম্প, সনদ, ডিজিটাল সনদ, রিটার্ন ফাইলিং, নিবন্ধন বই পরিদর্শন ইত্যাদি। জেনে নেওয়া যাক, কোম্পানির কোন কাজে কত মাশুল দিতে হয় সরকারকে। আর সরকার এসব থেকে বছরে আয়ই–বা করে কত টাকা।
প্রথমেই দেখা যাক, নামের ছাড়পত্র আবেদনের জন্য কী কী মাশুল রয়েছে। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি (পিএলসি), অংশীদারি কারবার ও বাণিজ্য সংগঠনের প্রস্তাবিত প্রতিটি নামের ছাড়পত্রের জন্য মাশুল রয়েছে ২০০ টাকা করে। তবে সমিতির (সোসাইটি) প্রস্তাবিত প্রতিটি নামের ছাড়পত্রের জন্য মাশুল আবার এক হাজার টাকা। কোম্পানির নামের ছাড়পত্র ৩০ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকে, সমিতির ক্ষেত্রে তা অবশ্য ১৮০ দিন। তবে বিদেশি কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য নামের ছাড়পত্রের প্রয়োজন নেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের (আরজেএসসি) কার্যালয় হচ্ছে দেশের একমাত্র কার্যালয়, যা দেশের আইন অনুযায়ী কোম্পানি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গঠনের সুবিধা দেয় এবং এগুলোর মালিকানা–সম্পর্কিত সব ধরনের নথিপত্র সংরক্ষণ করে।
আরজেএসসি সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৫৫টি প্রতিষ্ঠান আরজেএসসিতে নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ৩ হাজার ৫৩২টি, আর প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি এক লাখ ৭৫ হাজার ৯৩২, বিদেশি ৯৩২, অংশীদারি ৪৯ হাজার ১৮০, বাণিজ্য সংগঠন ১ হাজার ১২১ এবং সমিতি ১৪ হাজার ৯৫৮টি।
সংঘস্মারকের জন্য স্ট্যাম্প মাশুল রয়েছে নির্ধারিত এক হাজার টাকা। তবে সংঘবিধির জন্য স্ট্যাম্প মাশুল নেওয়া হয় তিনটি শ্রেণিতে। যেমন ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুমোদিত মূলধনের জন্য মাশুল তিন হাজার টাকা। ২০ লাখ টাকার বেশি থেকে ছয় কোটি টাকা পর্যন্ত মাশুল আট হাজার টাকা। আর ছয় কোটি থেকে ওপরে যত বেশিই হোক না কেন, সে জন্য ২০ হাজার টাকা। তবে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুমোদিত মূলধনের ক্ষেত্রে কোনো মাশুল লাগে না।
প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি নিবন্ধনের জন্যও মাশুল আছে। সংঘস্মারক, সংঘবিধিসহ পাঁচটি আলাদা ফরম পূরণের নিবন্ধন মাশুল ৪০০ টাকা করে মোট ২ হাজার ৪০০ টাকা।
এ ধরনের কোম্পানির সংঘস্মারকের স্ট্যাম্প মাশুল নির্ধারিত এক হাজার টাকা। তবে ২০ লাখ থেকে ছয় কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনের ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প মাশুল চার হাজার টাকা এবং ছয় কোটির বেশির ক্ষেত্রে ২০ হাজার টাকা।
পিএলসির নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ৮ থেকে ৯ ধরনের ফাইল রয়েছে, যার প্রতিটির জন্য স্ট্যাম্প ফি রয়েছে ৪০০ টাকা। ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুমোদিত মূলধনের ক্ষেত্রে পিএলসির জন্যও কোনো মাশুল লাগে না।
বিদেশি কোম্পানির সংঘস্মারক ও সংঘবিধির জন্য স্ট্যাম্প মাশুল নির্ধারিত দুই হাজার টাকা। এ ধরনের কোম্পানির নিবন্ধনের জন্য সংঘস্মারক, সংঘবিধিসহ ফাইল প্রস্তুত হয় ছয়টি। প্রতিটির জন্য আলাদা করে রয়েছে ৪০০ টাকা।
বাণিজ্য সংগঠনের সংঘস্মারক স্ট্যাম্প মাশুল এক হাজার টাকা ও সংঘবিধির স্ট্যাম্প মাশুল দুই হাজার টাকা নির্ধারিত। বাণিজ্য সংগঠনের পরিচালকদের অনুলিপির জন্য রয়েছে আরও ১৫০ টাকা।
বাণিজ্য সংগঠনের নিবন্ধন করতে সংঘস্মারক ও সংঘবিধির জন্য মাশুল ৬০০ টাকা। এ ছাড়া পাঁচ ধরনের ফরম পূরণ করতে হয়, প্রতিটির জন্য রয়েছে ২০০ টাকা করে।
এ ছাড়া বাণিজ্য সংগঠনের সদস্য ২০ জন হলে এক হাজার টাকা, ২০ থেকে ১০০ জন সদস্যের ক্ষেত্রে দুই হাজার ৫০০ টাকা মাশুল দিতে হয়।
প্রত্যয়িত অনুলিপি বা সার্টিফায়েড কপির জন্য প্রাইভেট, পাবলিক, বিদেশি কোম্পানি, বাণিজ্য সংগঠন, সমিতি ও অংশীদারি কারবারের জন্য স্ট্যাম্প মাশুল, কোর্ট মাশুল ও অন্যান্য মাশুল রয়েছে।
যেমন স্ট্যাম্প মাশুল সংঘস্মারক, সংঘবিধি ও অন্য যেকোনো কাগজের মাশুল আলাদা ৫০ টাকা করে। কোর্ট মাশুল আছে ২০ টাকা। অন্যান্য মাশুলের মধ্যে রেকর্ড পরিদর্শনের জন্য ২০০, নিয়মিতকরণ প্রত্যয়নপত্রের অনুলিপির জন্য ২০০, ব্যবসা শুরুর সনদের অনুলিপির জন্য ২০০, কোনো কাগজের প্রতি ১০০ শব্দের বা তার খণ্ডিত অংশের অনুলিপির জন্য ১০ টাকা মাশুল দিতে হয়।
সমিতির নিবন্ধন নিতে হয় ১৮৬০ সালের নিবন্ধন আইন অনুযায়ী। যেকোনো সমিতির নিবন্ধন মাশুল ১০ হাজার টাকা। এর বাইরে নিবন্ধন ফাইলিংয়ের জন্য মাশুল রয়েছে ৪০০ টাকা এবং ডিজিটাল সনদের জন্য এক হাজার টাকা।
অংশীদারি কারবারের নিবন্ধন নিতে হয় ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইন অনুযায়ী। এর আওতায় নিবন্ধন মাশুল এক হাজার টাকা। নিবন্ধন ফাইলিংয়ের মাশুল ৪০০ টাকা। তবে ডিজিটাল সনদের জন্য কোনো মাশুল নেওয়া হয় না।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রাইভেট ও পাবলিক কোম্পানি এবং বাণিজ্য সংগঠনের রিটার্ন ফাইলিংয়ের মাশুল দিতে হয় ২০০ টাকা।
আর বিদেশি কোম্পানির রিটার্ন ফাইলিং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হলে দিতে হয় ৪০০ টাকা। সমিতির ক্ষেত্রে প্রতিটি ডকুমেন্টের জন্য ৪০০ এবং অংশীদারির কারবারের ক্ষেত্রে প্রতিটি ডকুমেন্টের জন্য ৪০০ টাকা মাশুল রয়েছে। দেরিতে রিটার্ন জমা দিলে অবশ্য জরিমানা গুনতে হয়।
কোম্পানির অবসায়নের ক্ষেত্রেও মাশুল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ডকুমেন্ট প্রতি মাশুল দিতে হয় ৪০০ টাকা। অবসায়ন যেমন স্বেচ্ছায় হতে পারে, আবার আদালতের মাধ্যমেও হতে পারে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে আরজেএসসির আয় ছিল ৪০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২১৮ কোটি টাকাই ছিল স্ট্যাম্প মাশুল। কিন্তু ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট আয় অর্ধেকের বেশি কমে হয়েছে, ১৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৩ কোটি টাকা স্ট্যাম্প মাশুল।
আরজেএসসির নিবন্ধক মো. মকবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের আঘাতে বিদায়ী অর্থবছরে আমাদের আয় কমে গেছে। এখন অবশ্য বাড়ছে। যেমন চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আয় ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থবছর শেষে তা ৩০০ কোটি টাকার মতো হবে বলে আশাবাদী তিনি।