তবু স্বল্পসুদে ঋণের দাবি মিটছে না

রাজধানীর তেজগঁাও এলাকার একটি বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ করছেন শ্রমিকেরা l ছবি: হাসান রাজা
রাজধানীর তেজগঁাও এলাকার একটি বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ করছেন শ্রমিকেরা l ছবি: হাসান রাজা

আবাসন খাতে ঋণের চাহিদা বাড়লেও সহজ সুদে ঋণ মিলছে না। অথচ দীর্ঘদিন ধরে আবাসন ব্যবসায়ীরা এ খাতের জন্য এক অঙ্কের (সিঙ্গেল ডিজিট) সুদে ঋণের দাবি জানিয়ে আসছেন। গ্রাহকদের দিক থেকেও রয়েছে কম সুদে গৃহঋণের চাহিদা। কিন্তু সেই চাহিদা পূরণ হচ্ছে না বাংলাদেশে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নেপাল, ভারত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের তুলনায় গৃহঋণের সুদের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো দেশে ১ থেকে ৫ শতাংশ সুদে গৃহঋণ পাওয়া গেলেও বাংলাদেশের সুদের এই হার ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। আর নেপাল ও ভারতে এ ধরনের ঋণের সুদ হার ব্যাংকভেদে ৯ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত।
হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন বা এইচএসবিসি মালয়েশিয়ার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ওই দেশে ব্যাংকটি ৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ সুদে ৩০ বছর মেয়াদি গৃহনির্মাণ দিয়ে থাকে।
সিঙ্গাপুরের আর্থিক বাজারের বিভিন্ন সেবা নিয়ে তুলনামূলক তথ্য প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান আইমানি সিঙ্গাপুরের ওয়েবসাইটে ওই দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের গৃহঋণের যে বিবরণ রয়েছে, তাতে ব্যাংকভেদে সুদ হার ১ থেকে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত।
বাংলাদেশে সর্বোচ্চ গৃহঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের (বিএইচবিএফসি) ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি যে গৃহঋণ প্রদান করে, তার বার্ষিক সর্বনিম্ন সুদহার ১২ শতাংশ। বেসরকারি বিদেশি ব্যাংক এইচএসবিসি বাংলাদেশের গৃহঋণের বার্ষিক গড় সুদহার ১৫ শতাংশ। দেশীয় বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংকের গৃহঋণের বার্ষিক সুদহার ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশে বার্ষিক ১২ শতাংশের কম সুদহারে কোনো গৃহঋণ পাওয়া যায় না। ফলে এ দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের নিজের একটি ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার স্বপ্নটি তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অধরা থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে, ক্রেতার অভাবে আবাসন ব্যবসায়ও চলছে মন্দা।
আবাসন খাতে ঋণের চাহিদা যে বাড়ছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল বাংলাদেশ ব্যাংকের এক হিসাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জুনে সমাপ্ত আর্থিক বছর শেষে আবাসন খাতে পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের জুনে যার পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা মিলে আবাসন খাতে এ বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণ করেছে। এ খাতে ঋণ সহায়তা দিতে ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে সরকারি-বেসরকারি একাধিক বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১২ সালের জুনে এ খাতে পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১১ সালের জুন মাস শেষে এ পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিবছরই এ খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।
তবে এসব ঋণের সুদের হার সাধারণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সামর্থ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এ খাতের স্বল্পসুদে ঋণ সহায়তা দেওয়ার জন্য বিশেষ একটি ঘূর্ণমান তহবিল গঠন করেছিল। তবে ২০১০ সালের পর সেই তহবিলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কিন্তু বর্তমানে এ খাতটিতে যে মন্দাভাব চলছে, তা কাটাতে ও সাধারণ মানুষের আবাসনের চাহিদা মেটাতে আবারও এ খাতের জন্য ‘স্বল্পসুদের বিশেষ তহবিল’ গঠনের দাবিটি বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। এমনকি এক সুদে এ খাতের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করারও দাবি এ খাতের ব্যবসায়ীদের।
আবাসন খাতের জন্য গঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘূর্ণমান তহবিলটি বন্ধ করে দেওয়া হলেও গৃহনির্মাণ খাতে গৃহহীনদের জন্য সরকারের ‘গৃহায়ণ তহবিল’ নামে বিশেষ একটি তহবিল রয়েছে। মাত্র ২ শতাংশ সুদে সরকার এ তহবিল থেকে গৃহনির্মাণের জন্য বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওকে ঋণসুবিধা দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত সরকার এ তহবিল দেশি-বিদেশি ৫১৩টি এনজিওকে ১৭০ কোটি টাকা ঋণসুবিধা দিয়েছে। এ ঋণের টাকায় তৈরি হয়েছে প্রায় ৫৯ হাজার ঘর। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য এসব ঘর তৈরি করা হয়েছে। এর আদলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের আবাসন নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ একটি তহবিল গঠনের দাবি এখন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের।
এ বিষয়ে আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী তানভিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আবাসন খাতের মন্দাভাব কাটাতে হলে এবং ক্রেতা-বিক্রেতার চাহিদা পূরণ করতে হলে এ মুহূর্তে সবার আগে দরকার অর্থ। দুভাবে এ অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমত, যাঁরা নিজের একটি ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু আর্থিক সামর্থ্য নেই, তাঁদের জন্য স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত, যাঁদের অনেক টাকা আছে, কিন্তু নানা কারণে এ খাতে বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছেন না, তাঁদের সেসব অর্থ এ খাতে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া। যাতে ওই সব অর্থ বিদেশে পাচার না হয়।
আবাসন খাতের মন্দাভাব কাটাতে হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে বিশেষ তহবিল গঠনের দাবি জানান এ আবাসন ব্যবসায়ী।