
যাঁরা নতুন করে বাড়ি বা কোনো স্থাপনা তৈরি করতে যাচ্ছেন, তাঁদের যথাযথ নিয়ম মেনে ভবন তৈরি করতে হবে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ভবন তৈরির সময় ভূমিকম্প-সহনশীলতার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট এক গবেষণায় জানিয়েছে, বাংলাদেশের ঢাকাসহ অন্য এলাকায় ভূমিকম্প বা অন্যান্য কারণে ভবন ধসের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার বেশির ভাগই ভবনের ভিতের নকশা সঠিক না হওয়ার কারণেই ঘটেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ ভবন তৈরির সময় মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করা হয় না এবং ভূমিকম্প-সহনীয় করে তৈরি হয় না। এসব কারণেও ভূমিকম্পের সময় ভবন ধস হয়। স্থাপত্য বিশেষজ্ঞরাও একই মত দিলেন।
এই গবেষণার পক্ষে সমর্থন দিলেন বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্প এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেখানে আমরা যতই প্রস্তুতি নিই না কেন তা কোনো কাজে আসবে না যদি অবকাঠামো সঠিকভাবে নির্মাণ করা না হয়। সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা ও নির্মাণকৌশল সঠিকভাবে করা এবং নির্মাণের সময় তা নিশ্চিত করা।’
হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ভূতাত্ত্বিক মো. আবু সিদ্দিক বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় যে গবেষণা করেছি, সেখানে প্রমাণিত হয়েছে যে ভূমিকম্প বা অন্যান্য সময় ভবন ধসের কারণ হচ্ছে ভবনের ভিতের নকশা সঠিক না থাকা, মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা না করা এবং ভূমিকম্প-সহনীয় ভবন নির্মাণ না করা। তাই বাড়ি বা ভবন নির্মাণের সময় ভূমিকম্প-সহনীয় নির্মাণ পর্যায়গুলো সঠিকভাবে মেনে চলতে হবে।’ তিনি বলেন, ঢাকা শহরের শক্ত মাটিতে ভূমিকম্পের তীব্রতা ‘সাত’ বিবেচনায় ও নরম মাটিতে তীব্রতা ‘নয়’ বিবেচনায় স্থাপনা নির্মাণ করা উচিত। একটা ভূমিকম্প হলে সেখান থেকে কতটা শক্তি নির্গত হয়, তার পরিমাপই হলো ভূমিকম্পের মাত্রা। এ জন্য ভবন নির্মাণের শুরুতেই জিও টেকনিক্যাল প্রকৌশলীর পরামর্শে ভবন তৈরির স্থানের মাটি পরীক্ষা ও ভিতের নকশা প্রণয়ন করাতে হবে। এরপর ক্রমান্বয়ে স্থপতির পরামর্শে স্থাপত্যের নকশা তৈরি, কাঠামোপ্রকৌশলীর পরামর্শে কাঠামোর নকশা, তড়িৎ ও যন্ত্রপ্রকৌশলীর সমন্বয়ে একটি আদর্শ ভবন নির্মাণ করতে হবে। তবে সবকিছু নকশার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী এম শামীম উজ জামান বসুনিয়া বলেন, ‘ভবন তৈরির সময় অনেকে টাকা বাঁচানোর জন্য ভবনের নকশা থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজ করতে পেশাদার প্রকৌশলীর মতামত না নিয়ে শুধু মিস্ত্রিদের কথা শোনেন। এটা ঠিক নয়। আবার নকশাপ্রণয়ন করেই অনেক প্রকৌশলী দায় শেষ করেন। মিস্ত্রি সেটি ঠিকমতো অনুসরণ করছেন কি না, সে বিষয়ে তাঁরা আর ঠিকমতো খোঁজ নেন না। এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটি ভবন কখনো পুরোপুরি ভূমিকম্প প্রতিরোধক ভবন হতে পারে না। কিন্তু সেটি এমনভাবে তৈরি করতে হয়, যেন ভূমিকম্পে অধিক সময় ধরে টিকে থাকতে পারে।’ ভবন তৈরির সময় যে রড বা রিং ব্যবহার হচ্ছে বা যে বিম তৈরি হচ্ছে, তা ঠিকমতো হচ্ছে কি না অথবা কলামের সাইজ ঠিক হচ্ছে কি না—তা শুধু মিস্ত্রির ওপর ছেড়ে না দিয়ে দক্ষ প্রকৌশলীদের দিয়ে তদারক করাতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
এখনো বাংলাদেশে বিভিন্ন ভবন নির্মাণের সঙ্গে স্থপতি ও প্রকৌশলীরা জড়িত থাকেন না বলে মনে করেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। ঢাকায় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নকশার ছাড়পত্র দেন রাজউক প্রকৌশলীরা। এ ক্ষেত্রে প্রকৌশলীদের আরও সতর্ক হতে হবে। তিনি বলেন, সাধারণত মালিক ও রাজমিস্ত্রিরা নিজেদের মতো করে ভবন নির্মাণ করেন। কিন্তু এটা ঠিক নয়। এই কাজ করতে হবে পেশাদার প্রকৌশলীদের দিয়ে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এতে ব্যবহৃত নানা উপকরণ যেন মানসম্পন্ন হয়, সেদিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।