
প্রতিবছর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষ ঘরবাড়ি ও জীবিকা হারাচ্ছে। তাই শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা ও টেকসই বিমাব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান এম আসলাম আলম।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় অক্সফাম ইন বাংলাদেশ, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) যৌথ আয়োজনে গতকাল সোমবার ইআরএফ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘জলবায়ুঝুঁকি বিমা (সিআরআই) বিষয়ে গণমাধ্যমের সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক কর্মশালায় আসলাম আলম এ কথা বলেন।
আইডিআরএ চেয়ারম্যান আরও বলেন, প্রচলিত বিমাব্যবস্থা অতীত ক্ষতির ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু জলবায়ুঝুঁকি ভবিষ্যৎমুখী। সে কারণে আবহাওয়াভিত্তিক বিমার দরকার আছে। দেশে অবশ্য এর আইনি স্বীকৃতি নেই। নীতিমালা হলে এ স্বীকৃতি মিলবে। নাগরিকদের প্রকৃত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে আইন সংস্কার, শক্তিশালী তথ্যভান্ডার, প্রযুক্তি ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দৃঢ় সহায়তার মাধ্যমে টেকসই জলবায়ুঝুঁকি বিমাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
বিশ্বের অন্যতম জলবায়ুঝুঁকিপ্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশে শীতের স্থায়িত্ব ১৫ দিন কমেছে। ফলে কৃষি ও জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব পড়ছে—এমন মন্তব্য করে আসলাম আলম আরও বলেন, ফসলের বিমা করতে আইনিসহ আরও কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। কৃষি আবহাওয়াসংক্রান্ত শক্তিশালী তথ্যভান্ডার, প্রযুক্তি ও একাধিক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় করা চ্যালেঞ্জিং। কোন এলাকায় কতটুকু বন্যা হয় বা হবে, তার তথ্যভান্ডার নেই। আবার আবহাওয়া বিরূপ হলে ফসলের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, তা–ও নির্ধারণ করা জটিল।
বিমাপ্রক্রিয়া বাস্তবায়নে আইডিআরএর পাশাপাশি আবহাওয়া অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন বলে মনে করেন আসলাম আলম। তিনি বলেন, অনেক সংস্থা জড়িত থাকায় কাজে ধীরগতি দেখা যায়—অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হওয়ার মতো অবস্থা হয়। তারপরও বিমা আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দরিদ্র মানুষের জন্য ক্ষুদ্রবিমা ও সিআরআই নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে।
বিমার আওতা কম
কর্মশালায় আরও জানানো হয়, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হলেও এখানে বিমার আওতায় থাকা মানুষ কম। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বিমার অবদান শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ। ফলে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও খরার মতো দুর্যোগে কোটি মানুষের জীবিকা ও সম্পদ মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছে। এমন সময়ে জাতীয় নীতিতে ও জনসচেতনতায় সিআরআইয়ের সংযুক্তি আর ঐচ্ছিক নয়, বরং অপরিহার্য। সে কারণে জীবন ও জীবিকার সুরক্ষায় বিমাকে সহজবোধ্য করা, আস্থা তৈরি করা ও কার্যকর সমাধান প্রণয়নে সাংবাদিক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও উন্নয়ন অংশীদারদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
সিআরআইয়ের সম্ভাবনা আছে
কর্মশালায় আরও বলা হয়, ২০২৪ সালে কুড়িগ্রামে পরিচালিত এক পরীক্ষামূলক প্রকল্পে সিআরআইয়ের সম্ভাবনা প্রমাণিত হয়েছে। ডব্লিউএফপি, অক্সফাম ও গ্রিন ডেলটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে সূচকভিত্তিক বন্যা বিমা প্রকল্প চালু করেছিল। এর আওতায় ২০ হাজারের বেশি বন্যাকবলিত কৃষক মুঠোফোনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। ৪০ বছরের বেশি সময়ের বন্যার তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি এ বিমা পণ্যে ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি যাচাই ছাড়াই অল্প কিছু দিনের মধ্যে সহায়তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা বলেন, জলবায়ুঝুঁকি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও পরিবর্তন আনতে হবে। দুর্যোগের ধাক্কা সামলাতে ও দরিদ্র পরিবারগুলোকে ঋণের ফাঁদে পড়া থেকে রক্ষায় সহায়ক হতে পারে এই জলবায়ুবিমা। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে আছেন নারীরা। সংকটকালে তাঁদের সহায়তা দেওয়া দরকার।
গণমাধ্যমের ভূমিকা
সিআরআইয়ের গুরুত্ব তুলে ধরতে গণমাধ্যমের ভূমিকা কী হতে পারে, সে বিষয়ে আলোকপাত করেন বক্তারা। ডব্লিউএফপি বাংলাদেশের প্রোগ্রাম পলিসি অফিসার নূরুল আমিন বলেন, জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোর সহায়তা পাওয়া বিষয়টি অনিশ্চিত। সহায়তা পেতে তাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয় বা মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়—এটা উচিত নয় বলে মনে করেন তিনি। এই অনিশ্চয়তা দূর করতে সিআরআই কার্যকর মাধ্যম হতে পারে। এর মাধ্যমে তারা দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা পেতে পারে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অক্সফাম ইন বাংলাদেশের ক্লাইমেট জাস্টিস ও ন্যাচারাল রিসোর্স রাইটস বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ এমরান হাসান বলেন, জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা এই সংকট সৃষ্টি করেনি, অথচ তারাই এর সবচেয়ে বেশি মূল্য দিচ্ছে। এই সুরক্ষা যেন দরিদ্রতম মানুষের কাছে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারা এ–বিষয়ক প্রতিবেদন তুলে ধরতে পারে।
অক্সফাম ইন বাংলাদেশের ইনফ্লুয়েন্সিং, কমিউনিকেশনস, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের প্রধান মো. সারিফুল ইসলামের সঞ্চালনায় কর্মশালায় আরও বক্তব্য দেন অক্সফাম ইন বাংলাদেশের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার নাফিসা তাসনিম খান, জলবায়ুনীতি বিশেষজ্ঞ এস এম সাইফি ইকবাল, ইআরএফ সভাপতি দৌলত আক্তার, সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম ও প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ফখরুল ইসলাম।