৬ ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপি

ঋণ আদায়ে লাগবে ৩৩৩ বছর

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের শীর্ষ-২০ খেলাপির কাছ থেকে টাকা আদায় হচ্ছে সামান্যই। এসব ঋণের বড় অংশই রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া। কখনো ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগসাজশ করে, কখনো–বা ব্যাংকগুলোর ওপর হস্তক্ষেপ করে এ টাকা নিয়ে গেছেন প্রভাবশালী শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা। এখন সেসব টাকা তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলো। অথচ এগুলো মানুষের আমানতের টাকা।

বর্তমানে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৯ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ছয় ব্যাংকের ১২০ জন শীর্ষস্থানীয় খেলাপি গ্রাহকের (প্রতিটি ব্যাংকের ২০ জন করে) কাছে আটকা ৮৫ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংক হলো সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল।

এই ছয় ব্যাংক ২০২৫ সালে অন্তত ৮ হাজার ৭৭ কোটি টাকা আদায় করবে বলে ঠিক করেছিল। গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে তারা শীর্ষস্থানীয় ১২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছ থেকে ১২৮ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ৫৮ শতাংশ আদায় করেছে। এ হারে টাকা আদায় চলতে থাকলে ছয় ব্যাংকের শীর্ষ-২০ ঋণখেলাপির কাছ থেকে টাকা আদায় হতে সময় লাগবে ৩৩৩ বছর।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি জানতে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে ডেকেছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। ঢাকায় সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) বৈঠকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেকও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বৈঠকে ব্যাংকগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন।

অর্থ উপদেষ্টাকে বৈঠকে জানানো হয়, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে ৬ ব্যাংকের যে ৮৫ হাজার ৪৪৪ কোটি পাওনা, তা এসব ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ৫৭ শতাংশ। আবার মোট ৮৫ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকার ৬৩ শতাংশ অর্থাৎ ৫৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা রয়েছে এক জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ২০ গ্রাহকের কাছেই।

সমস্যা হচ্ছে, গ্রাহকদের পক্ষ থেকে আদালতে রিট দায়ের। তাই খ্যাতনামা আইনজীবীদের দিয়ে আদালতে লড়তে হবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ, অর্থ উপদেষ্টা।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায়ে তৎপরতা বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এক থেকে দুই মাস পরপর আদায় পরিস্থিতির তদারকও করতে হবে। সমস্যা হচ্ছে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে আদালতে রিট দায়ের। তাই খ্যাতনামা আইনজীবীদের দিয়ে আদালতে লড়তে হবে।

খ্যাতনামা আইনজীবী নিয়োগ দিতে যে বেশি খরচ হয়, সে ব্যাপারে সরকারের মনোভাব কী, এ ব্যাপারে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘তারা বেশি বেশি বোনাস নিতে পারে, অথচ ভালো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারে না, এটা কোনো কথা না। আইনজীবী নিয়োগের খরচ দেখাবে তারা। আমি একটা চেষ্টা করছি আইন উপদেষ্টা ও অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে বসে আলাদা কোনো বেঞ্চ দেওয়া যায় কি না।’

আদায় এত কম কেন

শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে জনতা ব্যাংকের টাকার পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। বাছবিচারহীনভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ দেওয়ার কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে এই ব্যাংকের যে ৫৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা রয়েছে, তার মধ্যে বেক্সিমকো, এস আলম ও অ্যাননটেক্স—এ তিন গ্রাহকের কাছেই আটকা ৪০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।

শীর্ষ খেলাপিদের থেকে চলতি ২০২৫ সালে জনতা ব্যাংক আদায় করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল ৫ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। কিন্তু বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি আদায় করেছে ১৫ কোটি ১২ লাখ টাকা।

জনতা ব্যাংকের এমডি মজিবুর রহমান বলেন, ‘খেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় ছাড়া অন্য সূচকগুলোর উন্নতি হচ্ছে। যেমন আমানত বেড়ে এখন ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। প্রবাসী আয়ও ভালো আসছে। অবলোপন থেকেও সবার থেকে বেশি আদায় আমাদের।’

শীর্ষ খেলাপিদের থেকে আদায় বেশি না হওয়ার কারণ হিসেবে মজিবুর রহমান বলেন, ‘আগের ভুল তো আছেই। তবে আদায়ের জন্য মামলা

করেছি। মামলার বিপরীতে গ্রাহকদের পক্ষে রিট হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই রিট খারিজের চেষ্টা চলছে।’

শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে অগ্রণী ব্যাংকের পাওনা ১১ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮৯২ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ব্যাংকটি আদায় করেছে মাত্র ১৯ কোটি টাকা।

লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অন্যদের তুলনায় বেশি আদায় করেছে রূপালী ব্যাংক। শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে রূপালী ব্যাংকের পাওনা ১০ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি বছর ১ হাজার কোটি টাকার আদায় লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ব্যাংকটি আদায় করেছে ৯০ কোটি ২৮ লাখ টাকা।

বড় চার ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের আদায় সবচেয়ে কম অর্থাৎ ৫০ লাখ টাকা। এ ব্যাংক শীর্ষ ২০ গ্রাহকের কাছে পায় ৬ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। ব্যাংকটি এক বছরে ৩০০ কোটি টাকা আদায় লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করলেও ছয় মাসে ৫০ লাখ টাকার বেশি আদায় করতে পারেনি।

এ ছাড়া বেসিক ব্যাংক শীর্ষ ২০ গ্রাহকের কাছে পাওনা ২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকার মধ্যে এক বছরে ৪০০ কোটি টাকা আদায় করবে বলেছিল। ব্যাংকটি ছয় মাসে আদায় করেছে ১০ লাখ টাকা। আর বিডিবিএল ৫০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ১০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। আদায় হয়েছে ৩ কোটি ৫ লাখ টাকা।