Thank you for trying Sticky AMP!!

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের চক্রটি ভেঙে দিন

সাংবাদিকতার কারণে দীর্ঘদিনের চেনা। এখন তিনি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এক সকালে ফোন করলেন। গলায় উদ্বেগ। সেদিনই ছাপা হয়েছে উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টসের ব্যাপক অনিয়মের খবর। টেলিফোনে তাঁর কথার সারমর্ম হচ্ছে, গ্রাহকের অর্থ নিয়ে উত্তরা ফাইন্যান্সের অনিয়মের খবরে বিপদে পড়বে অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে যারা ভালো অবস্থানে আছে তারাও। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত নন-ব্যাংক। অর্থাৎ সাধারণ ব্যাংকের মতো তারা চলতি আমানত সংগ্রহ করতে পারে না, দৈনন্দিন লেনদেন তাদের বিষয় নয়। তবে তাদের কাছে মেয়াদি আমানত রাখা যায়, প্রয়োজনমতো উত্তোলনও করা যায়। তারা সাধারণ ব্যাংক নয় বলে সুদহার একটু বেশি দিয়ে আমানতকারীদের আকৃষ্ট করে। সুতরাং কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যেকোনো ধরনের অনিয়মের খবরে আমানতকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেন, তাতে আমানত তুলে নেওয়ার চাপ বাড়ে।

Also Read: পিপলস লিজিং অবসায়নের দায় কার

মনে আছে, ২০১৯ সালে যখন আরেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের অবসায়ন সিদ্ধান্তের খবর প্রকাশ হওয়ার পর একই রকম হাহাকার শুনেছিলাম আর্থিক প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে কাজ করা আরেকজনের কাছ থেকে। যেদিনই কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোনো অনিয়মের সংবাদ প্রকাশিত হয়, সেদিনই আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে একদল আমানতকারী অর্থ উঠিয়ে নেন।

অর্থনীতিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরও বড় অবদান আছে। কিন্তু তারাও নানা ধরনের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ছে। এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

বলা যায় প্রশান্ত কুমার বা পি কে হালদার একাই দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনেকখানি সর্বনাশ ঘটিয়েছেন। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ছাড়াও তাঁর দখলে ছিল আরও তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যেমন পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)।

সবগুলোই তিনি দখল করেছিলেন ভিন্ন পথে, কৌশল করে। এসব প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্য তিনি নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলেছেন, এসব কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন, তারপর কোম্পানি দখল করে ঋণের নামে টাকা সরিয়েছেন। এখন চারটি প্রতিষ্ঠানই সংকটে। গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না।

শুরু হয়েছিল পিপলস লিজিং দিয়ে। তারপর একে একে জানা যায় পি কে হালদারের আরও দখলের খবর। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের দুই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে তিনি এখন পলাতক। বলা যায়, সবার চোখের সামিনে দিয়েই তিনি পালিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক যখন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতের তদন্ত করছে, তখনো তিনি দেশে বহাল তবিয়তে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করতে পারেননি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করলে একপর্যায়ে তিনি পালিয়ে যান। সম্ভবত আত্মসাৎ করা সব অর্থ তিনি পাচার করে নিয়ে যেতে পারেননি বলেই আবার কৌশলে দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। পি কে হালদারকে না পেয়ে এখন দুদক গ্রেপ্তার করা শুরু করেছে তাঁর সহযোগীদের।ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের দুই হাজার কোটি টাকা

Also Read: সরকারি ব্যাংকের পর্যবেক্ষকদের নিয়ে যত কাণ্ডকারখানা

পি কে হালদার পর্ব শেষ না হতেই এখন এল উত্তরা ফাইন্যান্সের নাম। এর আগে গত ডিসেম্বরে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় আদালতের নির্দেশে প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সে প্রশাসক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের ঘটনা এই প্রথম। সব মিলিয়ে অন্তত ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নানা ধরনের সংকটে আছে।

নতুন একটি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার পর দেশে এখন ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। আর নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে ৩৫টি। এসব প্রতিষ্ঠান দেখভাল করার দায়িত্ব বাংলাদেশ বাংকের। এ কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে তা বলা যাবে না। তাদের চোখের সামনেই একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। ধারণা ছিল, হয়তো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তত অনিয়মের বাইরে থাকবে। কারণ, তাদের আমানত কম, ঋণও কম। অল্প পরিসরে তারা কাজ করে। ব্যাংকের মতো বিশাল বিশাল কোম্পানির পেছনে তারা ছোটে না। বরং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের উন্নতিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদার অপরিসীম।

আরেকটি দিক নিয়েও আলোচনা করার সুযোগ আছে। বিশেষ করে উত্তরা ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির দুই বছরের আর্থিক প্রতিবেদন সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছে।

এখন দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান একের পর এক অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেখভাল করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আছে দুটি বিভাগ। যেমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগ। এর মধ্যে পরিদর্শন বিভাগটি তুলনামূলকভাবে নতুন তৈরি। এ দুই বিভাগকে পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করার সময় এসেছে। এ কথা বলার কারণ হচ্ছে, পি কে হালদার যে কৌশলে একের পর এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেছেন, তাতে মদদ ও সহযোগিতা ছিল আরও অনেকের। স্পষ্ট করে বলা যায়, সবকিছুই হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও শেয়ারবাজার কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতায়। এ ক্ষেত্রে খোঁজখবর করার পর কোনো কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নামও জানা যায়, যা ব্যাংকপাড়ায় ‘ওপেন সিক্রেট’। এ রকম কিছু কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা বছরের পর বছর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেখভালের দায়িত্বে আছেন। এ চক্র ভেঙে দেওয়ার সময়ও এসেছে।

Also Read: ৩৫০০ কোটি টাকা নিয়ে চম্পট

আরেকটি দিক নিয়েও আলোচনা করার সুযোগ আছে। বিশেষ করে উত্তরা ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির দুই বছরের আর্থিক প্রতিবেদন সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছে। সুতরাং ত্রুটিপূর্ণ এসব আর্থিক প্রতিবেদন যারা তৈরি করে, তাদের ক্ষেত্রেও অনেক বেশি কঠোর হওয়া প্রয়োজন। এর আগে পিপলস লিজিংয়ের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে একই ধরনের প্রশ্ন উঠেছিল। উত্তরা ফাইন্যান্সের ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করে এস এফ আহমেদ অ্যান্ড কোং। তারা অবশ্য কোনো আপত্তি তোলেনি। এটাকে তাদের ব্যর্থতা না বলে যোগসাজশই বলা উচিত। যাঁরা যোগসাজশে এসব করেন, তাঁদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও সনদধারী হিসাববিদ বা নিরীক্ষকদের সংগঠন দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) আরও জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত।

সুতরাং, এখনই উদ্যোগ না নিলে দেশের আর্থিক খাতের সংকট আরও বাড়বে, তাতে ক্ষতি দেশের অর্থনীতির।