ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির নাটক বন্ধ করা দরকার 

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে এ বছর। সংগঠনটির সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আজ থেকে তিন দিনের বাংলাদেশ ব্যবসা সম্মেলন শুরু হচ্ছে। পাঁচ দশকে এফবিসিসিআইয়ের কার্যক্রমের মূল্যায়ন, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট, অর্থ পাচার, রাজস্ব আদায়সহ নানা বিষয়ে সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার। 

প্রশ্ন

৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আন্তর্জাতিক ব্যবসা সম্মেলন করতে যাচ্ছেন আপনারা। এতে দেশের অর্থনীতি কীভাবে উপকৃত হবে?

জসিম উদ্দিন: এফবিসিসিআইয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে তিন দিনের ব্যবসা সম্মেলন শুরু হচ্ছে ১১ মার্চ। এতে অংশীদার হিসেবে রয়েছে সিএনএন। সম্মেলনে বেশ কয়েকটি দেশের মন্ত্রী অংশ নেবেন। থাকবেন কয়েকটি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহী। কিছুদিন আগেও বিদেশে গিয়ে আমরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানাতে ভয় পেতাম। কারণ, বিদ্যুৎ ছিল না। জমিও পাওয়া কঠিন ছিল। নিজেরাই কারখানা নির্মাণ করতে পারছিলাম না। সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। ফলে দেশকে ব্র্যান্ডিং করার সময় এসেছে। আবার আমাদের বেশ কিছু বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান হয়েছে, যারা কিনা নিজেরাই বিদেশে বিনিয়োগ করার সক্ষমতা রাখে। সব মিলিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করাই হবে আমাদের সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য।

প্রশ্ন

একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণে এফবিসিসিআইকে বিশেষ গুরুত্ব দিত সরকার। এর একটি কারণ ছিল, সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচিত হতো সাধারণ সদস্যদের ভোটে। বর্তমানে নেতৃত্ব নির্বাচনে ভোটের চেয়ে সমঝোতা বেশি হচ্ছে। তাতে সরকারদলীয় ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পদে বসছেন। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

জসিম উদ্দিন: এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনে একসময় প্রক্সি পদ্ধতি ছিল। একজনের ভোট আরেকজন দিত। ১৯৯৪ সালে সালমান এফ রহমান সরাসরি সাধারণ পরিষদের ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে নির্বাচনের পদ্ধতিটা কিছুটা বদলানো হলো। সাধারণ পরিষদের সদস্যরা ভোট দিয়ে পরিচালকদের নির্বাচিত করেন। সেই পরিচালকদের ভোটে নির্বাচিত হতেন সভাপতি ও সহসভাপতিরা। পরবর্তী সময়ে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাণিজ্যমন্ত্রী থাকার সময় (২০০১-০৪ সাল) নিয়মকানুনে পরিবর্তন আনা হলো। অনেক বড় বড় বাণিজ্য সংগঠন ও চেম্বারের নেতারা সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পরিচালনা পর্ষদে যেতে পারেন না—এমন যুক্তিতে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করতে মনোনয়নব্যবস্থা চালু হলো। তখন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, ঢাকা চেম্বার, মেট্রোপলিটন চেম্বারসহ আটটি বাণিজ্য সংগঠনের নেতাদের এফবিসিসিআইয়ের পর্ষদে নিয়ে আসা হয়। বাকিরা নির্বাচন করে পর্ষদে এলেন।

এভাবেই শুরু হলো বৈষম্য। প্রতিবছরই দেখা গেল, একজন, দুজন করে মনোনীত পরিচালকের সংখ্যা বাড়ছে। ২০০৮ সালে আনিসুল হক (ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র) সভাপতি থাকার সময় এফবিসিসিআইয়ের পর্ষদ ছিল ৩৮ জনের। বর্তমানে তা বেড়ে ৮০ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৩৪ জন মনোনয়নের মাধ্যমে এসেছেন। সমস্যা যেটি হয়েছে, কেউ ভোট করে আর কেউ ভোট না করে একই পরিচালনা পর্ষদে বসছেন। এটা বিশাল একটা বৈষম্য। আবার এই সুযোগের অপব্যবহারও হচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে এফবিসিসিআইয়ের অন্তর্ভুক্ত আছে ৪১২টি বাণিজ্য সংগঠন। আমাদের তো এতগুলো খাতই নেই। অথচ একটি খাতের একটি বাণিজ্য সংগঠন হওয়ার কথা ছিল। তার মানে আমাদের সাধারণ পরিষদে অসামঞ্জস্যতা আছে। এই সাধারণ পরিষদ দিয়ে কীভাবে আপনি সঠিক নেতা নির্বাচন করবেন।

তারপরও আমি মনে করি, সংগঠনে নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক অধিকার থাকা উচিত। অর্ধেকের বেশি নির্বাচন করে পর্ষদে আসছেন। যাঁরা নির্বাচন করে আসেন, তাঁরা মনোনীত ব্যক্তিদের ঠাট্টা করে বলেন ‘অটো ডিরেক্টর’। এই জায়গায় পরিবর্তন দরকার। সবার জন্য সমান নিয়ম হওয়া উচিত। বর্তমানে ৮০ জনের পরিচালনা পর্ষদ। ২১ মাস দায়িত্ব পালন করলাম অথচ পর্ষদ সভায় অর্ধেক পরিচালককেও পাইনি।  তাহলে এত বড় পর্ষদের কী দরকার। আমার মনে হয়, দুনিয়ার কোনো ফেডারেশনে এত বড় পর্ষদ নেই। এফবিসিসিআইয়ের পরিচালনায় শৃঙ্খলা আনা দরকার। সে জন্য সংস্কার আনতে হবে।

দেশে দুই কোটির ওপর বাড়ির মালিক রয়েছেন। তাঁদের তালিকা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে রয়েছে। তারপরও দেশে কর দিচ্ছেন মাত্র ২১ দশমিক ২৪ লাখ মানুষ। এই বাড়ির মালিকদের একবার ধরেন না, তাহলে তো চাপটা কমে। 
মো. জসিম উদ্দিন, সভাপতি, এফবিসিসিআই 
প্রশ্ন

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটছে। ব্যাংক খাতে কীভাবে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব?

জসিম উদ্দিন: আমি একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান। সেই হিসেবে আমি ব্যাংকার। তবে আমার বড় পরিচয়, আমি একজন ব্যবসায়ী। ছোট থেকে বড় হয়েছি। ব্যাংক সাহায্য করলে ছোট ব্যবসায়ীও বড় হতে পারে। আমাদের দেশে দুটি সমস্যা। এক. একবার বিপদে পড়লে বের হওয়ার পথ থাকে না। ওয়ানওয়ে ট্রাফিকের মতো। দুই. বিপদে পড়লে কেউ কেউ বের হতে চান না। এখন আমাদের উচিত, কারা প্রকৃত আর কারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি, সেটি খুঁজে বের করা। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির নাটক বন্ধ করা দরকার। দেশের চেয়ে ব্যক্তি বড় হতে পারে না। এখন ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে। কারণ, ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির পথে বাংলাদেশ। আমাদের কমপ্লায়েন্ট হতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের আগে এসব দেখতে চাইবে। আমাদের এখন ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

প্রশ্ন

সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচার নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। কেন অর্থ পাচার বন্ধ হচ্ছে না?

জসিম উদ্দিন: বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অর্থ পাচারের তথ্য-উপাত্ত তাদের কাছে রয়েছে। যদি তথ্য-উপাত্ত থাকে, তাহলে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে চলে যাওয়া উচিত। পাচারকারীদের তথ্য-উপাত্ত থাকলে শাস্তি দিতে অসুবিধা কোথায়? ৩ জনকে শাস্তি দিলে বাকি ১০ জন সোজা হয়ে যাবে।

প্রশ্ন

এক বছর ধরে ডলার-সংকটে ভুগছে দেশ। তাতে কাঁচামাল কিংবা পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খুলতে সমস্যায় পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। এই সংকট থেকে বের হওয়ার উপায় কী?

জসিম উদ্দিন: আমাদের ডলার খরচের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পে ৫০ বিলিয়ন ডলার আছে। সেসব প্রকল্প যদি দ্রুত করা যায়, তাহলে ডলার আসবে। তা ছাড়া অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বন্ধ করতে হবে। রোজার খেজুরে ইতিমধ্যে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি আমদানি হয়ে গেছে। আমাদের ঠিক করতে হবে, খেজুর আনব নাকি সয়াবিন তেল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল ও শিল্পের কাঁচামাল আনতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তা ছাড়া আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

প্রশ্ন

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কার্যক্রম নিয়ে ব্যবসায়ীদের অনেক অভিযোগ। আপনিও বিভিন্ন সময় এনবিআরের সংস্কারের কথা বলেছেন। সংস্কার কেন হচ্ছে না?

জসিম উদ্দিন: ৫০ বছর আগের এনবিআর দিয়ে এখন আর চলবে না। আমরা ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির পথে রয়েছি। তাই এখন স্মার্ট এনবিআর দরকার। নতুন ভবনে যাওয়া মানেই কিন্তু স্মার্ট এনবিআর নয়। ডিজিটালাইজেশনে যেতে হবে। অ্যানালগ ব্যবস্থা বাদ দিতে হবে। তা না হলে পুরোপুরি ডিজিটালাইজেশন হবে না। কারণ, কিছু লোক আছে যারা কিনা এটিকে ব্যর্থ করার জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকে। আরেকটা বিষয় হলো এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। নীতি প্রণয়ন আর বাস্তবায়নকে আলাদা করতে হবে। ২০০৮ সালে এমন একটি এসআরও হয়েছিল। একটা গ্রুপ সেটিকে কার্যকর হতে দেয়নি। সুতরাং এখানে আরও কাজ করতে হবে। এনবিআরের প্রধান কাজ রাজস্ব আহরণ। শিল্পায়নের জন্যও তাদের কাজ করতে হবে। পাশাপাশি রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগও লাগবে। তার মানে এই নয় যে সামনে যাঁকে পাবেন, তাঁকেই চুষে খাবেন। দেশে দুই কোটির ওপর বাড়ির মালিক রয়েছেন। তাঁদের তালিকা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে রয়েছে। তারপরও দেশে কর দিচ্ছেন মাত্র ২১ দশমিক ২৪ লাখ মানুষ। এই বাড়ির মালিকদের একবার ধরেন না, তাহলে তো চাপটা কমে। বৃহৎ করদাতা ইউনিটের করদাতারা তো ৫০ শতাংশ কর দিচ্ছেন। তাঁদের কেন ডিস্টার্ব করছেন। তাঁদের সহায়তা করেন। কর আদায়ের জন্য নতুন নতুন জায়গায় যান। সহজে কর আদায়ের পথে হাঁটলে আর চলবে না।

প্রশ্ন

সামনে জাতীয় নির্বাচন। রাজনীতিতে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আপনাদের প্রত্যাশা কী?

জসিম উদ্দিন: স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৯০ বিলিয়ন ডলার। তার পরের ১৪ বছরে তা বেড়ে ৪৬৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ফলে আমরা দেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা চাই। আগের মতো হরতাল বা জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি চাই না। আমাদের প্রত্যাশা, সামনের দিনের রাজনীতি হতে হবে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল। ক্ষমতা পরিবর্তিত হবে ভোটের মাধ্যমে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে চায়। নীতিসহায়তা চায়। আগামী দিনে আমাদের অর্থনৈতিকভাবে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। সেখানে হরতাল, জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতির কোনো সুযোগ নেই।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

জসিম উদ্দিন: আপনাকেও ধন্যবাদ।