বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক

এসএমই খাতে ঋণ কমছে

গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পালাবদলের পর বৃহৎ ব্যবসার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের ব্যবসাও ছোট হয়ে আসছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোর কটেজ, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের ঋণ বিতরণ কমে গেছে। গত জুন শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৭ শতাংশ ছিল সিএমএসএমই খাতের। গত দুই বছরের মধ্যে যা সবচেয়ে কম। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের এক সভায় এ খাতে ঋণ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ঋণ কমে যাওয়ায় সম্প্রতি সিএমএসএমই খাতে ঋণ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে এই খাতের ঋণ বিতরণ বাড়াতে নতুন করে কিছু ছাড়ও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সিএমএসএমই ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশনিং) সংরক্ষণের হার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ সিএমএসএমই ঋণে আগের চেয়ে আরও কম নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে। ফলে ব্যাংকগুলো এই খাতে ঋণ দিতে আগ্রহী হবে বলে আশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ব্যাংকগুলোকে স্ট্যান্ডার্ড ও স্পেশাল মেনশন হিসেবে (এসএমএ) থাকা বকেয়া ঋণের বিপরীতে যথাক্রমে ১ ও ৫ শতাংশ হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সিএমএসএমই খাতের আওতায় সব অশ্রেণিকৃত (স্ট্যান্ডার্ড ও এসএমএ) স্বল্পমেয়াদি কৃষিঋণ এবং সিএমএসএমই শিল্প উদ্যোগের ঋণের বিপরীতে ১ শতাংশের পরিবর্তে দশমিক ৫০ শতাংশ হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে পারবে।

জানা গেছে, চলতি বছরের মধ্যে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের অন্তত ২৫ শতাংশ কটেজ, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প খাতে বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ২০২৯ সালের মধ্যে তা বাড়িয়ে মোট ঋণের ২৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সিএমএসএমই খাতের ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ২০২৪ সাল শেষে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৪০ শতাংশ ছিল সিএমএসএমই খাতে। ২০২৩ সালে এই হার ছিল ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ। ফলে সিএমএসএমই খাতে ঋণ ধীরে ধীরে কমছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণের চাহিদা বেশ কমে গেছে। এরপরও আমরা ঋণ বাড়াতে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা খুঁজছি। আশা করছি, সামনের বছর সব ধরনের ঋণে ভালো প্রবৃদ্ধি হবে।
—সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, এমডি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক

এদিকে মোট সিএমএসএমই ঋণের অন্তত ৪০ শতাংশ উৎপাদন উপখাতে বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। গত জুন পর্যন্ত সিএমএসএমই খাতের ঋণের মধ্যে উৎপাদন উপখাতে বিতরণ করা হয়েছিল ৩৬ শতাংশ। সেবা উপখাতে ২০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিতরণ করা হয়েছে ১৯ শতাংশ। আর ট্রেড বা ব্যবসা উপখাতে ৪০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিতরণ করা হয়েছে ৪৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যাওয়ায় সিএমএসএমই খাতের প্রতিটি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ঋণসীমা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কুটির উদ্যোগে সর্বোচ্চ ২০ লাখ, মাইক্রো উদ্যোগে ২ কোটি, ক্ষুদ্র উদ্যোগে ২৫ কোটি ও মাঝারি উদ্যোগে ১০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ আগে থেকে এসএমই ঋণ বাড়াতে নানা চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এরই অংশ হিসেবে চলতি বছর এক নির্দেশনায় বিনা জামানতে নারী উদ্যোক্তাদের ২৫ লাখ টাকা ও অন্য উদ্যোক্তাদের ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। আবার করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেই, এমন উদ্যোক্তাও অন্য ব্যবসাসংক্রান্ত সনদ দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত এসএমই ঋণ নিতে পারেন। এরপরও ব্যাংকগুলো সিএমএসএমই ঋণের চেয়ে করপোরেট ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী বলে জানান খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কারণ হিসেবে তাঁরা জানান, সিএমএমইএ খাতে ঋণ বিতরণের চেয়ে করপোরেট ঋণ বিতরণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক বেশি লাভজনক।

এ ছাড়া ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের আগস্টের পর ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বদলে গেছে। এর মধ্যে পাঁচটি ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। তাতে এসব ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ কিছু ব্যাংক আমানতকারীদের চাপ মোকাবিলা করতেই হিমশিম খাচ্ছে। আবার সংকটে থাকা পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সব মিলিয়ে তাই সার্বিকভাবে ঋণ বিতরণ কমে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে সিএমএসএমই খাতেও। এ ছাড়া রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ঋণের চাহিদাও কমেছে। অনেক ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা রাজনৈতিক কারণে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের মধ্যে সিএমএসএমই ঋণের অংশ কমে জুন শেষে ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশে নেমেছে, ২০২৪ সাল শেষে যার হার ছিল ১৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ। একইভাবে এই খাতে বিদেশি ব্যাংকগুলোর ঋণ ৯ দশমিক ২৫ থেকে কমে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশে নেমেছে। আর এই খাতে বেসরকারি ব্যাংকের ঋণের হার ১৯ দশমিক ১২ থেকে নেমেছে ১৭ দশমিক ৬৮ শতাংশে। ইসলামী ব্যাংকগুলোর এ খাতে ঋণ ১৮ দশমিক ১৪ থেকে কমে ১৬ দশমিক ১১ শতাংশে নেমেছে। তবে সিএমএসএমই খাতে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণ আগের বছরের ১৭ দশমিক ৬৯ থেকে বেড়ে ২১ দশমিক ৫৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণের চাহিদা বেশ কমে গেছে। এরপরও আমরা ঋণ বাড়াতে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা খুঁজছি। আশা করছি, সামনের বছর সব ধরনের ঋণে ভালো প্রবৃদ্ধি হবে।’