দেশে মার্কিন ডলারের সংকট শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালের শুরু থেকে আমদানি নিরুৎসাহিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পণ্য আমদানিতে শতভাগ পর্যন্ত মার্জিন আরোপ ও শুল্ক বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাংকঋণ বন্ধ করা হয়। মার্জিন বন্ধ করে দেওয়ার ফলে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হওয়ার কথা, তার সমপরিমাণ টাকা নিজ উৎস থেকে ব্যাংকে জমা দিতে হয়। এতে আমদানি কমে যায়।
গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ডলার-সংকট কাটাতে মুদ্রাটির দাম বাজারভিত্তিক করা হয়। সেই সঙ্গে আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে সংকট কেটে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত বাড়তে শুরু করে। আবার ডলারের দামও কমে আসে। তবে কিছু পণ্যে এখনো আমদানি বিধিনিষেধ বহাল আছে।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে হলে আমদানি বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ জন্য সব বিধিনিষেধ তুলে দিতে হবে, যা দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের একটি বার্তা দেবে। এতে ব্যবসায়ীরা নতুন করে বিনিয়োগের পাশাপাশি ব্যবসা সম্প্রসারণের ঘোষণা দিতে পারেন, যা অর্থনীতিকে চাঙা করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
২০২২ সালের শুরুর দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ভোগ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের দাম এবং পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। এতে ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ছিল ৬৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে। বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কিছু পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক বসায়। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি কমে হয় ৭৫ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরও কমে ৬৬ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারে নামে। বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে আমদানিতে খরচ হয় ৬৩ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার।
ডলার-সংকট আপাতত কেটে গেছে। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া একটা ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এখন আমদানিতে আরোপিত সব বিধিনিষেধ তুলে দিলে অর্থনীতি গতি পাবে। এতে সংকট কেটে যাওয়ার বার্তা যাবে। ফলে দেশের অর্থনীতির ওপর আস্থা বাড়াবে। এ ছাড়া ডলারের বাজার কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটিও দেখা যাবে।—সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, এবিবি ও এমডি, এমটিবি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করায় ডলারের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়, যা সংকট কাটাতে ভূমিকা রেখেছে। বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশ থেকে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অর্থবছরে প্রবাসী আয় আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার বা ২৭ শতাংশ বেড়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছে ৩০ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে বিদায়ী অর্থবছরে পণ্য রপ্তানিতে সাড়ে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪৪ দশমিক ৪৭ ডলার।
রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে ডলার-সংকট কেটে যাচ্ছে। বদৌলতে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত বাড়ছে। পাশাপাশি দেশের লেনদেনের ভারসাম্যের চিত্রও বদলে গেছে। চলতি হিসাবে আগে বড় ধরনের যে ঘাটতি ছিল, তা অনেকটাই কমেছে। এটি বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বস্তি এনে দিচ্ছে। এ ছাড়া ডলারের বাজার স্থিতিশীল হওয়ায় আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি আটকে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশের মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করার পর থেকে ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক চর্চা মেনে নিজেদের মধ্যে নিয়মিত ডলার বেচাকেনা করছে। ফলে দীর্ঘদিন পর মুদ্রাবাজারে স্বস্তি ফিরেছে। প্রবাসী আয়ের ডলার কেনায় ব্যাংকগুলো এখন বেশ সংযত। অর্থাৎ তারা কম দামে প্রবাসী আয় কিনছে। এর ফলে ব্যবসায়ীরাও আগের চেয়ে কম দামে ডলার পাচ্ছেন। আর উদ্বৃত্ত ডলার নিলামের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক কিনে নিচ্ছে। এভাবে ডলারের দামে অস্বাভাবিক ওঠানামা ঠেকানো যাচ্ছে। ব্যাংকে এখন ডলার ১২২ টাকার মধ্যে কেনাবেচা হচ্ছে।
বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, মুদ্রাবাজারে ডলার সরবরাহে স্বস্তি ফিরে আসায় এখন আমদানি বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া উচিত। পাশাপাশি বিলাসপণ্য আমদানিতেও যেসব বাড়তি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোও তুলে নিতে হবে। তাহলে আমদানি বাড়বে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরবে।
প্রায় তিন বছর টানা ডলার-সংকট থাকার কারণে এখনো আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ব্যাপারে সতর্ক ব্যাংকগুলো। সে জন্য অনেক ব্যবসায়ীকে এলসি খোলার জন্য নানা পর্যায়ে যোগাযোগ করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এখনো সব শর্ত প্রত্যাহার করেনি। এ ছাড়া এনবিআরের আরোপিত বাড়তি শুল্কও বহাল রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এখনো মোটরকার, ইলেকট্রনিকস হোম বা অফিস অ্যাপ্লায়েন্স, স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকার, মূল্যবান ধাতু ও মুক্তা, তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্য, আসবাব ও সাজসজ্জার সামগ্রী, ফল ও ফুল, নন-সেরিয়াল ফুড অর্থাৎ অ-শস্য খাদ্যপণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় বা টিনজাত (ক্যান) খাদ্য, চকলেট, বিস্কুট, জুস, কফি, সফট ড্রিংকস, অ্যালকোহল-জাতীয় পানীয় এবং তামাক ও তামাকজাত বা এর বিকল্প পণ্য আমদানিতে শতভাগ নগদ মার্জিন দিতে হচ্ছে। এ তালিকায় আরও পণ্য রয়েছে। এসব পণ্য আমদানিতে ব্যাংকঋণও বন্ধ আছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ডলার-সংকট আপাতত কেটে গেছে। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া একটা ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এখন আমদানিতে আরোপিত সব বিধিনিষেধ তুলে দিলে অর্থনীতি গতি পাবে। এতে সংকট কেটে যাওয়ার বার্তা যাবে। ফলে দেশের অর্থনীতির ওপর আস্থা বাড়াবে। এ ছাড়া ডলারের বাজার কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটিও দেখা যাবে।