গত আট বছরে ব্যাংকটির আমানত ও ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এ সময়ে নিট মুনাফা বেড়ে তিন গুণের বেশি হয়েছে। এ ব্যাংকের জনবলের ২৩ শতাংশ নারী। অর্থায়নে টেকসই ব্যাংকিংয়ে বেশি নজর দেওয়ায় ব্যাংকটি পরপর দুই বছর টেকসই ব্যাংকিংয়ের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

দেশের কয়েকজন ব্যবসায়ীর উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে বেসরকারি খাতের প্রাইম ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। ব্যাংকটির উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন ইস্ট কোস্ট গ্রুপ, বাংলা ট্র্যাক গ্রুপ, পলমল গ্রুপ, আমিন জুয়েলার্স, পেডরোলো পাম্পের কর্ণধারসহ অনেকে। শুরু থেকে দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যাংকটি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা অনুসরণ শুরু করে। ক্যামেলস রেটিংয়েও একবার শীর্ষ ব্যাংকের মর্যাদা পায় এটি। মাঝখানে কিছু সমস্যার মধ্যে পড়লেও আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। এখন ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা যায়।
ব্যাংকিংয়ে নতুন পণ্য-সেবা চালু ও সেবার মানে পারদর্শিতা দেখিয়ে আসছে প্রাইম ব্যাংক। যেমন গত ৩০ বছরে ব্যাংকটির গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখে। গত আট বছরে আমানত ও ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এ সময়ে নিট মুনাফা বেড়ে তিন গুণের বেশি হয়েছে।
বর্তমানে ব্যাংকটির কর্মকর্তা ২ হাজার ৯০০ জন, এর মধ্যে ২৩ শতাংশ নারী। অনেক বিভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারী কর্মকর্তারা। সূত্র জানায়, নারী কর্মীর এ হার দেশের ব্যাংক খাতে সর্বোচ্চ। এ ছাড়া অর্থায়নে টেকসই ব্যাংকিংয়ে অধিক নজর দেওয়ার ফলে পরপর দুই বছর টেকসই ব্যাংকিংয়ের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে প্রাইম ব্যাংক। এসবের মাধ্যমে এ ব্যাংক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পথে এগিয়ে চলেছে। ব্যাংকটির আর্থিক তথ্য পর্যালোচনায় এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে প্রাইম ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, (সিইও) হাসান ও. রশীদ প্রথম আলোকে লিখিতভাবে জানান, ‘আর্থিক সংকটের সময় প্রাইম ব্যাংকের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারার কারণ হলো শক্তিশালী ভিত্তি, করপোরেট সুশাসন ও গ্রাহককেন্দ্রিক সেবা। এ ক্ষেত্রে কখনো ব্যত্যয় হয় না। বাজারের পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়া, ডিজিটাল পরিবর্তন গ্রহণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়ার ফলে প্রাইম ব্যাংক কেবল সংকট মোকাবিলা করতে পেরেছে তা নয়, বরং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নেতৃত্বও দিতে পারছে। প্রাইম ব্যাংকের ভিত্তি হচ্ছে সততা, উদ্ভাবন ও অন্তর্ভুক্তি।’
হাসান ও. রশীদ আরও বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য কেবল আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং অগ্রগতির প্রভাবক হিসেবে কাজ করা। মানুষকে ব্যক্তিগত আর্থিক লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা প্রদান; বড়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের এবং বড় ধরনের জাতীয় প্রকল্পে অর্থায়ন যা-ই হোক না কেন, আমরা সব সময় মানুষের ব্যাংক হওয়ার চেষ্টা করেছি।’
একনজরে প্রাইম ব্যাংক
১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করে প্রাইম ব্যাংক। ২০০৮ সালে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৮ হাজার ৮০২ কোটি টাকা, যা বেড়ে ২০১৬ সালে ১৯ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ও ২০২৪ সালের শেষে ৩৫ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকায় ওঠে। এতে দেখা যায়, প্রথম ২১ বছরে ব্যাংকটির আমানত যত হয়েছিল, তার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে পরের ৯ বছরে।
ঋণ বিতরণও বেড়েছে সমানতালে। ২০০৮ সালে ব্যাংকটির দেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা বেড়ে ২০১৬ সালে ১৭ হাজার ২১ কোটি টাকা ও ২০২৪ সালে ৩৪ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
এ ব্যাংক ২০০৮ সালে মুনাফা করেছিল ১২৩ কোটি টাকা, যা ২০১১ সালে ৩৬৩ কোটি টাকায় ওঠে। তবে বড় কিছু ঋণ খারাপ হওয়ায় ব্যাংকটির মুনাফায় বড় ধাক্কা খায়। ফলে ২০১৩ সালে মুনাফা কমে ১৮২ কোটি টাকায় নামে। তা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ ব্যাংক নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নেয়। তাতে ২০১৬ সালে মুনাফা আবার বেড়ে দাঁড়ায় ২৩৪ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালে আরও বেড়ে হয় ৭৪৫ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে মুনাফা হয়েছিল ৪৮৩ কোটি টাকা।
বাজারের পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়া, ডিজিটাল পরিবর্তন গ্রহণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়ার ফলে প্রাইম ব্যাংক কেবল সংকট মোকাবিলা করতে পেরেছে তা নয়, বরং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নেতৃত্বও দিতে পারছে।হাসান ও. রশীদ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রাইম ব্যাংক
গত বছর ব্যাংকটির সম্পদ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। প্রতিটি শেয়ারের সম্পদমূল্য দাঁড়ায় ৩৪ টাকা ও শেয়ারপ্রতি আয় হয় ৬ টাকা ৫৮ পয়সা। এ ছাড়া মূলধনের বিপরীতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের হার দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
বর্তমানে দেশজুড়ে প্রাইম ব্যাংকের ১৪৭টি শাখা, ১৫৮টি এটিএম বুথ ও ১৫২টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট রয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যে ব্যাংকটি বেশ এগিয়েছে। যেমন ৬৪ দেশের ৩০৫টি ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকটির বৈদেশিক সম্পর্ক চুক্তি রয়েছে। অনলাইনে লেনদেনে ব্যাংকটির আছে নিজস্ব অ্যাপ মাই প্রাইম। এতে নিবন্ধিত গ্রাহক এখন আড়াই লাখ, বছরে লেনদেন হয় ৬০ লাখ বার। ব্যাংকটির রয়েছে ইসলামিক ব্যাংকিং সেবা হাসানাহ। এর আওতায় আমানত পাঁচ হাজার কোটি টাকা ও বিনিয়োগ সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ব্যাংকটির ডেবিট কার্ড ৪ লাখের বেশি ও ক্রেডিট কার্ড প্রায় ৫০ হাজার।
সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের (সিএসআর) অর্থ ব্যবহারেও প্রাইম ব্যাংক বৈচিত্র্য দেখিয়েছে। ব্যাংকটির রয়েছে নিজস্ব চক্ষু হাসপাতাল, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও নার্সিং কলেজ। ২০০৭ সাল থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিয়ে আসছে ব্যাংকটি। এ পর্যন্ত ৪ হাজার ৪৭৬ শিক্ষার্থীকে ৪৪ কোটি টাকা বৃত্তি দেওয়া হয়েছে।
গ্রাহক শীর্ষ করপোরেটরা
প্রাইম ব্যাংকের দেওয়া ঋণের বড় অংশই গেছে করপোরেটদের কাছে। ব্যাংকটির ঋণের প্রায় ৬৫ শতাংশ পেয়েছে বড় শিল্প গ্রুপগুলো। যাদের বড় উৎস উৎপাদন খাতের সঙ্গে যুক্ত। ১৫ শতাংশ ঋণ ভোক্তা ও এসএমই খাতে এবং ৯ শতাংশ সেবা খাতে। ব্যাংকটি এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে ঋণ বিতরণে জোর দিচ্ছে। পাশাপাশি ভোক্তা ঋণেও নজর বাড়াচ্ছে।
ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ভালো করপোরেটরা এ ব্যাংকের গ্রাহক, যা ব্যাংকটিকে স্বস্তি দিয়েছে। এই তালিকায় থাকা বড় গ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছে এসিআই, অনন্ত অ্যাপারেল, অনন্ত কোম্পানিজ, আবুল খায়ের, আকিজ, এলায়েন্স, বাদশা, বিএসআরএম, বিটপি, ব্র্যাক অ্যান্ড আজিয়াটা, সিটি, কনফিডেন্স, সিপিসিএল, ডিবিএল, এফজিএস, জিএমএস, গ্রামীণফোন, হেলথকেয়ার, ইন্টারস্টফ, কেডিএস, কবির, মেঘনা, মনিকা, মীর, নিউ এশিয়া, নিউএজ, এনডিই, পপুলার, প্রাণ-আরএফএল, রেনেসাঁ, রেনেটা, জেভি অব সমুদা অ্যান্ড সিকম, স্কয়ার, শান্তা, স্ট্যান্ডার্ড, সামটি, সিঙ্গার, ট্রান্সকম, ইউনাইটেড, ভিয়ন, ইয়ুথ, ওয়ালটন, এক্স ইনডেক্স ও ভিয়েলাটেক্স। এর ফলে ভালো গ্রাহকে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে প্রাইম ব্যাংক।
নতুন সেবার পথিকৃৎ প্রাইম ব্যাংক
দেশের ব্যাংক খাতের অনেক সেবাই প্রথম চালু করে প্রাইম ব্যাংক। ফলে অন্যদের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে উঠে ব্যাংকটি। যেমন প্রচলিত ধারার ব্যাংকিংয়ে প্রথম ইসলামি ব্যাংকিং শাখা চালু করে এ ব্যাংক। প্রথম অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট এবং এসএমই সেন্টার চালু করে ব্যাংকটি। দেশের প্রথম আন্তব্যাংক ব্লক চেইন ঋণপত্র (এলসি) খোলাও শুরু করে এ ব্যাংক। প্রথম বিজনেস ওয়ার্ল্ড মাস্টারকার্ড ক্রেডিট কার্ড, ইসলামিক ক্রেডিট কার্ড ও জেসিবি কার্ড চালু করে। পোশাকশ্রমিকদের জন্য প্রথম ডিজিটাল ঋণ ও সোফরভিত্তিক লেনদেন শুরু হয় প্রাইম ব্যাংকের মাধ্যমে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনেক নতুন সেবা প্রথম চালু করলেও আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের চর্চা করেনি প্রাইম ব্যাংক, যা প্রতিষ্ঠানটিকে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। গ্রাহকসেবার ক্ষেত্রেও পারদর্শিতা দেখিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটি। পরিচালকদের বেশির ভাগই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হওয়ায় তেমন হস্তক্ষেপ নেই। ফলে ব্যাংকটি সুশাসনে উত্তম চর্চা করতে পারে।
ব্যাংকটির এমডি হাসান ও. রশীদ প্রথম আলোকে লিখিতভাবে আরও বলেন, ‘উৎকর্ষের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ভবিষ্যতে আমরা আগের চেয়েও বেশি অঙ্গীকারবদ্ধ। দেশের মানুষ ও তাঁদের ভবিষ্যতের জন্য প্রাইম ব্যাংক গঠিত হয়েছিল। এই যাত্রার ধারাবাহিকতায় আমরা দেশের উন্নয়নে চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালনের অঙ্গীকার নবায়ন করছি। ব্যবসা-বাণিজ্যে সহায়তা করার পাশাপাশি তরুণ ও নারীদের ক্ষমতায়নে কাজ করব আমরা। সেই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব সমাধান ও টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং দায়িত্বশীল আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তোলায় মনোযোগী হব।’
“বাজারের পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়া, ডিজিটাল পরিবর্তন গ্রহণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়ার ফলে প্রাইম ব্যাংক কেবল সংকট মোকাবিলা করতে পেরেছে তা নয়, বরং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নেতৃত্বও দিতে পারছে।