বনানীর ইকবাল সেন্টার ছেড়ে যাচ্ছে প্রিমিয়ার ব্যাংক

ইকবাল সেন্টারে আড়াই দশক ধরে প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। ২২তলা ভবনের সিংহভাগ ফ্লোর নিয়েই প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে
ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের সাবেক চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবালের মালিকানাধীন ‘ইকবাল সেন্টার’ থেকে প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংকটির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ। অভিযোগ রয়েছে, নিজের ভবনের জায়গা নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংককে ভাড়া দিয়ে ভাড়া বাবদ বাজারের চেয়ে বেশি অর্থ নিচ্ছেন তিনি। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ ঘটনা ঘটে আসছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে টানা ২৬ বছর প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন এইচ বি এম ইকবাল। গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি প্রিমিয়ার ব্যাংক ছেড়ে দেন। এরপর গত আগস্টে ব্যাংকটিতে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পুনর্গঠিত পর্ষদ এখন ইকবাল সেন্টার থেকে প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ব্যাংকটি। এ ছাড়া এইচ বি এম ইকবালের সংশ্লিষ্টতা থাকায় ব্যাংকটির গুলশান ও বারিধারা শাখাও সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ফলে ব্যাংকটির ভবন ভাড়া খরচ অর্ধেকে নেমে আসবে বলে বর্তমান কর্তৃপক্ষ মনে করছে। এরই মধ্যে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় ও দুটি শাখার জন্য ভবনের খোঁজে আগ্রহপত্র আহ্বান করা হয়েছে। সেই আগ্রহপত্রের সূত্র ধরে এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

এদিকে প্রিমিয়ার ব্যাংকে এইচ বি এম ইকবালের একাধিক বেনামি ঋণের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা দুবাই ও মালয়েশিয়ায় পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বহুজাতিক একটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকটির সব ঋণ ও লেনদেন খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দিয়েছে নতুন পরিচালনা পর্ষদ।

এ বিষয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহুদিন পর আমি ব্যাংকে ফিরেছি। আমরা ব্যাংকটিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। এ জন্য কর্মপরিবেশ উন্নত করতে প্রধান কার্যালয়সহ একাধিক শাখা স্থানান্তর করা হবে। এসব ভবনের ভাড়া অনেক বেশি দিতে হচ্ছে। এর চেয়ে অর্ধেক বা আরও কম ভাড়ার ভবনে যাওয়ার চেষ্টা করছি।’

ভাড়ার নামে আর্থিক সুবিধা

রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে এইচ বি এম ইকবালের মালিকানাধীন ভবন ‘ইকবাল সেন্টার’। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের অনুমোদন দেয় প্রিমিয়ার ব্যাংকের, যার প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান হন ইকবাল। ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় খোলা হয় ইকবাল সেন্টারে। ২২তলা ইকবাল সেন্টারের সিংহভাগ ফ্লোর নিয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়।

প্রিমিয়ার ব্যাংক ছাড়া ইকবাল সেন্টারের অন্য তলাগুলোয় ইকবালের প্রিমিয়ার গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগপর্যন্ত তিনি নিয়মিত এই ভবনে অফিস করতেন।

ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ইকবাল সেন্টারের ভাড়া প্রতি তিন বছর পরপর বাড়ানো হয়। প্রিমিয়ার ব্যাংক ভবনটিতে প্রতি বর্গফুটের জন্য ৫০৬ টাকা করে ভাড়া দেয়। সব মিলিয়ে ব্যাংকটি ওই ভবনের ১ লাখ ২০ হাজার বর্গফুটের ভাড়া দিত। প্রতি মাসে ভাড়া বাবদ ব্যাংকটির খরচ ৬ কোটি টাকার বেশি।

একইভাবে ব্যাংকটির গুলশান শাখাটি অবস্থিত ইকবালের মালিকানাধীন রেনেসাঁ হোটেলে। এই হোটেলে ১০ হাজার ২০০ বর্গফুট জায়গা নিয়ে এই শাখার কার্যক্রম চলছে। এ জন্য ব্যাংকটিকে প্রতি বর্গফুটের জন্য ভাড়া দিতে হয় ১ হাজার ১৪৫ টাকা, যা ওই এলাকার অন্য যেকোনো ভবনের ভাড়ার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এ ছাড়া ব্যাংকটির বারিধারা শাখাটি ইকবালের বোন ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনের স্ত্রী মুনিরা হারুনের মালিকানাধীন ভবনে। বারিধারা শাখাটি ৫ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে। এই কার্যালয়ের জন্য প্রতি বর্গফুটের ভাড়া দিতে হচ্ছে ২৩৭ টাকা।

ব্যাংক–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিজের ভবনে অবস্থিত ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় ও একাধিক শাখার ভাড়া বাবদ এইচ বি এম ইকবাল ব্যাংকটি থেকে অগ্রিম প্রায় ৩০০ কোটি টাকা নিয়েছেন।

নতুন ভবনের খোঁজে ব্যাংক

সম্প্রতি ব্যাংক প্রধান কার্যালয় ও কয়েকটি শাখার জন্য ভবনের খোঁজে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এই বিজ্ঞপ্তিতে ব্যাংকটি প্রধান কার্যালয় ও কিছু শাখা কার্যালয়ের জন্য বাণিজ্যিক ভবন ভাড়া দিতে আগ্রহীদের কাছ থেকে প্রস্তাব আহ্বান করেছে। প্রধান কার্যালয়ের জন্য গুলশান, বনানী, বারিধারা, তেজগাঁও এলাকায় ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গার খোঁজ করা হচ্ছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধান কার্যালয়ের জন্য ৬ থেকে ১০ তলার মধ্যে জায়গা খুঁজছে ব্যাংকটি। আর শাখার জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে নিচতলা থেকে দ্বিতীয় তলার মধ্যে। ১৫ অক্টোবরের মধ্যে জায়গা ভাড়া দিতে আগ্রহীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করেছে ব্যাংকটি।

ব্যাংকটির একটি সূত্র জানায়, তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোডের শান্তা হোল্ডিংসের নির্মাণাধীন পিনাকেল টাওয়ারে ব্যাংকটি প্রধান কার্যালয় স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছে। ৪০ তলাবিশিষ্ট এই টাওয়ারে প্রতি বর্গফুটের জন্য ভাড়া দিতে হবে ১৬০ টাকা। সেটি হলে প্রধান কার্যালয়ের ভাড়া বাবদ খরচ অর্ধেক কমে আসবে। আগামী বছরের জুনের মধ্যে সেখানে কার্যালয় স্থানান্তর হতে চায় ব্যাংকটি।

এদিকে ব্যাংকটির বারিধারা শাখাটি প্রগতি সরণির একটি ভবনে নিতে চায় বর্তমান কর্তৃপক্ষ। সেখানে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া দিতে হবে ৬৫ টাকা।

সরকার বদলের পর ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবাল দেশের বাইরে রয়েছেন। নিজ ভবনে ব্যাংকের কার্যালয় ভাড়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে তাঁর সঙ্গে হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।