
দেশে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের এক-তৃতীয়াংশের বেশি বর্তমানে খেলাপি ঋণ। ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হওয়া এ খেলাপি ঋণের সংকট কাটিয়ে উঠতে অন্তত ৫ থেকে ১০ বছর সময় লাগবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, এটি (খেলাপি ঋণ) ছোটখাটো কোনো সমস্যা নয়। খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি পুরো আর্থিক খাতকে চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে।
আমদানির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ডলার রয়েছে। ফলে এ বছর রমজানে ঋণপত্র খোলা ও পণ্য আমদানি নিয়ে কোনো শঙ্কা দেখছি না: আহসান এইচ মনসুর, গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
আজ শনিবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত চতুর্থ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন-২০২৫ এর উদ্বোধনী অধিবেশনে এ কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। অর্থনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার শিরোনামে এ সম্মেলনের আয়োজক বাংলা দৈনিক বণিক বার্তা।
উদ্বোধনী অধিবেশনে আরও অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক এ কে এনামুল হক, হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ, বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সভাপতি ও জিপিএইচ গ্রুপের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম এবং সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাসরুর আরেফিন।
বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির যে চিত্র উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক: এ কে আজাদ, চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হা-মীম গ্রুপ
দেশের খেলাপি ঋণ বাড়ছে জানিয়ে অনুষ্ঠানে গভর্নর বলেন, ‘প্রতি প্রান্তিকে যখন নতুন তথ্য পাই, খেলাপি ঋণের নতুন নিয়ম কার্যকর হয়। তখনই দেখা যাচ্ছে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। দুই বছর আগে আমার ধারণা ছিল ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ২৫ শতাংশের মতো হবে। তখন সরকার বলেছিল তা ৮ শতাংশ। এখন দেখছি এটি ইতিমধ্যে ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে।’
গভর্নর মনে করেন, এ পরিস্থিতি রাতারাতি সমাধান সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে বহুদিন এই সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। ধাপে ধাপে এগোতে হবে। পুরোপুরি উত্তরণে অন্তত ৫ থেকে ১০ বছর সময় লাগবে।’
দেশের করব্যবস্থা আজও ‘জমিদারি ব্যবস্থার’ মতো আচরণ করে। ব্রিটিশ শাসনে জমিদারের কাজ ছিল কর আদায়। দেশের উন্নতির দায়িত্ব তাদের ছিল না: এ কে এনামুল হক, মহাপরিচালক, বিআইডিএস
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আমদানির ঋণপত্র খোলার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ডলার রয়েছে। ফলে এ বছর রমজানে ঋণপত্র খোলা ও পণ্য আমদানি নিয়ে কোনো শঙ্কা দেখছি না।’ ইতিমধ্যে গত বছরের এ সময়ের তুলনায় ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি ঋণপত্র খোলা হয়েছে বলে জানান তিনি।
বিআইডিএস মহাপরিচালক এ কে এনামুল হক বলেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অনেকটাই ‘চোর ধরা’ মনোভাবভিত্তিক। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়। একটি অর্থনীতি যদি আস্থানির্ভর না হয়, তাহলে ব্যবসা বা বিনিয়োগ কিছুই আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগোতে পারে না। আস্থা ছাড়া অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন।’
এনামুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রম করার মতো দায়বদ্ধতার কাঠামো নেই। দেশের করব্যবস্থা আজও “জমিদারি ব্যবস্থার” মতো আচরণ করে। ব্রিটিশ শাসনে জমিদারের কাজ ছিল কর আদায়। দেশের উন্নতির দায়িত্ব তাদের ছিল না। আজকের কর সংগ্রহেও একই মানসিকতা দেখা যায়—যেন দেশের উন্নতি নয়, শুধু কর আদায়ই মূল লক্ষ্য।
দেশের ব্যাংকগুলোতে এখন সুশাসন ও শৃঙ্খলা ফিরে আসছে। আগে বোর্ডরুমে বসে ঋণ বিক্রি করা হতো: মাসরুর আরেফিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিটি ব্যাংক
বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির যে চিত্র উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সূচকে আমরা ক্রমেই নিচের দিকে নামছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মুদ্রানীতির কারণে সুদের হার বেড়ে গেছে। এটি বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আমরা প্রাইভেট সেক্টর মাত্র ৬ শতাংশ ঋণ পাচ্ছি। এ অবস্থায় শিল্পায়ন পুরোপুরি স্থবির বলা যায়।’
বিএসএমএ সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, একটি কোম্পানি লাভ করুক বা লোকসান করুক, তাকে কর দিতে হচ্ছে। পৃথিবীর কোথাও এভাবে লোকসানেও কর দিতে হয় কি না জানা নেই।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, দেশের ব্যাংকগুলোতে এখন সুশাসন ও শৃঙ্খলা ফিরে আসছে। আগে বোর্ডরুমে বসে ঋণ বিক্রি করা হতো। এখন নিয়ম অনুসারে অনুমোদন হচ্ছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কম আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা সংগত কারণেই হয়তো সময় নিচ্ছেন। জাতীয় নির্বাচনের পরে বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নত হবে বলে জানান তিনি।