সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ এখন খেলাপি হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত দলটির শীর্ষ নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ঋণ অনিয়মিত হয়ে পড়ায় এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। গত মার্চের শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় চার ভাগের এক ভাগই ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন মাসের ব্যবধানে বা ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে খেলাপি ঋণ বেড়েছে পৌনে এক লাখ কোটি টাকা। আর এক বছরের হিসাবে বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা মার্চের শেষে বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল রোববার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের তথ্য তুলে ধরে। এর আগে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছিল ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। গত বছরের শেষ ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাবে দেখা যায়, ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিয়মের বাইরে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো খেলাপি হয়ে পড়ছে। আমরা তখন জানতাম, একদিন ব্যাংক খাতে খারাপ পরিস্থিতি আসবে। এখন সেই দিন এসেছে, সব প্রকৃত তথ্য বের হয়ে আসছে।আনিস এ খান, সাবেক চেয়ারম্যান, এবিবি
এ নিয়ে জানতে চাইলে ব্যাংক খাতের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিয়মের বাইরে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছিল সেগুলো খেলাপি হয়ে পড়ছে। আমরা তখন জানতাম, একদিন ব্যাংক খাতে খারাপ পরিস্থিতি আসবে। এখন সেই দিন এসেছে, সব প্রকৃত তথ্য বের হয়ে আসছে। এর মধ্যে যাঁরা ভালো ব্যবসায়ী তাঁদের সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। না হলে পুরো অর্থনীতি খারাপ হয়ে পড়বে।’
আনিস এ খান আরও বলেন, ‘সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন হচ্ছে, তারা এসব ঋণ কিনে নিতে পারে। এতে ধীরে ধীরে কমে আসবে খেলাপি ঋণ। আওয়ামী লীগের শেষ মেয়াদে যেভাবে ব্যাংক খাত চলেছে, তেমন দিন যেন আর ফিরে না আসে, সেই উদ্যোগ নিতে হবে। সবাইকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, কেউ যেন ব্যাংক খাতে আর হাত না দেয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। আবার ঋণখেলাপির নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেসব ঋণ নবায়ন করা হয় তার অনেকগুলো আদায় হচ্ছে না। অনিয়মের কারণে অনেক ঋণ খেলাপি করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতেই খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা সামনে আরও বাড়তে পারে।
জানা গেছে, গত মার্চের শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর আগে ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকব্যবস্থায় মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে গত মার্চে খেলাপির হার বেড়ে হয়েছে ৪৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ, যা ডিসেম্বরে ছিল ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের হার বেড়ে মার্চে ২০ দশমিক ১৬ শতাংশে উঠেছে, যা ডিসেম্বরে ছিল ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন যে তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালীরা নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়েছেন, যার একটা বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করে। সেই সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেওয়া হয় একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি খেলাপি ঋণে জর্জরিত পাঁচ ইসলামি ধারার ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সূত্রগুলো বলছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও বহুল সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলোর ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি বেড়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশ বেড়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, এস আলমসহ আরও কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এতেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ।