এনবিআর

নাটবল্টুর আড়ালে ভায়াগ্রা আমদানি

বেনাপোল কাস্টম হাউস দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় ভায়াগ্রা আনা হয়েছে। এই পর্যন্ত তিন চালান আটক।

গাড়ির নাটবল্টুর আড়ালে ভায়াগ্রা এসেছে। আমদানিকারক গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানির ঘোষণা দিয়েছিলেন। এসব যন্ত্রাংশের ভেতরে লুকিয়ে আনা হলো ২২ কেজি ভায়াগ্রা। পণ্যটি সাধারণ প্রক্রিয়ায় আমদানি নিষিদ্ধ। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ভায়াগ্রার চালান আটকের এমন ঘটনা যশোরের বেনাপোল কাস্টমসে ঘটেছে।

ঘটনাটি গত জুন মাসের। ১৭ জুন যশোরের চাঁচড়া বাজারের মেসার্স মা মনি এন্টারপ্রাইজ মোটর পার্টস ও অন্যান্য পণ্যের একটি মামুলি চালানের বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। পণ্যের বিবরণে ছিল মোটর গাড়ির নাটবল্টু, লুকিং গ্লাস, চাকার অ্যালয় রিম, সাউন্ড সিস্টেম, ইঞ্জিনের বিভিন্ন ছোটখাটো যন্ত্রাংশ। এর পাশাপাশি কিছু টেনিস বল, প্রেশারকুকার, ইন্ডাকশন কুকার, জুসার, স্যান্ডেল ইত্যাদি পণ্য আনার কথা। বেনাপোলের আমিন ইমপোর্টার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স লিমিটেড আমদানিকারকের পক্ষে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের দায়িত্ব পালন করে। আর চালানটি পাঠায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বনগার ধৃতি ইন্টারন্যাশনাল।

বেনাপোল কাস্টম হাউস সূত্রে জানা গেছে, অভিযোগ থাকার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০ জুন পণ্যবাহী ট্রাকটি শতভাগ কায়িক পরিদর্শন করা হয়। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানের মালিক মোয়াজ্জেম হোসেনের উপস্থিতিতেই পরিদর্শন করা হয়। ওই চালানে ১০টি প্যাকেটে ১৮৬টি জুসার আসার কথা। এ সময় একটি জুসারের প্যাকেটে সাদা পাউডার পাওয়া যায়। ওই সাদা পাউডারের ওজন প্রায় ২২ কেজি। ঘোষিত পণ্যের সঙ্গে মিল না থাকায় পুরো চালানটি আটক করা হয়।

সাদা পাউডার খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) রসায়ন বিভাগের পরীক্ষাগারে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। রাসায়নিক পরীক্ষায় জানা যায়, ওই সাদা পাউডার হলো সিলডেনাফিল সাইট্রেট। এটি রাসায়নিক নাম, বাণিজ্যিক নাম ভায়াগ্রা। পুরো বিষয়টি তদন্ত করে বেনাপোল কাস্টম হাউস সম্প্রতি ওই সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের লাইসেন্স বাতিল করে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, ওই চালানে ভায়াগ্রার উপাদান পাওয়া গেছে, যা আমদানিকারক ঘোষণা দেননি। বাংলাদেশে দু-একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় এটি আমদানি করে। কিন্তু ওই আমদানিকারকের এই ধরনের কোনো অনুমতি কিংবা বিল এন্ট্রিতে ঘোষণা ছিল না।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, প্রায় বিভিন্ন পণ্যের চালানে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ভায়াগ্রা আসে। সাধারণত মোটর পার্টস, প্লাস্টিক দানা, আতর, নাটবল্টু, টুপি, ভোগ্যপণ্য, ইমিটেশনের গয়না প্রভৃতি পণ্যের আড়ালে আসে ভায়াগ্রার চালান। এই ধরনের বড় ও সংবেদনশীল চালানের সঙ্গে আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং একশ্রেণির শুল্ক কর্মকর্তা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে বেনাপোল কাস্টম হাউসে কিছুটা ঢিলেঢালা ভাব দেখা যায়। এই সুযোগে কিছু অব্যবসায়ী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং কাস্টম হাউসের নিম্ন আয়ের একশ্রেণির চাকরিজীবী একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেটের পণ্যবাহী ট্রাকে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে ভায়াগ্রার মতো ক্ষতিকর পণ্য নিয়ে আসে। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দেড় মাস আগে বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছি। আগামী সপ্তাহ এ নিয়ে বৈঠক হবে।’

আগেও এসেছে ভায়াগ্রার চালান

বেনাপোলে মিথ্যা ঘোষণায় ভায়াগ্রা আনার ঘটনা নতুন নয়। এর আগে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে রাজধানীর কলাবাগানের রেড গ্রিন ইন্টারন্যাশনাল নামে এক আমদানিকারকের পক্ষে ৫০০ কেজি খাদ্যের ফ্লেভার ঘোষণা দিয়ে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে বেনাপোলের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আহাদ এন্টারপ্রাইজ। সন্দেহ হলে ওই চালান আটক করে পরিদর্শন করেন বেনাপোল কাস্টমসের চোরাচালান প্রতিরোধ ইউনিটের কর্মকর্তারা। ওই চালানে ২০০ কেজির মতো সাদা পাউডার মেলে, যা পরীক্ষাগারে প্রমাণের পর ভায়াগ্রা হিসেবে প্রমাণিত হয়। পরে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল ও মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

পরে ওই বছরের অক্টোবর মাসে আটক হয় ভায়াগ্রার আরেকটি বড় চালান। ওই সময়ে ওষুধের কাঁচামাল হিসেবে সোডিয়াম স্টিয়ারেট গ্লাইকোলেট ঘোষণা দিয়ে আড়াই টনের মতো রাসায়নিক আনা হয়। শুল্ক কর্মকর্তাদের সন্দেহ হলে ওই চালান আটক করা হয়। প্রথমে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নমুনা পরীক্ষায় সিলডেনাফিল সাইট্রেট বা ভায়াগ্রার উপাদানের অস্তিত্ব মেলে। পরে কুয়েটের পরীক্ষাগারের নমুনা পরীক্ষায়ও ভায়াগ্রা হিসেবে চিহ্নিত হয়। ওই দুটি চালান ধরতে নেতৃত্ব দেন বেনাপোল কাস্টম হাউসের তৎকালীন প্রিভেনটিভ ইউনিটের প্রধান ও সহকারী কমিশনার দীপা রানী হালদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই দুটি চালান আটকের সময়ে রাজস্বের চেয়ে সামাজিক অবক্ষয়ের বিবেচনাটি বেশি ছিল।