মাছ ধরার ট্রলার
মাছ ধরার ট্রলার

মাছ আহরণ কমে গেছে, জাহাজ বিক্রি করে দিচ্ছেন মালিকেরা

১৯৮০ সাল থেকে বঙ্গোপসাগরে মাছ আহরণ করে আসছিল বে ফিশিং লিমিটেড। শতভাগ রপ্তানিমুখী এ কোম্পানির চারটি জাহাজ ছিল। এরই মধ্যে একদিকে সাগরে মাছ আহরণের পরিমাণ কমে যায়, অন্যদিকে খরচ বৃদ্ধি পায়। তাতে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে পড়ে যায়। একসময় ভর্তুকি দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি।

বে ফিশিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে ছিলেন মইনুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাগরে মাছ আহরণ কমতে থাকায় শেষ চার বছর ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তেল ক্রয়, কর্মীদের বেতন ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রতি মাসেই মালিককে ভর্তুকি দিয়ে চালাতে হয়েছিল। সমুদ্র নিয়ে দেশে পর্যাপ্ত গবেষণা নেই বলে অভিযোগ করেন তিনি।

একই পরিণতি হয়েছে ১৯৭৯ সাল থেকে সাগরে মাছ ধরা প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ফিশারিজ লিমিটেডের। এ ছাড়া এএইচএম ফিশিং লিমিটেডও জাহাজ বিক্রি করে দিয়েছে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সব প্রতিষ্ঠানের একই পরিণতি হয়। বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বিশেষ করে ছোটদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। জাহাজ মালিক অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৯টি প্রতিষ্ঠান তাদের জাহাজ বিক্রি করে দিয়েছে। আরও অনেক প্রতিষ্ঠান একই চিন্তা করছে।

** *দেশে মাছ ধরার ট্রলার আছে মোট ২৬৪টি। বর্তমানে মাছ ধরছে প্রায় ২৩২টি জাহাজ। একেকটির দাম ২০ থেকে ৫০ কোটি টাকা। ***জাহাজ ব্যবহার করে এখন মোট ১১৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।

খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে বছর তিনেক ধরে মাছ আহরণ কমছে। এর মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শুধু সামুদ্রিক ট্রলার বা মাছ ধরার জাহাজ দিয়ে মাছ আহরণ কমেছিল ২২ শতাংশ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বৃদ্ধি পাওয়ায় নিয়মিত সাগরে যাওয়া যায় না, দূষণের কারণ উৎপাদন কমেছে, অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরার প্রবণতা বাড়ছে এবং ১০ মিটার পর্যন্ত পানিতে মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও তা মানা হচ্ছে না। এসব কারণে সাগরে মাছ উৎপাদন ও আহরণ দিন দিন কমছে। এতে হতাশ হয়ে ব্যবসায়ীরা জাহাজ বিক্রি করে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

বড় জাহাজমালিকদের অভিযোগ, স্বল্প গভীরতায় মাছ ডিম পাড়ে এবং মাছের বাচ্চা বড় হয়। তাই এ রকম এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ। কিন্তু তা লঙ্ঘন করে ছোট ছোট নৌকায় অবৈধভাবে মাছ ধরা হচ্ছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত মাছ ধরার ট্রলার বা জাহাজের সংখ্যা ২৬৪। বর্তমানে মাছ ধরছে প্রায় ২৩২টি জাহাজ। এসব জাহাজের একেকটির দাম ২০ থেকে ৫০ কোটি টাকা। ২৭টি জাহাজ দিয়ে সাগরের নিচের অংশ আর ২০০ জাহাজ দিয়ে সাগরের মধ্যস্তরের পানিতে মাছ ধরা হয়। জাহাজ ব্যবহার করে মোট ১১৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।

জাহাজমালিকেরা বলছেন, মাছ ধরা পড়ছে কম আবার দামি মাছও জালে উঠছে না। দূষণ বেড়ে যাওয়ায় বঙ্গোপসাগরে ‘মাইগ্রেটেড’ বা অন্য জায়গার মাছ আসছে কম।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইনাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাগরে একটি যাত্রায় এক কোটি টাকার তেলসহ মোট দেড় কোটি টাকার মতো খরচ হয়। কিন্তু তার বিপরীতে ১৫০ টন মাছ না পেলে লাভের মুখ দেখা যায় না।’

বর্তমানে সাগরে চান্দা, ম্যাকারেল, চাপিলা, স্কুইড, সার্ডিন, আইলা, লাক্ষা, ছুরি ও বাগদার মতো দামি মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। তাই এ খাতের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ চ্যালেঞ্জে পড়েছে।
—ইনাম চৌধুরী, সভাপতি, বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশন

ইনাম চৌধুরী আরও বলেন, বর্তমানে সাগরে চান্দা, ম্যাকারেল, চাপিলা, স্কুইড, সার্ডিন, আইলা, লাক্ষা, ছুরি ও বাগদার মতো দামি মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। তাই এ খাতের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ চ্যালেঞ্জে পড়েছে।

শিমিজু স্পেশালাইজড ফিশিং কোম্পানির পাঁচটি মাছ ধরার জাহাজ রয়েছে। এর এককটির মূল্য ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ১০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে। এসব জাহাজে কয়েক কোটি টাকার জাল থাকে। তা ছাড়া মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত সুনার মেশিনের দাম ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা। ইকো সাউন্ডারের দাম ৪ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা। সাগরে এক যাত্রায় ১৮ থেকে ২০ দিন লাগে। তেল লাগে ১০০ টন। আর প্রতি যাত্রায় মাছ পাওয়া যায় ১০০ থেকে ১৫০ টন। অর্থাৎ গড়ে ১০০ টন এবং প্রতি কেজি ১২০ টাকা করে হিসাব করলে দাম দাঁড়ায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মানে একটি জাহাজের প্রতি যাত্রায় ৩০ লাখ টাকার মতো লোকসানের আশঙ্কা থাকে।

শিমিজু স্পেশালাইজড ফিশিং কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক মো. হাসিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হঠাৎ তেলের দাম ৬৫ থেকে ১০০ টাকা হয়ে গেল। আবার ব্যাংকের সুদের হার ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ায় আমাদের ব্যয় বেড়ে গেছে। অন্যদিকে মাছ আহরণের পরিমাণ কমেছে। তাই মুনাফার মার্জিন কমে চাপ তৈরি হয়েছে।’ কয়েক বছর ধরেই মাছ কমছে বলে জানান তিনি। তাই সরকারের কাছে সুদহার কমানোর দাবি জানান তিনি।

মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের মাধ্যমে সাগরে মাছ আহরণ নজরদারিতে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পটির উপ-প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ শরিফুল আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পরীক্ষামূলকভাবে মাছ ধরার সাড়ে আট হাজার নৌকায় নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপন করেছি। অবৈধ জাল ব্যবহার এবং বৈধ অনুমতিপত্র যাচাই করার জন্য ছয়টি চেকপোস্ট তৈরি করা হয়েছে। তবে ভ্যাসেল মনিটরিং সিস্টেম চালু করা গেলে অনলাইনেই নজরদারি নিশ্চিত করা যেত।’ পর্যায়ক্রমে সব জাহাজ এবং নৌকায় নজরদারি সিস্টেম চালু করার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।

অন্যদিকে সাগরে মাছ ধরার কাঠের বোট বা নৌকার সংখ্যা প্রায় ২৯ হাজার। তবে জাহাজের মালিকেরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা হবে প্রায় ৫০ হাজার। অর্থাৎ নিবন্ধন বা তালিকার বাইরে রয়েছে অনেক নৌকা। এসব নৌকা দিয়ে উপকূল ঘেঁষে পোনা মাছ ধরার অভিযোগ বড়দের।