হোটেলশ্রমিক থেকে সফল ব্যবসায়ী

বগুড়ায় নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন মামুনুর রশিদ
ছবি: সোয়েল রানা

অজপাড়াগাঁয়ে দারিদ্র্যপীড়িত এক পরিবারে জন্ম মামুনুর রশিদের। বাবা ছিলেন দিনমজুর। সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে ছিল বেড়ার ভাঙা ঘর। দারিদ্র্যের কারণে পড়ালেখা হয়নি। সংসারের অভাব সামলাতে না পেরে একদিন নিরুদ্দেশ হন বাবা। আট বছরের কিশোর মামুনুরের কাঁধে চাপে সংসারের দায়িত্ব। একদিন সেই কিশোরও কাজের খোঁজে ঘর ছাড়েন। কাজ নেন শহরের একটি রেস্তোরাঁয় এঁটে থালাবাসন পরিষ্কারের। দিনরাতের কাজের বিনিময়ে দিনে মজুরি ৫ টাকা।

সেই কিশোরের হাত ধরেই বদলে গেছে পরিবারটির ভাগ্য। সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা। কুঁড়েঘরের বদলে উঠেছে পাকা বাড়ি। আর এই বদলের পেছনে রয়েছে মামুনুরের দুটি কারখানা। রেস্তোরাঁর কর্মী মামুনুর এখন একজন সফল উদ্যোক্তা। তাঁর প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন এখন ২০ থেকে ২৫ জন।

বগুড়ার মুসলেমা দইঘর এবং মুসলেমা মিষ্টান্ন ভান্ডার নামে দুটি কারখানার স্বত্বাধিকারী এখন মামুনুর রশিদ। কারখানা দুটিই জেলার শেরপুর উপজেলার চকপাথালিয়া গ্রামে। এ ছাড়া আছে মুসলেমা ডেইরি ফার্ম, শেরপুরে দই ও মিষ্টির একটি বিক্রয়কেন্দ্র। মুসলেমা দইঘর এবং মুসলেমা মিষ্টান্ন ভান্ডারের কয়েক ধরনের দই ও মিষ্টি যায় বগুড়া শহর ছাড়াও রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ফেনী, কুমিল্লা, বরিশালসহ দেশের বড় বড় শহরে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মোড়কে বিক্রি হয় এসব দই-মিষ্টি।

ওই কারখানায় কাজের ফাঁকে মনোযোগ দিয়ে কারিগরদের দই তৈরি করার কৌশল দেখতেন। ধীরে ধীরে কারিগরদের সঙ্গে মামুনুরের সখ্য গড়ে ওঠে।

শূন্য থেকে সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা ৩৩ বছর বয়সী মামুনুর রশিদের শৈশবের গল্পটা কষ্ট আর সংগ্রামের। যে রেস্তোরাঁয় ৫ টাকা চুক্তিতে কাজ শুরু করেছিলেন, সেই রেস্তোরাঁর কর্মীদেরই এখন তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়েছেন ২৪ থেকে ২৫ হাজার টাকার মাসিক বেতনে। ব্যবসার পুঁজি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকায়।

অভাবের কারণে প্রাথমিকের গণ্ডি পার হতে পারেননি মামুনুর রশিদ। ভাইবোনদের মধ্যে দ্বিতীয় মামুনুর। ৮ বছর বয়সেই তাঁর বাবা আবদুল জলিল নিরুদ্দেশ হন। তাই ৮ বছর বয়সেই মামুনুরকে সংসারের হাল ধরতে হয়। কিন্তু এত কম বয়সে তাঁকে কেউ কাজ দিতে রাজি হননি। পরে ১৯৯৭ সালে ৫ টাকা বেতনে কাজ পান শেরপুর শহরের উষা হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁয়।

রাতে হোটেল বন্ধের পর প্রতিদিন আড়াই কিলোমিটার পথ হেঁটে বাড়ি ফিরতেন। মায়ের হাতে তুলে দিতেন মজুরির ৫ টাকা। সেই টাকায় চার দিন পরপর বাড়িতে বাজার হতো। এভাবে কয়েক বছর যাওয়ার পর একদিন উষা হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁর মালিক মামুনুরকে ডেকে তাঁদের দইয়ের কারখানায় পাঠান। সেখানে টিউবওয়েল থেকে পানি আনা, দুধ জ্বাল দেওয়া কড়াই পরিষ্কার, দইয়ের হাঁড়ি পরিষ্কার এ রকম কাজ করতে হতো।

ওই কারখানায় কাজের ফাঁকে মনোযোগ দিয়ে কারিগরদের দই তৈরি করার কৌশল দেখতেন। ধীরে ধীরে কারিগরদের সঙ্গে মামুনুরের সখ্য গড়ে ওঠে। মামুনুরের আচার-ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে কারিগরেরা মামুনুরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ২০০৩ সালে ওই কারখানায় দই তৈরি শুরু করেন মামুনুর। দৈনিক মজুরি বেড়ে হয় ৬০ টাকা। এ মজুরির টাকায় ছোট-ভাইবোনদের পড়াশোনা ও সংসার খরচ জোগাতেন। আর কিছু টাকা জমাতেন প্রতি মাসে।

এরপর একদিন মামুনুর রশিদ সিদ্ধান্ত নেন, নিজেই দইয়ের ব্যবসা শুরু করবেন। মায়ের কাছে সেই ইচ্ছের কথা জানালেন। পোষা ছাগল বিক্রি করে মা মজিদা বেগম তিন হাজার টাকা তুলে দেন ছেলের হাতে। সেই তিন হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু হলো মামুনুরের দইয়ের কারখানা। নাম দেন মুসলেমা দই ঘর।

শুরুতে দই তৈরি করে তা ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটে পাঠানো শুরু করলেন। দইয়ের পরে যুক্ত হলো মিষ্টি তৈরি। দিনবদলের শুরুটা এখান থেকেই। অল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে যায় মুসলেমার দই ও মিষ্টি। দিন দিন চাহিদা বাড়ে। ২০১২ সালে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় প্রথম একটি বিক্রয়কেন্দ্র চালু করলেন। ২০১৭ সালে শেরপুরে খোলেন আরেক বিক্রয়কেন্দ্র। এরপর মামুনুর ভাবলেন, বাড়িতে একটা খামার থাকলে মন্দ হয় না। সেই চিন্তা থেকে চালু করেন খামার। পরে ধাপে ধাপে কারখানা বড় করেন।

একপর্যায়ে কারখানায় কারিগর হিসেবে পুরোনো প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকজনকে নিয়োগ দেন মামুনুর রশিদ। তাঁদেরই একজন ফজলুল হক, একসময় উষা হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁর মিষ্টি ও দইয়ের কারিগর ছিলেন তিনি। তাঁর কাছ থেকেই দই-মিষ্টি তৈরির কাজ শিখেছিলেন মামুনুর।

ফজলুল হক বলেন, ‘খুব কষ্ট করে বড় হয়েছেন মামুন। একসময় তাঁকে কাজ শিখিয়েছিলাম। ওস্তাদ হয়ে এখন তাঁর প্রতিষ্ঠানে কারিগরের কাজ করছি। প্রতিদিন বেতন ৮০০ টাকা। দুপুরে খাবার দেন। সব মিলিয়ে মাসে ২৫ হাজার টাকার মতো মজুরি পাই। শ্রমিক থেকে মালিক হয়েছেন মামুনুর। তাই শ্রমিকের কষ্ট বোঝেন।’

সম্প্রতি সরেজমিনে আলাপকালে মামুনুরের কারখানার কারিগরেরা জানান, প্রতি সরা (৭০০ গ্রাম) দই পাইকারিতে ১১০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতিদিন কারখানায় দুধ বিক্রি করতে ভিড় করেন খামারিরা। কারিগর ফজলুল হক বলেন, কারখানায় অর্ধশতাধিক পদের সাধারণ ও স্পেশাল মিষ্টি তৈরি হয়।

সরেজমিনে আলাপকালে মামুনুর রশিদ বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে সব মিলিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২৫ থেকে ৩০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। অথচ শৈশবে অনেক দিন ভাতই জোটেনি। ব্যবসা করে এখন সচ্ছল ও স্বাবলম্বী। অভাব কেটে যাওয়ায় এখন বাবাও ফিরে এসেছেন। ছোট ভাই পড়াশোনা শেষে চাকরি করছে। স্ত্রী ফরিদা পারভিন আর দুই কন্যা নিয়ে মামুনুরের সুখের সংসার।’