দেশের তৈরি পোশাক কারখানার কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যগত (ওএসএইচ) বিষয়াদির পাশাপাশি শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে তা তদন্ত করবে আরএমজি সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি)। শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের সত্যতা পেলে ওই কারখানার সংশ্লিষ্ট বৈশ্বিক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানকে তা জানাবে আরএসসি। এমনকি অভিযোগটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমাধানের নির্দেশনাও দিতে পারবে তারা। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত কারখানার ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
আরএসসির অধীনে থাকা বেশ কিছু কারখানাকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি অবহিত করেছেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল হক। সেই চিঠিতে বলা হয়, গত ২০ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অনুষ্ঠিত আরএসসির বোর্ড সভায় কারখানার নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যগত ইস্যুর বাইরে শ্রম অধিকার–সংক্রান্ত অভিযোগের ঘটনা তদন্তের বিষয়ে সংস্থাটির কার্যক্রমে যুক্ত করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। তবে বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলেছে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। সংগঠন দুটির নেতারা বলেছেন, বিষয়টি বোর্ড সভায় অনুমোদিত হয়নি।
বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সচিব সাইফুল ইসলাম গতকাল রোববার ওএসএইচ–বহির্ভূত বিষয়ে আরএসসির কোনো চিঠি, প্রজ্ঞাপন বা যোগাযোগে সাড়া না দিতে সদস্যদের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। সদস্যদের উদ্দেশে বিজিএমইএ বলেছে, কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যগত বিষয়াদির বাইরের অভিযোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কারখানাগুলোকে আরএসসির এমডি একটি চিঠি দিয়েছেন। বর্তমানে বিষয়টি পর্যালোচনার পর্যায়ে রয়েছে। বিজিএমইএর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আরএসসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে এ বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত অবস্থান আরএসসির পরবর্তী বোর্ড সভায় আলোচনার পর জানানো হবে।
একটি পোশাক কারখানাকে দেওয়া চিঠিতে আরএসসি বলেছে, ১৬ নভেম্বর থেকে প্রথম ধাপে ৫৮টি ব্র্যান্ড ও ১ হাজার ১৮৫ কারখানায় নতুন ব্যবস্থা কার্যকর হবে। ছয় মাস পর দ্বিতীয় ধাপে বাকি কারখানাগুলোতে সেটি কার্যকর হবে। বর্তমানে আরএসসির আওতায় রয়েছে ১ হাজার ৮৮৫টি তৈরি পোশাক কারখানা।
ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, আরএসসি তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিকের অন্যায্য চাকরিচ্যুতি ও ছাঁটাই, মজুরি, ভাতা ও ছুটির অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন করার স্বাধীনতা ও দর-কষাকষি, শিশুশ্রম, জবরদস্তিমূলক শ্রম এবং বৈষম্য-সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে। প্রতিটি অভিযোগ প্রমাণ ও কাঠামোবদ্ধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে।
আরএসসির গত ২০ অক্টোবরের বোর্ড সভায় উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান। জানতে চাইলে তিনি আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, বোর্ড সভায় কারখানার নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যগত ইস্যুর বাইরে শ্রম অধিকার–সংক্রান্ত অভিযোগের ঘটনা তদন্ত–সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আরএসসির প্রটোকল অনুযায়ী, কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে তিন পক্ষকে একমত হতে হবে। কেউ আপত্তি জানালে অনুমোদিত হওয়ার সুযোগ নেই। অনুমোদিত না হওয়া একটি বিষয়ে কেন আরএসসির এমডি কারখানাগুলোকে চিঠি পাঠালেন, সে বিষয়ে জানতে শিগগিরই সংস্থাটির বোর্ড সভা হবে বলে জানান তিনি।
জানতে চাইলে আরএসসির বোর্ড সদস্য ও বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আরএসসির মূল কাজ কারখানার নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে পরিদর্শন কার্যক্রমই ঠিকঠাকভাবে করতে পারছে না। এমন পটভূমিতে তারা নতুন দায়িত্ব নিতে চাইছে। তাহলে তো বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। তিনি আরও বলেন, বোর্ড সভায় কারখানামালিকেরা বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন।
২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১০০-এর বেশি শ্রমিক নিহত হওয়ার পর দেশি-বিদেশি চাপের মুখে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নামে বিদেশি ক্রেতাদের দুটি জোট গঠিত হয়। উভয় জোটের অধীনে বড় ও মাঝারি প্রায় দুই হাজার কারখানার সংস্কারকাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর অ্যালায়েন্স চলে যাওয়ার পর তাদের অধীনে থাকা কারখানাগুলো তদারকির জন্য নিরাপন নামে একটি সংস্থা গঠিত হলেও সেটি এখন নেই। আর অ্যাকর্ডের কারখানাগুলো ২০২০ সালের ১ জুন থেকে তদারক করছে আরএসসি।
বিষয়টি নিয়ে আরএসসির এমডি আবদুল হকের বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে কল করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরএসসির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বোর্ড সভায় বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি এবং কারখানামালিকদের প্রতিনিধিদের সম্মতিতে সিদ্ধান্তটি অনুমোদিত হয়েছে।
আরএসসির পরিচালনা পর্ষদের সভায় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অংশ নেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারখানার শ্রমিকের অধিকারের অভিযোগের বিষয়ে আরএসসি তদন্ত করলে শ্রমিকেরা উপকৃত হবেন বলে আমরা মনে করি।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আরএসসির বোর্ড সভায় বিষয়টি অনুমোদিত হয়েছিল।’