
দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছে না। বিশেষ করে যুব ও নারীদের বেকারত্ব একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যমান বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলকে পরিবেশবান্ধব শিল্পাঞ্চল বা ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে (ইআইপি) রূপান্তরের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, দেশে ইআইপি ধারণা বাস্তবায়িত হলে তা প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সমহারে কর্মসংস্থানও বাড়াবে।
আজ সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক (ইআইপি)-লাইট টাচ অ্যাকটিভিটিজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক কর্মশালায় এ কথা বলেন বক্তারা। শিল্প মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থার (ইউনিডো) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এ কর্মশালায় বাংলাদেশের শিল্প খাতের টেকসই রূপান্তরের একটি কার্যকর রূপরেখা তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে বক্তারা জানান, গত দুই দশকে যে পরিমাণ মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার মাত্র অর্ধেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এর পেছনে প্রধান কারণ, প্রয়োজনের তুলনায় শিল্পায়ন কম হয়েছে। ফলে ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক টেকসই শিল্পায়নের কার্যকর মাধ্যম হতে পারে।
আলোচকেরা আরও বলেন, দেশের শিল্পপার্কগুলোতে স্থানীয় বাজার ও রপ্তানিমুখী অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানকে শিল্পপার্কভিত্তিক সুবিধা, যেমন বর্জ্য পরিশোধনাগারের (ইটিপি) মতো সাধারণ পরিষেবা, প্রযুক্তি সহায়তা, নীতিগত প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। আবার এসব শিল্পকারখানার জন্য সম্মুখ ও পশ্চাৎ সংযোগ শিল্পের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে কর্মসংস্থান দ্রুত বাড়ানো সম্ভব। এতে লিঙ্গভিত্তিক কর্মসংস্থানবৈষম্যও কমবে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশের শিল্প খাতকে টেকসই ও পরিবেশবান্ধবভাবে রূপান্তর করার একটি কার্যকর রূপরেখা তৈরির জন্য সুইস স্টেট সেক্রেটারিয়েট ফর ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্সের অর্থায়নে একটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। গত জুন মাসে বাংলাদেশে ‘ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক (ইআইপি)–লাইট টাচ অ্যাকটিভিটিজ’ নামে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। দেশের আটটি বিসিক শিল্পপার্ক ও দুটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাকে (ইপিজেড) মূল্যায়ন করে আন্তর্জাতিক ইআইপি নীতিমালাকে বাংলাদেশের জাতীয় শিল্পনীতির সঙ্গে একীভূত করার সুপারিশ করা হয়েছে কর্মশালায়।
কর্মশালায় পাইলট প্রকল্পের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশে প্রকল্পের সমন্বয়ক চন্দ্রমল্লিকা ঘোষ। তিনি জানান, শিল্পাঞ্চলগুলোকে ইকো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে রূপান্তরের ক্ষেত্রে একাধিক কাঠামোগত বাধা রয়েছে। অনেক শিল্পপার্কে ইআইপি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা, প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিগত সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। ইআইপির স্পষ্ট সংজ্ঞা ও তা বাস্তবায়নকে উৎসাহিত করার মতো সমন্বিত জাতীয় নীতিমালাও নেই।
এ ক্ষেত্রে আর্থিক সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও তুলে ধরেন চন্দ্রমল্লিকা ঘোষ। তিনি বলেন, দূষণ প্রতিরোধ, বর্জ্য কমানো ও উৎপাদনপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন পায় না সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পপার্কগুলোর কর্তৃপক্ষ।
অনলাইনে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ইউনিডোর চিফ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার সালিল দত্ত বলেন, ইআইপির মাধ্যমে পরিচালিত শিল্পাঞ্চলে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো হয়। ফলে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত যৌথ সুফল পাওয়া যায়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পসচিব মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের দেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। একই সঙ্গে পরিবেশগত মান রক্ষা, সম্পদের দক্ষ ব্যবহার ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রত্যাশা দিন দিন বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কগুলোর বিবর্তন বা গুণগত পরিবর্তন হওয়া এখন সময়ের দাবি। এ ক্ষেত্রে আমাদের পরিবেশগত মান, অর্থনৈতিক দক্ষতা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং কার্যকর পার্ক ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম জানান, বর্তমানে বিসিকের ৮৩টি শিল্পপার্ক রয়েছে, যেখানে মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের সংখ্যা বেশি। ফলে বিসিকের জন্য ইআইপি উদ্যোগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) সদস্য আবদুল্লাহ আল মামুন বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, বর্তমানে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য টেকসই উন্নয়ন একটি কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বেপজা শিল্পের এ বিবর্তনকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। নতুন ও নির্মাণাধীন ইপিজেডগুলোর ক্ষেত্রে পরিকল্পনা পর্যায় থেকেই ইআইপি নীতিমালাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানান তিনি।