পাবনা সদরের পদ্মা নদীর তীরে নতুন সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের সোলার প্যানেল বসানোর কাজ চলছে। গতকাল পাবনার হিমাইতপুর ইউনিয়নের চরভবানীপুর এলাকায়
পাবনা সদরের পদ্মা নদীর তীরে নতুন সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের সোলার প্যানেল বসানোর কাজ চলছে। গতকাল পাবনার হিমাইতপুর ইউনিয়নের চরভবানীপুর এলাকায়

সবুজ জ্বালানির বড় সম্ভাবনা সৌরবিদ্যুতে

বিশ্বজুড়েই বাড়ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। বিদ্যুতের লোডশেডিং ও বাড়তি উৎপাদন খরচের কারণে বিকল্প হিসেবে সৌরবিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদন দুটোই বাড়ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বড় সম্ভাবনা এখন সৌরবিদ্যুতে। দেশে উৎপাদিত হচ্ছে এ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রপাতি। সৌরবিদ্যুতের বর্তমান চিত্র ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে এই আয়োজন।

বায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। যার বড় অংশই সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রিক। তবে লক্ষ্য পূরণে বিনিয়োগ ও জমির স্বল্পতার কথা বলছে বিদ্যুৎ বিভাগ। যদিও শুধু ছাদ ব্যবহার করেই সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্ভাবনা থাকলেও সবুজ জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন এগোচ্ছে খুব ধীরগতিতে।

সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করা হবে। বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতা আছে ১ হাজার ২২৬ মেগাওয়াট। যার মধ্যে ৯৯২ মেগাওয়াটই সৌরবিদ্যুৎ। বায়ু থেকে উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৩ মেগাওয়াট। আর বায়োগ্যাস ও বায়োমাস মিলে আছে ১ মেগাওয়াট। এর বাইরে পানি থেকে ২৩০ মেগাওয়াট সক্ষমতা থাকলেও তা থেকে উৎপাদন হচ্ছে খুবই কম। বর্তমানে যে উৎপাদন সক্ষমতা, তার পুরোটা অবশ্য গ্রিডে যুক্ত নেই।

গত দেড় দশকে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে পাঁচ গুণের বেশি। সর্বশেষ ২০১৬ সালের মহাপরিকল্পনা অনুসারে, ২০২১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১০ শতাংশ আসার কথা নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে। এরপর আরও দুই বছর পেরিয়ে গেছে, এখন পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। যদিও নতুন মহাপরিকল্পনা অনুসারে ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করতে চায় সরকার। তার মানে ওই সময় ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট হতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে।

রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে ১৯৫৭ সালে পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরুর মধ্য দিয়ে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার শুরু হয়। এ কেন্দ্রটির সক্ষমতা বাড়ানো হয় ১৯৮৮ সালে। এরপর ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু হয় সোলার হোম সিস্টেম বসানোর প্রকল্প। যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ-সুবিধা পৌঁছায়নি, সেসব এলাকার ঘরে ঘরে সৌরবিদ্যুৎ যন্ত্র বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম বসানো হয়েছে বলে দাবি টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা)।

এদিকে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে এরই মধ্যে দেশের ১৩টি এলাকায় গবেষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজারে দুটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। ফেনীতে ২০০৫ সালে নির্মাণ করা হয় প্রথম বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র। এটির উৎপাদন সক্ষমতা ১ মেগাওয়াটের কম। ২০০৮ সালে কক্সবাজারে ১ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। একই এলাকায় ৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও একটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র গত বছর উৎপাদনে এসেছে। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জে ২ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। তবে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে পানি ও বায়ুবিদ্যুতের চেয়ে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিদ্যুৎ বিভাগের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ভারত বা অন্যান্য দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির একাধিক উৎস আছে। দিনের বেলায় সৌরবিদ্যুৎ এবং সন্ধ্যার পর পানি ও বায়ুবিদ্যুৎ দিয়ে গ্রিডের সমতা বজায় রাখে তারা। বাংলাদেশে সম্ভাবনা বেশি সৌরবিদ্যুতের। এ ক্ষেত্রে জমির স্বল্পতা একটি বড় সমস্যা। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হলেও জমির স্বল্পতায় নির্ধারিত সময়ে এসব কেন্দ্র কাজ শেষ করতে পারেনি।

ভরসার মূলে সৌরবিদ্যুৎ

সূর্য থেকে আলো ও তাপ শোষণ করে বৈদ্যুতিক প্রবাহ উৎপন্ন করে সোলার প্যানেল। সোলার প্যানেলের বড় অংশ এখনো আমদানিনির্ভর। তবে দেশেও সীমিত পরিসরে সোলার প্যানেল তৈরি হচ্ছে। এটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাকৃতিক উৎস। তাই পরিবেশবান্ধব সবুজ জ্বালানি হিসেবে দুনিয়াজুড়ে এর ব্যবহার বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে সৌরবিদ্যুৎ বড় ভরসা হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ২৯ হাজার ৯২৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৩৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের জন্য চুক্তি হয়েছে ২৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের, যার সক্ষমতা ১ হাজার ১০৪ মেগাওয়াট। বর্তমানে ১২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আছে।

এদের সক্ষমতা ৭৪৯ মেগাওয়াট। এর বাইরে ৫৮৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার ১৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন। বেসরকারি খাতে ২ হাজার ৫৯৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরও ৩১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রাথমিক অনুমোদন রয়েছে। এ ছাড়া ২২৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে। এর বাইরে ২ হাজার ১৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২৫টি প্রকল্প আছে পিডিবির পরিকল্পনায়।

জলবায়ু পরিবর্তন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জমির ব্যবস্থা সরকারকে করে দিতে হবে। বিনিয়োগের জন্য শুল্ক-কর কমিয়ে সুবিধা দিতে হবে। বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমাতে নতুন কেন্দ্র নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করা হলে বিদেশি কোম্পানি প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। সরকারের নীতিতে এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি অগ্রাধিকার পাচ্ছে না। যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে বসে ক্যাপাসিটি চার্জ নিচ্ছে, তারাই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

ছাদ ব্যবহারে ব্যাপক সম্ভাবনা

ছাদ ব্যবহার করে বড় ধরনের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ আছে দেশে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি করা গেলে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে সরকারের। প্রণোদনা দিয়ে ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে শিল্পকারখানাকে উৎসাহী করা যেতে পারে। মার্চে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) বলছে, ২০১২ থেকে ২০২০-এর জানুয়ারি পর্যন্ত ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে ৫৬ মেগাওয়াট। বর্তমানে যা বেড়ে ১৬০ মেগাওয়াট হয়েছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ভবনের ছাদ ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে। তবে তা এখনো খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি আমদানিতে উচ্চ শুল্ক একটি বড় বাধা। এ ছাড়া এ খাতে বিনিয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বরাদ্দ করা তহবিল পর্যাপ্ত নয়। তবে বিশ্ববাজারে সৌরবিদ্যুৎ যন্ত্রপাতির দাম কমছে। এতে করে অনেকেই বিনিয়োগে উৎসাহী হবে।

গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আইইইএফএ বলেছে, ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ফার্নেস ওয়েল ও ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার কারণেই প্রতিবছর উচ্চমাত্রার রাজস্ব-ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে পিডিবি। তাদের এ খরচ কমাতে পারে ছাদে স্থাপিত সৌরবিদ্যুৎ। ছাদ ব্যবহার করে ২ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন করা সম্ভব। আর এটি করা গেলে বছরে ১১ হাজার ৩২ কোটি টাকা বা ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত সাশ্রয় হবে পিডিবির।

চড়া শুল্ক-কর বড় বাধা

সম্ভাবনা থাকলেও চড়া আমদানি শুল্কের কারণে সৌরবিদ্যুতের প্রসার হচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই খাতে ৩৭ থেকে ৫৬ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক-কর দিতে হয়। তবে বিশ্ববাজারে সৌরবিদ্যুৎ যন্ত্রপাতির দাম কমে আসছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও কমছে।

এদিকে বাসা-বাড়ি, অফিস, কারখানায় সৌরবিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। নিয়মিত খরচ কমাতে অনেকেই এখন সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ঝুঁকছেন। দেশে তাই সৌরবিদ্যুৎ যন্ত্রপাতি তৈরি করছে কেউ কেউ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এখন সৌরবিদ্যুৎ যন্ত্রপাতির বাজার বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার। ২০৩০ সাল পর্যন্ত এ বাজারের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৪০ শতাংশ। দেশীয় কোম্পানি ৩০ শতাংশ সরবরাহ করলেও বাকিটা আমদানি হচ্ছে। বাজারে নিম্নমানের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বিক্রি হচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে।

বাংলাদেশের জ্বালানি খাতবিষয়ক সংস্থা আইইইএফএর প্রধান বিশ্লেষক শফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে ছাদ বিদ্যুৎ একটা বড় সম্ভাবনার জায়গা। কিন্তু চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা এই খাতে বিনিয়োগে সময় নিচ্ছেন। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে, ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ তহবিল গঠনের মাধ্যমে ছাদ বিদ্যুতে উৎসাহী করতে পারে সরকার।