
বাজারে চা বেচাকেনায় মন্দা চলছে—এমনটাই অভিযোগ করে আসছেন চা ব্যবসায়ীরা। তবে খুচরা বাজারে চা বেচাকেনায় মন্দা অবস্থা থাকলেও নিলামে চায়ের দাম ও বিক্রি দুটিই বেড়েছে। চলতি মৌসুমের ২১টি নিলামের তথ্য পর্যালোচনায় এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
নিলামে চা উৎপাদক বা চা-বাগানের মালিকেরা আগের চেয়ে বেশি দাম পাচ্ছেন। অন্যদিকে নিলামে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। চা বিপণনকারী কোম্পানিগুলো খুচরা বিক্রেতাদের ছাড় কমিয়ে দিয়েছে। তাতে কেজিপ্রতি চায়ের দাম কিছুটা বেড়েছে।
বাজারে প্যাকেট ও খোলা অবস্থায় যেসব চা বিক্রি হয়, তা কেনা হয় সাধারণত নিলাম থেকে। এর বাইরে সামান্য পরিমাণে চা সরাসরি বাগান থেকে সংগ্রহ করে বাজারজাতের জন্য প্যাকেটজাত করেন বাগানমালিকেরা। চট্টগ্রাম, শ্রীমঙ্গল ও পঞ্চগড়—দেশের এ তিনটি স্থানে নিলামে চা বিক্রি হয়। গত মৌসুমে মোট চা বেচাকেনার ৯৭ শতাংশই হয়েছে চট্টগ্রামের নিলামকেন্দ্রে। চট্টগ্রাম নিলামকেন্দ্রে মূলত সারা দেশের উৎপাদিত চা বেচাকেনা হয়।
বিক্রি ও দাম দুটিই বেড়েছে
চট্টগ্রামের চা নিলামকেন্দ্রের হিসাবে, চলতি মৌসুমের প্রথম ২১টি নিলামে চা বিক্রি হয়েছে ৪ কোটি ৩ লাখ কেজি। গত মৌসুমের একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ৩ কোটি ৫১ লাখ কেজি। সেই হিসাবে চা বেচাকেনা গতবারের চেয়ে বেড়েছে ১৫ শতাংশ।
অন্যদিকে এ মৌসুমের প্রথম ২১টি নিলামে গড়ে প্রতি কেজি চা বিক্রি হয়েছে ২৩৭ টাকায়। গত মৌসুমের একই সময়ে এই দাম ছিল ২১১ টাকা ৩৬ পয়সা। সেই হিসাবে নিলামে কেজিপ্রতি চায়ের দাম গতবারের চেয়ে বেড়েছে ২৫ টাকা ৬৭ পয়সা বা ১২ শতাংশের বেশি। নিলামে চায়ের দামের ঊর্ধ্বগতি এখনো রয়েছে।
নিলামে চা বেচাকেনায় ন্যূনতম মূল্য আরোপ করায় চা উৎপাদনের খরচ ও নিলাম মূল্যে আগে যে ব্যবধান ছিল, তা কমে এসেছে। তবে এখনো উৎপাদন খরচের নিচে নিলামে চা বিক্রি হচ্ছেকামরান টি রহমান, সভাপতি, বাংলাদেশ চা সংসদহাইলাইটস
সর্বশেষ গত ২৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে চায়ের ২১তম নিলাম হয়। সেই নিলামে প্রতি কেজি চায়ের গড় দাম ছিল ২৪৪ টাকা ৮২ পয়সা। গত মৌসুমে একই সময়ে নিলামে প্রতি কেজি চায়ের গড় দাম ছিল ২০৮ টাকা ৬৩ পয়সা। সেই হিসাবে সর্বশেষ নিলামে কেজিতে চায়ের গড় দাম গতবারের তুলনায় ৩৬ টাকা বেশি।
চা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছোট ছোট অনেক ক্রেতা এখন নিলাম থেকে চা কেনার পরিমাণ বাড়িয়েছেন। ফলে নিলামে চায়ের বিক্রি বেড়েছে। তবে বড় ক্রেতা অনেকে নিলাম থেকে চা কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।
দাম বাড়ছে কেন
একটানা কয়েক বছর চায়ের উৎপাদন খরচের তুলনায় নিলামে গড় দাম ছিল কম। তাতে অব্যাহত লোকসানের কারণে সংকটে পড়েন চা উৎপাদকেরা। এ পরিস্থিতিতে চা-বাগানগুলোকে লোকসান থেকে বাঁচাতে বাগানমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়।
চা-বাগানের মালিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের এপ্রিলে শেয়ারবাজারের মতো চায়ের নিলামেও চায়ের ‘ফ্লোরপ্রাইস বা ন্যূনতম নিলামমূল্য’ বেঁধে দেওয়া হয়। নিলামে সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দেওয়ার পর চায়ের দরপতন থামে। দামও একটু একটু বাড়তে থাকে। চলতি মৌসুমে নিলামে চায়ের সর্বনিম্ন মূল্য কেজিপ্রতি ১০ থেকে ৮৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
গত ১৪ মে বাণিজ্য উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় চায়ের ন্যূনতম নিলামমূল্য সংশোধন করা হয়। তাতে চায়ের উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪৫ টাকা কেজি। তার ভিত্তিতে চলতি মৌসুমের জন্য সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের চায়ের সর্বনিম্ন গ্রেডের ন্যূনতম নিলামমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪৫ টাকা কেজি। আর উত্তরাঞ্চলের বটলিফ চায়ের ন্যূনতম নিলামমূল্য ১৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
* কেজিতে গড়ে দাম বেড়েছে ২৫ টাকার বেশি।* তবে প্রতিবেশী দেশ থেকে চোরাই পথে চা আসাটাই এখন বড় হুমকি।* ন্যূনতম নিলামমূল্য নির্ধারণের ফলে দরপতন ঠেকেছে।* কিছুসংখ্যক বাগান থেকেও অবৈধভাবে চা বাজারে আসছে।
ন্যূনতম নিলামমূল্য নির্ধারণের অর্থ হলো, এর চেয়ে কম দামে নিলামে চা বিক্রি করা যাবে না। চা আমদানি করতে হলে চা বোর্ডের অনুমোদন নিতে হয়। চা বোর্ড এই অনুমোদন নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ন্যূনতম দামেই চা কিনতে হয় চা ব্যবসায়ীদের।
চা-বাগানের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের সভাপতি কামরান টি রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নিলামে চা বেচাকেনায় ন্যূনতম মূল্য আরোপ করায় চায়ের উৎপাদন খরচ ও নিলামমূল্যে আগে যে ব্যবধান ছিল, তা কমে এসেছে। তবে এখনো উৎপাদন খরচের নিচে নিলামে চা বিক্রি হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
চা ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন পর্যন্ত নিলামে বিক্রি বাড়লেও সামনে তা কমে যেতে পারে। কারণ, সর্বশেষ নিলামে বিপুল পরিমাণ চা অবিক্রীত ছিল। এর পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন চা ব্যবসায়ী ও উৎপাদকেরা। প্রথমত, খুচরা বাজারে চায়ের চাহিদা কম। দ্বিতীয়ত, চোরাই পথে প্রতিবেশী দেশ থেকে চা আসছে। তৃতীয়ত, কিছুসংখ্যক বাগান থেকেও অবৈধভাবে চা বাজারে আসছে।
চা বোর্ডের পরিদর্শন ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের তথ্যেও এই চিত্র পাওয়া গেছে। চা বোর্ড নিয়মিত বাগানের কারখানাগুলো পরিদর্শন এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। গত জুলাই মাসে শ্রীমঙ্গলে অবৈধভাবে চা বিক্রি করায় তিনটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হয়। আবার অবৈধভাবে চা বাজারজাত করায় এ বছর দুটি কারখানার কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছিল চা বোর্ড। পরে জরিমানা করে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
বাগানমালিক ও ব্যবসায়ীরা কী বলছেন
চা ব্যবসায়ীদের সংগঠন টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান শাহ মঈনুদ্দিন হাসান প্রথম আলোকে বলেন, একদিকে ন্যূনতম নিলামমূল্য বাড়ানোর কারণে নিলামে আগের চেয়ে বেশি দামে চা বিক্রি হচ্ছে; অন্যদিকে অবৈধভাবে চা ঢুকছে বাজারে। তাতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ চা সংসদের সভাপতি কামরান টি রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে চায়ের বাজারের সবচেয়ে বড় সমস্যা চোরাই পথে চা আসছে। এতে নিলাম থেকে চা প্রত্যাহারের হার বেড়েছে। চোরাই পথে চা আসা বন্ধ করা হলে সরকার লাভবান হবে। বাগানগুলোও বাঁচবে। বাগান বাঁচলে শ্রমিকেরা বাঁচবেন।