পাটপণ্য
পাটপণ্য

বাংলাদেশের পাটপণ্যে শুল্ক বসাতে তদন্ত শুরু ভারতের

বাংলাদেশের পাটপণ্য আমদানির ওপর কাউন্টারভেলিং ডিউটি বা প্রতিকারমূলক শুল্ক বসাতে তদন্ত শুরু করেছে ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য বিভাগ। নেপালের বিরুদ্ধেও একই তদন্ত করছে তারা। ভারতের পাটকল সমিতি (আইজেএমএ) এবং এ পি মেস্তা টোয়াইন মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (এজেএমএ) যৌথ আবেদনের পর বাংলাদেশ ও নেপালের পাটপণ্যের ওপর কাউন্টারভেলিং শুল্ক বসাতে গত ২৯ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে তদন্তের ঘোষণা দেয় বিভাগটি। ভারতের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই তদন্তের বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়।

পাটপণ্যের ওপর কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপের তদন্ত শুরু করা হলেও ২০১৮ সালে বাংলাদেশি একই পণ্যের ওপর অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে ভারত সরকার। প্রথমে পাঁচ বছরের জন্য এই শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে সেটি আরও পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। তখন বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পাটপণ্যে ভিন্ন ভিন্ন হারে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপ করা হয়। প্রতি টনে ৬ ডলার থেকে ৩৫২ ডলার পর্যন্ত অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক বসে। উৎপাদন মূল্যের তুলনায় কম দামে বাংলাদেশের পাটকলমালিকেরা ভারতে পাটপণ্য রপ্তানি করছেন, এমন অভিযোগে ২০১৫ সালে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক আরোপের জন্য প্রথম তদন্ত শুরু করেছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।

নতুন করে শুল্ক আরোপের জন্য ভারতের তদন্তের উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের বেসরকারি পাটকলমালিকেরা। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের পাটপণ্যের অন্যতম বড় বাজার ভারত। এই বাজারে নিত্যনতুন শুল্ক ও অশুল্ক বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। নতুন করে আবার শুল্ক আরোপ করা হলে বাজারটিতে রপ্তানি আরও কমবে। তাতে অনেক পাটকল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

ভারত সরকার তাদের ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি পর্যালোচনা শুরু করেছে। আমরা আমাদের পাটপণ্য রপ্তানিকারকদের যুক্ত করেছি। আমরা একটি পরামর্শ সভা আয়োজনের অনুরোধ করব।
—মইনুল খান, চেয়ারম্যান, ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন

বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান তাপস প্রামাণিক প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো অযৌক্তিক। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপের তদন্ত শুরু করেছে ভারত। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন সরকারের। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভালো নয়। স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য রপ্তানি বন্ধ। তাতে খরচ বেড়েছে। তার বাইরে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা আছে। নতুন করে কাউন্টারভেলিং শুল্ক বসলে ব্যবসা আরও ক্ষতির মুখে পড়বে।

কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপের তদন্ত শুরুর নোটিশে ভারতের বাণিজ্য বিভাগ বলেছে, আইজেএমএ এবং এজেএমএ বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে পাটজাত পণ্য আমদানির ওপর কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপের তদন্ত শুরু করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ করে। বাণিজ্য সংগঠন দুটির অভিযোগ, বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে পাটপণ্যের রপ্তানিকারকেরা সরকারের কাছ থেকে নগদ সহায়তাসহ বিভিন্ন ভর্তুকি পেয়ে থাকেন। এতে দেশ দুটি থেকে ভারতে পাটপণ্য আসা বেড়ে গেছে। ফলে ভারতের শিল্পকারখানার মুনাফা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।

আইজেএমএ এবং এজেএমএর সদস্য আটটি পাটকল এ বিষয়ে অভিযোগ করলেও তারা বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে কোনো পাটপণ্য আমদানি করেনি। তবে বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে আমদানি হওয়া পাটপণ্যে তাদের উৎপাদিত পণ্যের সাদৃশ্য রয়েছে বলে অভিযোগ পাটকলগুলোর।

নতুন করে কাউন্টারভেলিং শুল্ক বসলে ভারতে আর পাটপণ্য রপ্তানি করা যাবে কি না, সন্দেহ। করোনাকালেও একবার দেশটি এ ধরনের শুল্ক আরোপের উদ্যোগ নিলে আমরা আমাদের যুক্তিতর্ক দিয়েছিলাম।
—মোস্তফা আবিদ খান, সাবেক সদস্য, ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন

কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপের তদন্তের অধীন পাটপণ্যের মধ্যে রয়েছে পাটের সুতা, স্যাকিং ব্যাগ ও কাপড়, হেসিয়ান ব্যাগ ও কাপড়। এ ছাড়া খনিজ বা উদ্ভিজ্জ তেলযুক্ত পাটপণ্য ও বহুমুখী পাটপণ্যও তদন্তের অধীন থাকবে। যদিও কম্বল, সাজসজ্জার কাপড়, হস্তশিল্প, কার্পেটের কাপড়, উপহার বা শৌখিন পণ্য তদন্তের আওতার বাইরে থাকবে। তদন্তের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত মোট ১২ মাস।

বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানিকারকেরা কী ধরনের ভর্তুকি পান, সে বিষয়ে তদন্তের নোটিশে বলা হয়, বাংলাদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেডে) কারখানা লভ্যাংশ কর থেকে অব্যাহতি ও বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ পায়। তা ছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানাগুলো ১০ বছরের কর অবকাশ ও কাঁচামাল আমদানিতে আমদানি শুল্কে অব্যাহতি পায়। এ ছাড়া নগদ সহায়তা, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি ইত্যাদি সুবিধা দেওয়া হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপের তদন্ত শুরুর আগে অভিযুক্ত দেশের সঙ্গে পরামর্শ সভা করতে হয়। ভারতের বাণিজ্য বিভাগ গত ১ সেপ্টেম্বর পরামর্শ সভা করার জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে। মন্ত্রণালয় প্রস্তুতির জন্য দুই মাসের সময় চায়। তবে ভারতের বাণিজ্য বিভাগ সেই সময় দেয়নি। ভারতের তদন্ত শুরুর নোটিশে বলা হয়েছে, গত ১ সেপ্টেম্বরের পরামর্শ সভায় বাংলাদেশ ও নেপাল অংশ নেয়নি।

ভারতের ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো অযৌক্তিক। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কাউন্টারভেলিং শুল্ক আরোপের তদন্ত শুরু করেছে ভারত। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন সরকারের।
—তাপস প্রামাণিক, চেয়ারম্যান, জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারত সরকার এখন তদন্ত করছে। আমরা একটি পরামর্শ সভা আয়োজনের অনুরোধ করব। আমাদের রপ্তানিকারকদের সহায়তার জন্য কমিশনের একজন সদস্যের নেতৃত্বে একটি ডেস্ক চালু করা হয়েছে।’

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট ৮২ কোটি ডলারের পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি হয়। তার মধ্যে ৬৭ কোটি ডলারের পাটপণ্য রয়েছে। গত অর্থবছরে ভারতে রপ্তানি হয়েছে প্রায় সাড়ে আট কোটি ডলারের পাটপণ্য।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন করে কাউন্টারভেলিং শুল্ক বসলে ভারতে আর পাটপণ্য রপ্তানি করা যাবে কি না সন্দেহ। করোনাকালেও একবার দেশটি এ ধরনের শুল্ক আরোপের উদ্যোগ নিলে দুই দেশের পরামর্শ সভায় আমরা আমাদের যুক্তি দিয়েছিলাম। তখন তারা আর তদন্তের পথে যায়নি। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যের কূটনৈতিক সম্পর্ক যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে বিষয়টি নিয়ে সরকারের এগোনো দুষ্কর হবে।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে মোস্তফা আবিদ খান আরও বলেন, অভিযোগের পিটিশন দেখে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে তার জন্য অভিজ্ঞ লোকজন লাগবে। অবশ্যই বাংলাদেশের অভিযোগের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখানোর জায়গা থাকবে বলে মনে করেন তিনি।