দেশের বাণিজ্য সংগঠনের সদস্য হতে আগে ব্যবসায়ীদের ফি বা মাশুল ছিল ৩৫০ টাকা। গত বছরের আগস্টে সরকার বদলের পর একলাফে সেই ফি প্রায় ৪৩ গুণ বাড়ানো হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, সদস্যদের বার্ষিক চাঁদার পরিমাণও বেড়ে হয়েছে প্রায় ১২ গুণ।
নতুন বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালায় সংগঠন নিবন্ধনে কড়াকড়ি আরোপের পাশাপাশি সেসব সংগঠনে সদস্য হওয়ার ফি ও বার্ষিক চাঁদার হারও বাড়ানো হয়েছে। একই হারে ফেডারেশনের অধিভুক্ত চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের ফি ও বার্ষিক চাঁদার হারও বাড়ানো হয়েছে।
চাঁদা বাড়ানোর ফলে ছোট ব্যবসায়ীরা সংগঠনের সদস্য হতে পারবে না। শুধু বড় ব্যবসায়ীরাই সদস্য হবেন। তাতে ছোট ব্যবসায়ীরা যে চেম্বারে দুটি কথা বলবে, সেই সুযোগ আর থাকবে নাশরীফ আতিয়ার রহমান, সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, খুলনা চেম্বার
নতুন এ নিয়মের কারণে বাণিজ্য সংগঠনে বড় ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ বাড়বে। তার বিপরীতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা কোণঠাসা হবেন—এমনটাই মনে করে দেশের ব্যবসায়ীনেতাদের একটি অংশ। ব্যবসায়ীনেতারা বলছেন, বর্তমানে অনেক ধরেনের ব্যবসা করতে হলে বাণিজ্য সংগঠনের সদস্য হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে বাণিজ্য সংগঠনের সদস্য ফি ও বার্ষিক চাঁদা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানোর কারণে ছোট–মাঝারি ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়বেন। আবার যাঁদের সংগঠনের সদস্য হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই, সেসব ব্যবসায়ীও বাড়তি ব্যয়ের কারণে বাণিজ্য সংগঠনমুখী হচ্ছেন না। তাঁদের মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংগঠনের উদ্যোক্তার সংখ্যাই বেশি।
জানা যায়, বগুড়া চেম্বারের সদস্য ফি আগে ছিল সাড়ে তিন হাজার টাকা। নতুন বিধিমালা জারির পর তা বেড়ে হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। একইভাবে সদস্য নবায়ন ফি তিন হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা।
জানতে চাইলে বগুড়া চেম্বারের সাবেক সভাপতি সাইরুল ইসলাম বলেন, বাণিজ্য সংগঠনের নতুন বিধিমালা ব্যবসায়ীবান্ধব নয়। বিধিমালা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। এটি সংশোধন করতে হবে। বর্ধিত ফি দিয়ে কোনো ব্যবসায়ী চেম্বারের সদস্যপদ নিতে কিংবা নবায়ন করতে আগ্রহী নয়।
বাণিজ্য সংগঠনের নতুন বিধিমালা ব্যবসায়ীবান্ধব নয়। বিধিমালা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। বর্ধিত ফি দিয়ে কোনো ব্যবসায়ী চেম্বারের সদস্য হতে ও সদস্যপদ নবায়ন করতে আগ্রহী নয়সাইরুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি, বগুড়া চেম্বার
এ বিষয়ে চেম্বারটির প্রধান নির্বাহী মাসুদ রানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়তি ফি দিয়ে কোনো ব্যবসায়ী চেম্বারের নতুন সদস্য হতে ও সদস্যপদ নবায়নে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এ কারণে বাধ্য হয়ে আমরা আগের ফি দিয়ে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত ও সদস্যপদ নবায়ন করছি।’
প্রায় তিন দশক পর চলতি বছরের মে মাসে নতুন বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আগের বিধিমালাটি ছিল ১৯৯৪ সালের। ১৯৯৪ সালের বিধিমালাটি করা হয়েছিল ১৯৮৫ সালের বিধিমালা বাতিল করে। উভয় বিধিমালা ১৯৬১ সালের বাণিজ্য সংগঠন অধ্যাদেশের ভিত্তিতে করা। ১৯৬১ সালের সেই অধ্যাদেশ বাতিল করে ২০২২ সালে নতুন বাণিজ্য সংগঠন আইন প্রণয়ন করেছিল সরকার।
নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, একই ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১১ প্রতিষ্ঠান একত্র হয়ে নতুন বাণিজ্য সংগঠনের নামের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করতে পারবে। তবে কোনো বাণিজ্য সংগঠন সম্মিলিতভাবে ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ বা ১ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান বা সরকারকে বছরে ১০ কোটি টাকা রাজস্ব দিলে কম সদস্য দিয়েও ছাড়পত্র পাওয়া যাবে। আগের বিধিমালায় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা ছিল না।
দেশের সব জেলার চেম্বারের জন্য একধরনের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্য বিভাগ আর সিলেটের অর্থনীতি এক নয়। এলাকার অর্থনৈতিক বাস্তবতা অনুযায়ী সদস্য ফি নির্ধারণ করা উচিতআবদুর রহমান, পরিচালক, সিলেট মেট্রো চেম্বার
পুরোনো বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালায় ক শ্রেণির চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনে সাধারণ সদস্য হওয়ার ফি ছিল ৭৫০ টাকা। এখন সেটি ২০ গুণ বাড়িয়ে ১৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া খ শ্রেণির চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনে সাধারণ সদস্য হওয়ার ফি ছিল ৩৫০ টাকা। এখন সেটি সাড়ে ২৮ গুণ বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে।
একইভাবে ক শ্রেণির চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনে সহযোগী সদস্য হওয়ার ফি ৩৫০ থেকে প্রায় ৪৩ গুণ বাড়িয়ে ১৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। খ শ্রেণির ক্ষেত্রে সেটি ২৫০ থেকে ৪০ গুণ বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০ হাজার টাকা।
পুরোনো বিধিমালায়, ক শ্রেণির চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনে সাধারণ সদস্যদের বার্ষিক চাঁদা ছিল ৭৫০ টাকা। এখন সেটি বাড়িয়ে পাঁচ হাজার টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া খ শ্রেণির সাধারণ সদস্যদের বার্ষিক চাঁদা ৩৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। একইভাবে ক শ্রেণির চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনে সহযোগী সদস্যদের বার্ষিক চাঁদা ৩৫০ থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। আর খ শ্রেণির ক্ষেত্রে সেটি ২৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। যদিও নতুন বিধিমালা করার আগেই বিভিন্ন সময় চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন নিজেরা নিজেদের মতো করে এসব ফি বাড়িয়েছিল।
এদিকে বাণিজ্য সংগঠন করার ক্ষেত্রে সব ধরনের ফি বৃদ্ধির কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা চেম্বার–বিমুখ হয়ে পড়ছেন। তাঁদের জন্য বাণিজ্য সংগঠন করা এখন কঠিন হয়ে গেছে। এ বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের সব জেলার চেম্বারের জন্য এক ধরনের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্য বিভাগ আর সিলেটের অর্থনীতি এক নয়। এলাকার অর্থনৈতিক বাস্তবতা অনুযায়ী সদস্য ফি নির্ধারণ করা উচিত।
বিধিমালা অনুযায়ী, যেসব বাণিজ্য সংগঠনের সদস্যসংখ্যা ৫০০ বা তার বেশি, সেগুলো ক শ্রেণি। আর যাদের সদস্যসংখ্যা ৫০০–এর কম, সেগুলো খ শ্রেণির বাণিজ্য সংগঠন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) অধিভুক্ত ৮৩টি চেম্বার ও ৪০১টি পণ্যভিত্তিক বাণিজ্য সংগঠন রয়েছে।
এদিকে এফবিসিসিআইয়ের অধিভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনের চাঁদা বা ফি আগের চেয়ে ২০ গুণ বাড়ানো হয়েছে। আগে ফেডারেশনে অধিভুক্ত হতে ক শ্রেণির চেম্বারের লাগত ২৫ হাজার টাকা। এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ টাকা। একই শ্রেণির অ্যাসোসিয়েশনে অধিভুক্ত হতে ১৫ হাজারের পরিবর্তে লাগছে ৪ লাখ টাকা। আবার ফেডারেশনে অধিভুক্ত হতে খ শ্রেণির চেম্বারের ১৫ হাজারের পরিবর্তে এখন লাগবে ৩ লাখ টাকা। একই শ্রেণির অ্যাসোসিয়েশনের এফবিসিসিআইয়ের সদস্য হতে ৮ হাজারের বদলে লাগছে ২ লাখ টাকা।
ফেডারেশনের অধিভুক্ত সদস্য চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক চাঁদাও বাড়ানো হয়েছে। ক ও খ শ্রেণির চেম্বারকে বছরে চাঁদা দিতে হবে যথাক্রমে ১ লাখ ও ৭৫ হাজার টাকা। আগে ক ও খ শ্রেণির চেম্বারের চাঁদা ছিল যথাক্রমে ২৫ ও ১৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে ক ও খ শ্রেণির অ্যাসোসিয়েশনকে বছরে চাঁদা দিতে হবে যথাক্রমে ৭৫ ও ৬০ হাজার টাকা। আগে ক ও খ শ্রেণির অ্যাসোসিয়েশনকে যথাক্রমে ১৫ ও ৮ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হতো। এ ছাড়া ফেডারেশনের ২ বছর মেয়াদের জন্য গঠিত সাধারণ পরিষদের প্রত্যেক সদস্যকে এককালীন ২০ হাজার টাকা নিবন্ধন ফি দিতে হবে।
খুলনার ৫৬১ জন ব্যবসায়ী চেম্বারের ফি ও বার্ষিক চাঁদা কমানোর দাবিতে খুলনা চেম্বার অব কমার্সের প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন। তাঁরা বলছেন, বাড়তি ফি থাকলে চেম্বারে সব শ্রেণির ব্যবসায়ীর অংশগ্রহণ থাকবে না।
জানতে চাইলে খুলনা চেম্বারের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শরীফ আতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদা বাড়ানোর ফলে ছোট ব্যবসায়ীরা সংগঠনের সদস্য হতে পারবেন না। শুধু বড় ব্যবসায়ীরাই সদস্য হবেন। তাতে ছোট ব্যবসায়ীরা যে চেম্বারে দুটো কথা বলবেন, সেই সুযোগ আর থাকবে না।
এদিকে ব্যবসায়ীদের আপত্তির মুখে বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা আবারও সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান। গত মঙ্গলবার রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্য সংগঠন সংশোধনের জন্য কয়েকটি বিষয়ে মোটামুটি একমত হওয়া গেছে। সদস্য হওয়ার ফি ও বার্ষিক চাঁদা অর্ধেকে নামিয়ে আনার চিন্তাভাবনা চলছে। শিগগিরই এটি চূড়ান্ত করা হবে।