কোলাজ ছবি: ফ্রিপিক
কোলাজ ছবি: ফ্রিপিক

কেক-রুটির বাজারে বড় করপোরেটরা, টিকে থাকার লড়াইয়ে ছোটরা

রাজধানীর হাজারিবাগ পার্কের পাশে ১৫ বছর পুরোনো প্রতিষ্ঠান বিকল্প বেকারি। রুটি-কেকে ও বিস্কুটসহ নানা পণ্যের দৈনিক বিক্রি ৫০ থেকে ৬০ হাজার, মাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকার বেশি। ৮০ জনের বেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থান যেখানে। তবে এসব এখন শুধুই অতীত, বড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তিন বছর আগে বন্ধ হয়ে যায় বেকারিটি। এভাবে শুধু রাজধানীতেই তিন বছরে ৫০টির বেশি বেকারি বন্ধ হয়েছে। সারা দেশে সংখ্যাটি প্রায় হাজারের কাছাকাছি।

এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত কয়েক বছরে বড় করপোরেট প্রুপগুলো ছোট ও মাঝারি মানের সব বেকারি পণ্য বা কেক-রুটি-বিস্কুট উৎপাদনে বিপুল বিনিয়োগ করছে। এতে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে ছোট বেকারি মালিকরা। যেখানে টিকে থাকার লড়াই করছে ছোটরা। অনেকে বাজার হারিয়ে এবং ঋণে জর্জরিত হয়ে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের মত একটি প্রতিষ্ঠান বিকল্প বেকারি।

বিকল্প বেকারির মালিক আবদুল খালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাসে দেড় লাখ টাকা দোকান ভাড়াই দিতাম আমি। জীবন-যৌবন সব দিয়েছি এই ব্যবসায়। এখন তিন ছেলের পড়ালেখা করানো ছাড়া কিছুই প্রাপ্তি নেই। বড় বড় কোম্পানিগুলো অনেক পুঁজি নিয়ে নেমেছে। আমরা প্যাকেজিংয়ে তাদের সঙ্গে পিছিয়ে পড়েছি।’ তার মত অনেকে এখন দেউলিয়া হওয়ার পথে কিংবা ঋণগ্রস্ত হয়ে ব্যবসা ছাড়ার চিন্তা করছে বলে জানান তিনি। যারা শোরুম করেছে তারা কোনোরকমে টিকে আছে বাকিদের অবস্থা সূচনীয় বলছেন তিনি। একই পরিণতি হয়েছে রায়েরবাজারের হাসান শাহ বেকারির। মাসে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার বিক্রি ছিল তাদেরও। একইভাবে বন্ধ হয়েছে গনিশাহ বেকারি, চায়না বেকারি ও রুচি বেকারি। জেলা পর্যায়েও বন্ধ বেকারির তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

ইউরোপ বা আমেরিকায় ছোট ব্যবসায় বড়দের অনুমতি দেওয়া হয় না। তারা বিমান বানাবে, হেলিকপ্টার বানাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারা বদনা বানাতে নেমে যাচ্ছে। রঙিন প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে তারা ক্রেতা আকৃষ্ট করছে। চাইলেও ছোটদের পক্ষে যা সম্ভব হয়ে উঠে না।
মো.রেজাউল হক রেজু, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ রুটি বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতি এবং স্বত্বাধিকারী, হক বেকারি।

দোকানে দোকানে ঘুরেও একই বাস্তবতা চোখে পড়ছে। চা দোকান থেকে ছোট টং দোকান বা মুদির দোকানে একসময় বেকারি পণ্য বেশি দেখা গেলেও এখন চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিন ধরনের দোকানেই রুটি-কেক ও বিস্কুটের বেশির ভাগ জায়গা দখলে নিয়েছে প্যাকেটজাত পণ্য। যেখানে ছোট পরিসরে দেখা যায় বেকারির পণ্যও।

সংসদ ভবনের সামনে ভাসমান চায়ের দোকানে দুই বছর ধরে ব্যবসা করছেন সঞ্জিব অধিকারী। এখানেও দেখা গেল প্রায় অর্ধেক জায়গাজুড়ে প্যাকেটজাত পণ্যের বহর। এখানকার বেশিরভাগে ভোক্তা শ্রমজীবী মানুষেরা। তারা বেকারি পণ্যটা বেশি খায়। আর ছাত্র কিংবা যুবকেরা খায় প্যাকেটজাত পণ্য। তবে ইদানীং বিক্রি কম বলে জানান সঞ্জিব অধিকারী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আগে একটা রিকশাচালক এখানে থামলে ৫০ টাকা বিল হতো। এখন ২০ টাকায় সেরে ফেলতে চায় তারা। আগে দিনে ১০ প্যাকেট বেকারির রুটি-কেক বিক্রি হলেও এখন লাগে ৪ প্যাকেট।’

এসব চা দোকান এবং ছোট টং দোকানে বেকারি পণ্য বিক্রি করলে লাভ কিছুটা বেশি। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেকারি থেকে কেনা একেকটি রুটির দাম পড়ে ৮ টাকা। বিক্রি হয় ১০ টাকায়। কিন্তু ব্যান্ডের প্যাকেটজাত রুটির কেনা দাম পড়ে সাড়ে ৮ টাকা। বিক্রি ১০ টাকায়। আবার বেকারির রুটির আকার এবং ওজন বেশি। তাই শ্রমজীবী মানুষ পেট ভরার জন্য বেকারি রুটি খায় বেশি।

গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে বেকারি খাতে। নতুন নতুন মোড়কে নতুন সব পণ্য আনছে এসব প্রতিষ্ঠান। তবে ছোট পণ্যের বাজারে এত বড় কোম্পানিগুলোকে ব্যবসা করার অনুমতি দিয়ে ছোটদের বাজার ছাড়া করার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছে বাংলাদেশ রুটি বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতি।

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ও হক বেকারির স্বত্বাধিকারী মো.রেজাউল হক রেজু প্রথম আলোকে বলেন, ইউরোপ বা আমেরিকায় ছোট ব্যবসায় বড়দের অনুমতি দেওয়া হয় না। তারা বিমান বানাবে, হেলিকপ্টার বানাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারা বদনা বানাতে নেমে যাচ্ছে। রঙিন প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে তারা ক্রেতা আকৃষ্ট করছে। চাইলেও ছোটদের পক্ষে যা সম্ভব হয়ে উঠে না।’

চায়ের দোকানে প্যাকেটজাত বেকারি পণ্যই বেশি পাওয়া যায়।

বড়রা সহজে ঋণসহ নানা সুবিধা পায়। কিন্তু ছোটদের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব নয়, বলছেন তিনি। তবে পণ্যের ওজন এবং আকারে বড় হওয়ায় এখনো বাজার ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, প্যাকেটে ৭০ গ্রামের রুটি থাকলেও বেকারিতে তৈরি রুটি ওজন ১০০ গ্রাম হয়। সঙ্গে ভ্যাট ছাড়ের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সরকার এখানে নজর না দিলে বর্তমান অবস্থাও ধরে রাখা যাবে না বলে জানান এ ব্যবসায়ী নেতা। আর বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানে মেশিন ব্যবহার করে কয়েকশ’ শ্রমিকের কাজ কয়েকজন দিয়ে করানো হয়। এতে কর্মসংস্থানও বাড়ছে না।  

দেশের বেকারি পণ্যের বাজার কত বড়, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে এ খাতের ব্যবসায়ীদের মতে, এ বাজার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার। আর সারা দেশে প্রায় এখন ৬ হাজার বেকারি আছে। যেখানে প্রায় ১০ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। আর রাজধানীতে বেকারির সংখ্যা ৫০০টির বেশি। ভারী যন্ত্র ছাড়াই এসব প্রতিষ্ঠান হাতে পণ্য তৈরি করে। বাংলাদেশ রুটি বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির তথ্যমতে, গত তিন বছরে দেশে এক হাজারের বেশি বেকারি বন্ধ হয়ে গেছে।

ছোট ছোট টং দোকান এখন বেকারির মতো নানা ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত বাটার বান, চকলেট বান,জেলি বান এবং মোরব্বা বান পাওয়া যায়। আর দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা। আর বেকারির বাটার রুটি ২০ টাকা। আর বাটার ছাড়া রুটি এবং কেক পাওয়া যায় ১০ টাকায়। মোরব্বা দেওয়া বেকারির কেক পাওয়া যায় ২০ টাকায়।

বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ছোট পণ্যের বাজার দখল ঠেকাতে প্রতিযোগিতা কমিশন কিছু ভাবছে কিনা- তা জানতে চাওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারপারসন এএইচএম আহসানের কাছে। জবাবে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কোন প্রতিষ্ঠান একচেটিয়া কারবার বা ক্ষমতার অপব্যবহার করলে কমিশন শুধু আর্থিক জরিমানা করতে পারে। কিন্তু বেকারির ব্যবসায় বড়দের ঠেকানোর মত কোন বিষয় কমিশনের বর্তমান আইনে নেই। তবে অর্থনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের আকার বড় হলে ওসব নিয়ে হয়তো ভাবা যাবে।’ এ ক্ষেত্রে ছোটদের প্রয়োজনে কম সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলেন তিনি।  

মোহাম্মদপুর শাহজাহান রোডের ছোট মুদির দোকান বিসমিল্লাহ স্টোরের দোকানদার জানান, এখন প্যাকেটজাত পণ্যে ক্রেতাদের আস্থা বেশি। তাই চলেও বেশি।’ বাচ্চারা প্যাকেটের পণ্য বেশি পছন্দ করে বলে জানান তিনি। এ দোকানে প্যাকেটজাত পণ্যের বাহারে বেকারি আইটেম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। একইভাবে কারওয়ান বাজারের বাটা গলির চা বিক্রেতা আবদুল কাইয়্যুম জানান, প্যাকেটজাত পণ্যের বিক্রি বাড়ছে।’