
দেশে প্রযুক্তিনির্ভর নতুন স্টার্টআপের সংখ্যা বাড়লেও এই খাতে এখনো বিভিন্ন ধরনের সংকট রয়ে গেছে। অর্থায়নে আস্থার অভাব ও কাঠামোগত ঘাটতি, সরকারি বিনিয়োগের অপ্রতুলতা, ব্যাংকের বিনিয়োগে অনীহা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগে প্রণোদনার অভাবসহ নানা সমস্যা আছে। দেশীয় বিনিয়োগকারীরা স্টার্টআপে আগ্রহ না দেখানোর কারণে বিদেশি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
আজ বৃহস্পতিবার ‘যুব উদ্যোক্তা: বিনিয়োগ, নীতি ও ইকোসিস্টেম’ শীর্ষক এক কর্মশালায় এসব সমস্যা তুলে ধরেন বিভিন্ন স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও অংশীজনেরা। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) যৌথভাবে কর্মশালাটির আয়োজন করে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিডার মাল্টিপারপাস হলে অনুষ্ঠিত এ কর্মশালায় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া প্রধান অতিথি এবং ইউএনডিপি বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি (ভারপ্রাপ্ত) সেনালী দয়ারাত্নে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, বিডার বিজনেস ডেভেলপমেন্টের প্রধান নাহিয়ান রহমান, ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনোমিক অ্যাডভাইজার ওয়্যাইস প্যারে প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তারা বলেন, প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্টআপের মূল্যায়ন, স্টার্টআপ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) সংজ্ঞার জটিলতা, বেসরকারি খাত ও সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, সেকেন্ডারি ক্যাপিটাল মার্কেটে স্টার্টআপের তালিকাভুক্তির সুযোগ না থাকা এবং প্রারম্ভিক পর্যায়ে করের চাপসহ বিভিন্ন জটিলতার কারণে এই খাতে প্রয়োজনীয় অগ্রগতি হচ্ছে না।
কর্মশালার মুক্ত আলোচনায় স্টার্টআপ খাতের সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পরামর্শ দেন উদ্যোক্তা ও অংশীজনেরা। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বেটার স্টোরিজ লিমিটেডের চিফ স্টোরিটেলার মিনহাজ আনোয়ার বলেন, ‘স্টার্টআপের শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠাতারা সব ধরনের কাজ করেন। তবে প্রতিষ্ঠান বড় হলে এইচআর, ফাইন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং, নিরীক্ষাসহ সব বিভাগের জন্য দক্ষ জনবল প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের এই দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের সুশাসন নিশ্চিতে দক্ষ আইনজীবী ও নিরীক্ষক প্রয়োজন। দেশে মাত্র আড়াই হাজারের মতো নিরীক্ষক (চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট) রয়েছেন। সেবা পেতেও বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়।’
ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান প্রিয় শপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আশিকুল আলম বলেন, স্টার্টআপকে ঋণ দিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা ও তহবিল তৈরি করেছে। তবে কীভাবে তহবিলটি থেকে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠাগুলোতে অর্থায়ন করা হবে, সেই বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। দেশে স্টার্টআপগুলো প্রারম্ভিক পর্যায়ে লোকসান করলেও টার্নওভার করসহ বিভিন্ন কর দিতে হয়। শুরুর পর্যায়ে কিছু সময়ের জন্য হলেও ছাড় দেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ‘আজকে আপনারা ১৭টি সুপারিশ দিয়েছেন। কিন্তু আমরা এর মধ্যে ৫টির বেশি সুপারিশ নিতে পারব না। তবে যদি ৫টি সুপারিশও বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে এই আয়োজনকে আমরা সফল বলেই ধরব।’ এ সময় স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানের সহায়তার জন্য যুব মন্ত্রণালয়, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও বিডার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে একটি ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান কমিটি করার প্রস্তাব দেন তিনি। তাঁর মতে, এই কমিটির কাজ হবে কর্মশালার সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের পরিকল্পনা তৈরি করা। প্রতি তিন মাস পরপর এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে স্টার্টআপ প্রতিনিধিদের মতামত নিতে হবে। এই কমিটি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হবে। তবে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার চাইলে এটিকে রাখতেও পারে, আবার বাতিলও করতে পারে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেন, ‘গত বছর এই সময়েই একটা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গিয়েছি, যার প্রধান কারণ ছিল বেকারত্ব। এখনো আমরা সেই সমস্যার মধ্যে আছি। খুব বেশি উন্নতি হয়নি। যেভাবে হয়তো কাজ হওয়া দরকার, সেই পরিসরে আমরা এখনো পৌঁছাতে পারিনি। তারপরও আমরা যতটা সম্ভব কাজ করার চেষ্টা করছি।’
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেন, ‘যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত উপস্থিত থাকলেও কার্যকর নীতি ও পরিকল্পনার অভাবে সেটিকে পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আমরা যুব উদ্যোক্তা ঋণের পরিমাণ ২ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ করেছি। ২০২৫ সালের যুব উদ্যোক্তা উন্নয়ন নীতিমালাও অনুমোদন পেয়েছে। এ ছাড়া সরকারি বিভিন্ন সংস্থার এক কাজ যেন একাধিক জায়গায় পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য আমরা কার্যক্রমগুলো সমন্বিত ও সুশৃঙ্খল করার উদ্যোগ নিয়েছি।’
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘আমরা স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গঠনে বিভিন্ন স্তরে কাজ করছি। দেশজুড়ে স্কুল পর্যায়ে স্টার্টআপের ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি, যাতে উপজেলা পর্যায়ে একটি পাইপলাইন তৈরি হয়। ‘‘বাংলাদেশ ইনোভেশন গ্র্যান্ট’’–এর কার্যকারিতার গতি কিছুদিনের জন্য কমিয়ে রাখা হলেও কিছু নীতিগত বিষয় ঠিক হলে এটির গতি বাড়ানো হবে। অন্যদিকে, ‘‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’’ এখন সরাসরি অর্থায়নের বদলে ‘‘ফান্ড অব ফান্ডস’’ মডেলে কাজ করবে। স্টার্টআপ খাতকে সহযোগিতা করতে জাইকার সহযোগিতায় প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করা নিয়েও আমরা কাজ করছি।’
কর্মশালায় আরও বক্তব্য দেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি (ভারপ্রাপ্ত) সেনালী দয়ারাত্নে ও কান্ট্রি ইকোনোমিক অ্যাডভাইজর ওয়েইস প্যারে, বিডার ব্যবসায় উন্নয়ন প্রধান নাহিয়ান রহমান প্রমুখ।