বেক্সিমকো গ্রুপ নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে থাকা ২৩ একর জমি বন্ধক রেখে ৭০০ কোটি টাকা ঋণ চায়। গ্রুপটি এ ঋণ চায় ‘শুধু চার মাসের জন্য’, যা পেলে তারা কারখানাগুলো পরিচালনা এবং ধীরে ধীরে ব্যাংকের আগের দায় পরিশোধ করতে পারবে। এ লক্ষ্যে বছরে ৪০০ কোটি টাকা করে বকেয়া ঋণ পরিশোধের পরিকল্পনা সরকারের কাছে জমা দেওয়া আছে। কিন্তু সরকার বা ব্যাংক কিছুই বলছে না।
আজ বৃহস্পতিবার ঢাকার পল্টনে ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘বেক্সিমকোর লে-অফকৃত সব কারখানার ব্যাংকিং সুবিধাসহ কারখানা খুলে দেওয়া’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এমন দাবির কথা তুলে ধরা হয়। বেক্সিমকোর শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তারা এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এতে বক্তব্য দেন বেক্সিমকো ফ্যাশন লিমিটেডের প্রশাসন বিভাগের প্রধান সৈয়দ মো. এনাম উল্লাহ ও বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের প্রশাসন বিভাগের প্রধান আবদুল কাইয়ুম। এ সময় বেক্সিমকো গ্রুপের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেল এফ রহমান বিদেশে রয়েছেন। ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান আছেন কারাগারে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওসমান কায়সার চৌধুরী। চেয়ারম্যান ও এমডির সঙ্গে কথা বলেই এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয় বলে গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান।
লে-অফ প্রত্যাহার করে তিনটি দাবির কথা জানানো হয়। এগুলো হচ্ছে—গার্মেন্টস বিভাগের সব কারখানা চালু করা, ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খোলার অনুমতি প্রদান করা এবং কারখানা ও ব্যবসা চালু রেখে বকেয়া বেতন ও কোম্পানির দায়-দেনা পরিশোধের সুযোগ দেওয়া।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বেক্সিমকোর ১৬টি কারখানা এখন লে-অফ বা বন্ধ। জানুয়ারি পর্যন্ত বেতন-মজুরি পাওয়া গেলেও ফেব্রুয়ারি থেকে পুরোপুরি সব বন্ধ হয়ে যাবে। এতে ৪২ হাজার মানুষ চাকরি হারাবেন, বেতন-মজুরিও আর পাওয়া হবে না। এই ৪২ হাজার মানুষের সঙ্গে বেক্সিমকো শিল্পপার্কের আশপাশের দোকানদার, অটোরিকশাচালক ও স্কুল-মাদ্রাসা মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ মানুষের রুটি-রুজি জড়িত। সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হলে মানবেতর জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে তাঁদের এবং তখন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার নতুন সংকটও তৈরি হতে পারে।
ঋণ আদায় করতে হলে প্রতিষ্ঠান চালু রাখাই উত্তম বিকল্প এবং প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বেক্সিমকোর কাছ থেকে ঋণ আদায় করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বক্তারা। বেক্সিমকোর ৪২ হাজার কর্মজীবীর মধ্যে প্রায় ২ হাজার প্রতিবন্ধী, শতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এবং ৫ হাজারের মতো ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি রয়েছেন—এ তথ্য উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, এশিয়া মহাদেশেরই একটি বড় শিল্প গ্রুপ বেক্সিমকো। এর গার্মেন্টস ডিভিশনই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মাসে প্রায় ৩০ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে দেশের রপ্তানি আয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করত।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বর্তমান সময়ের উপযোগী যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি আর দক্ষ জনবল নিয়ে তিল তিল করে গড়ে ওঠা আজকের বেক্সিমকোর পোশাক কারখানাগুলো মরিচা ধরার অপেক্ষায়। মাসে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ পিস গার্মেন্টস পণ্য তৈরির সক্ষমতা রয়েছে বেক্সিমকোর। আছে অত্যাধুনিক মেশিনে সজ্জিত প্রিন্টিং, এমব্রয়ডারি ও অ্যাকসেসরিজ তৈরির কারখানা। বিদেশি ক্রেতাদের প্রধান আকর্ষণ বেক্সিমকোর কারখানা, যেখানে কার্যাদেশ দিতে বিদেশিরা সব সময় তৎপর থাকেন। তুলা ও কেমিক্যাল ক্রয় ছাড়া গার্মেন্টস তৈরির অন্য কিছুই বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় না এই গ্রুপকে।
লাভজনক, সুবিধাজনক ও শ্রমঘন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে ১০ লাখ মানুষের মুখের আহার কেড়ে নিয়ে এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধির ধারা ব্যাহত করে বর্তমান জননন্দিত সরকার কী সুবিধা লাভ করছে, তা বেক্সিমকোর কর্মীদের জানা নেই বলে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ব্যক্তি দোষ করলে আইন অনুযায়ী প্রতিকার হবে। প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এ জন্য শাস্তি পেতে পারেন না।
বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের প্রশাসন বিভাগের প্রধান আবদুল কাইয়ুম বলেন, সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে দায় পরিশোধের চাপ সৃষ্টি শুধু অমানবিকই নয়, অন্যায্যও। এই দায় বহন করার সক্ষমতা কোনো সরকারের বা ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। কারখানা বন্ধ রাখার প্রক্রিয়া যতই প্রলম্বিত হবে, বেক্সিমকোর দায়ও তাতে বাড়তে থাকবে। তিনি প্রশ্ন রাখেন ‘জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে আমরাও ছিলাম। সেই বিপ্লব যদি হয়ে থাকে বৈষম্য লাঘবের জন্য, তাহলে আমরা কেন বৈষম্যের শিকার হব?’
গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টে এক শুনানিতে বেক্সিমকো গ্রুপের দায়ের পরিমাণ তুলে ধরেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী মুনীরুজ্জামান। সেদিন তিনি জানিয়েছিলেন, ১৬টি ব্যাংক ও সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বেক্সিমকো গ্রুপের ৭৮টি প্রতিষ্ঠানের দায়ের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ হিসাব ২০২৪ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের।