
হাত দিয়েছেন বাড়ি তৈরির কাজে। পরিকল্পনা গোছাতেই হিমশিম অবস্থা। আর উপকরণের তালিকা বানাতে গিয়ে এলোমেলো লাগছে, তাই না? হতেই পারে। কারণ, একটি পূর্ণাঙ্গ বাড়ি তৈরিতে ১৪ ধরনের মিস্ত্রির পাশাপাশি ২৫৬ প্রতিষ্ঠানের প্রায় এক হাজার উপকরণ লাগে। এই হাজারো উপকরণের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো ইট। বলা যায়, ভবন তৈরিতে ইটের ব্যবহারই হয় সবচেয়ে বেশি। যদিও বর্তমানে ইটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব ব্লকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লকে ঘর বানানোর চর্চা বাড়ায় দেশে ইটভাটার কারণে পরিবেশের ক্ষতি বন্ধে নতুন আশা সৃষ্টি করেছে। ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব, সাশ্রয়ী ও তুলনামূলক ভূমিকম্পসহনীয় হওয়ায় দেশের নির্মাণ খাতে বাড়ছে ব্লকের চাহিদা।
পলিকংক্রিট নরওয়ে-বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফেরদৌস শেখ বলেন, ইটের পরিবর্তে ব্লকের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও নির্মাণে ব্লক ব্যবহার করার বলা হয়েছে।
২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে সব সরকারি নির্মাণকাজে প্রচলিত ইটের পরিবর্তে শতভাগ পরিবেশবান্ধব ব্লক ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছে। ফলে, পরিবেশবান্ধব ইকো–ব্লকের নানান সুবিধা ও প্রচলিত ইটভাটা থেকে সৃষ্ট পরিবেশের ক্ষতি রোধের দায়বদ্ধতা থেকে মানুষ ক্রমে পরিবেশবান্ধব ঘর তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের কারণে সারা দেশেই প্রচুর পাকা দালান নির্মিত হচ্ছে। সার্বিক সুবিধা বিবেচনায় মানুষ এখন কাঠ ও টিনের ঘরের বদলে ইট-সিমেন্টের ঘর বানাচ্ছে। ফলে, বেড়ে গেছে ইটের চাহিদা। বাংলাদেশে সাধারণত জমির উপরিভাগের মাটি পুড়িয়ে ইট প্রস্তুত করা হয়। এ কারণে এতে পরিবেশের নানামুখী ক্ষতি হচ্ছে। প্রথমত, এমনিতেই এ দেশে আবাদি জমির পরিমাণ অপ্রতুল। ইটভাটার জন্য এই জমি আরও সংকুচিত হচ্ছে। ইটভাটাসংলগ্ন জমিও হারাচ্ছে তার উর্বরতা। দ্বিতীয়ত, ইট পোড়ানোর কারণে উজাড় হয়ে যাচ্ছে বৃক্ষসম্পদ। গাছ কাটা হচ্ছে ইটভাটায় পোড়ানোর জন্য। তৃতীয়ত, ইটভাটা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া দূষিত করছে বাতাস এবং হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য।
এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে ইটের বিকল্প ও ব্যয়সাশ্রয়ী নির্মাণ-উপকরণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচবিআরআই)। এইচবিআরআইয়ের কর্মীরা জানান, উদ্ভাবিত এই ব্লক ব্যবহার করলে ভবনের নির্মাণব্যয় ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। তবে এখন পর্যন্ত এই প্রযুক্তি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি বলে দেশবাসী এর সুফল এখনই পাবে না।
রাজধানী ঢাকার মিরপুর রোডের দারুস সালামে বিশাল জায়গাজুড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত এ গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অবস্থিত। এর গবেষণাগারে প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে বিকল্প নির্মাণ-উপকরণ ও প্রযুক্তি উন্নয়নের। নদী ড্রেজিং করে যে বালুমাটি পাওয়া যায়, তার সঙ্গে ১০ শতাংশ হারে সিমেন্ট মিশিয়ে উচ্চচাপে ব্লক বানানো সম্ভব হয়েছে, যা সাধারণ ইটের চেয়ে গুণগত মানে ভালো এবং দামে কম।
এইচবিআরআইয়ের মতে, এ পর্যন্ত বিকল্প নির্মাণসামগ্রী হিসেবে ৩০ ধরনের কংক্রিট ব্লক উদ্ভাবন করা হয়েছে। এগুলো পরিবেশবান্ধব, মূল্যসাশ্রয়ী, ওজনে হালকা; ভূমিকম্প, আগুন ও লবণাক্ততা প্রতিরোধী এবং অতি উষ্ণ বা অতি শীতল আবহাওয়ার বিপরীতে নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ দেয়। এসব ব্লক তৈরিতে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহারের পরিবর্তে নদীর তলদেশের মোটা বালু ও সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়। কখনো ফ্লাইঅ্যাশ, পাথরের ধুলো বা অন্যান্য সামগ্রীও ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের ব্লকের মধ্যে রয়েছে কমপ্রেশড স্ট্যাবিলাইসড আর্থ ব্লক (সিএসইবি), ইন্টার লিংকিং সিএসইবি, কংক্রিট হলোব্লক, থার্মাল ব্লক (টিবি), ফেরো সিমেন্ট স্যান্ডউইচ প্যানেল, সেলুলার ব্লক, ফ্লাইঅ্যাশ ব্রিক ও অন্যান্য।
বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কনকর্ড গ্রুপ অব কোম্পানি বিশেষ করে পেভমেন্ট, দেয়াল ও ছাদের জন্য ব্লক তৈরি করছে। মীর সিরামিক মেঝে, দেয়াল, সিঁড়ির জন্য তৈরি করছে পরিবেশবান্ধব টাইলস। এ ছাড়া মেঘনা গ্রুপ, এসিআই, রূপায়ণ গ্রুপ, ইস্টার্ন হাউজিংসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এ কাজে সম্পৃক্ত আছে।
রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ‘বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াস লিমিটেড’ রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এইচবিআরআইয়ের সহযোগিতায় পরিবেশবান্ধব সামগ্রী দিয়ে বহুতল ভবন তৈরি করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের সহযোগিতায় গ্রামে ব্লক বানানোর প্রকল্প চলমান।