
আমের প্রত্যাশিত দাম পাচ্ছেন না চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে এখন আমের দাম গড়পড়তায় প্রতি কেজি ২০ টাকা। আমের মানভেদে দাম ১৬-১৭ টাকায় শুরু হয়, ওঠে ৩০ টাকা পর্যন্ত। আমের মান ও দর-কষাকষির ওপর দাম নির্ভর করছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এখন হিমসাগর আমের ভরা মৌসুম।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কানসাটের বাজারে আমচাষি, আড়তমালিক, আমের ব্যাপারীদের ভিড় লেগেই থাকে। মৌসুমি আম ক্রেতারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট, বানেশ্বরের পাশাপাশি রাজশাহীতে ছুটছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট বাজার সরেজমিন ঘুরে এ চিত্র পাওয়া গেছে। কানসাট বাজার দেশের সবচেয়ে বড় আমের বাজার হিসেবে পরিচিত। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ ওই অঞ্চলে এখন আমের ভরা মৌসুম। চাষি পর্যায়ে এবার আমের দাম বেশ কম। তাঁরা প্রত্যাশিত দাম পাচ্ছেন না। কারণ, ঈদের লম্বা ছুটি ও অতিরিক্ত গরম।
অন্যদিকে রাজধানীর ঢাকার বাজারে হিমসাগর বিক্রি হচ্ছে গড়ে প্রতি কেজি ৮০ টাকা। তবে ৬০-৭০ টাকায়ও হিমসাগর মিলছে।
কানসাট থেকে যে দামে আম কেনা হয়, এর চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি দামে ঢাকার বাজারে বিক্রি হচ্ছে। অবশ্য এর সঙ্গে পরিবহন খরচ যুক্ত হয়।
সরেজমিন কানসাট বাজার
গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কানসাট বাজারে যান প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, শত শত ভ্যানগাড়িতে আম আনছেন আমচাষিরা। বাজারের আশপাশের গলিপথে শুধু আমবোঝাই ভ্যান আর ভ্যান। আশপাশের শিকারপুর, মোবারকপুর, বাজিতপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আমচাষিরা আম নিয়ে এসেছেন। ভ্যানের ওপর প্লাস্টিকের ক্যারেট (প্লাস্টিকের চার কোনাকৃতির ঝুড়ি), বাঁশের ঝুড়িতে আম বোঝাই করে বাজারে আম আনা হয়।
জানা যায়, প্রতিদিনই কানসাট বাজারের মূল সড়কে এক-দুই কিলোমিটারজুড়ে যানজট তৈরি হয়। বিভিন্ন জেলায় আমের চালান নেওয়ার জন্য প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান আসে কানসাটে। কুরিয়ার সার্ভিসের জমজমাট ব্যবসাও আছে।
আমের আড়তগুলোয় গিয়ে দেখা গেছে, আমের ম–ম গন্ধ। আড়তদারেরা সকাল থেকেই আমচাষিদের নিয়ে আসা ভ্যানবোঝাই আম কিনছেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত চলে জমজমাট ব্যবসা। ক্রেতাদের আম দিয়ে অ্যাপ্যায়নও করেন বিক্রেতারা। বিকেল হতেই বেচাকেনা কমতে থাকে। এখন কানসাটে হিমসাগর আমের ভরা মৌসুম চলছে। ল্যাংড়াসহ অন্যান্য আমও ওঠা শুরু হয়েছে।
দাম কত
কানসাট বাজারে মণ হিসেবে আমের দরদাম ঠিক করা হয়। ৫০ কেজিতে এক মণ ধরা হয় এখানে। জানা গেছে, আমের দাম নির্ধারণ হয় তিনভাবে। চার-পাঁচ দিন পরে পাকবে বা খাওয়ার উপযোগী হবে, এমন আমের দাম প্রতি মণ ১ হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা। এক কেজির দাম পড়ে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এসব আম আকারে বড় ও তাজা। দু-তিন দিনের মধ্যে পাকবে, এমন আম বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। প্রতি কেজির দাম পড়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা। এ ধরনের আম বেশি বেচাকেনা হয়। একদম পাকা আমের দাম প্রতি মণ আট শ থেকে এক হাজার টাকা।
বিক্রেতারা জানান, আম পেকে গেলে দ্রুত পচন ধরে। ফলে কম দামেই আম বিক্রি করতে বাধ্য হন। এ ছাড়া আমের আকার ও জাত অনুসারেও দাম ওঠানামা করে।
কানসাট এলাকার আমচাষি গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, এবার ঈদের লম্বা ছুটির কারণে আম বেচাকেনা কম হয়েছে। এ ছাড়া ছুটির সময় বেশ গরম পড়েছে। তাই আম দ্রুত পেকে যাচ্ছে। ছুটির কারণে চাহিদাও কম। এসব কারণে এখন লোকসান এড়াতে কম দামেই আম বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে জানান গোলাম মোস্তফা।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কানসাট থেকে এখন প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলায় কয়েক শ টন আমের চালান যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যাঁরা আম বিক্রি করেন, তাঁদের প্রতিনিধিরা কানসাটে গিয়ে আম কিনে কুরিয়ারে গ্রাহকের কাছ পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আবার মৌসুমি আম বিক্রেতারাও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে আম কিনতে আসছেন।
আবার ঈদের লম্বা ছুটির কারণে অনেকে বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজন নিয়ে রাজশাহী অঞ্চলে ঘুরতে এসেছেন। তাঁদের অনেকেই কানসাট কিংবা বানেশ্বর এসে আম কিনছেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে কানসাট বাজারে মোতাহারুল ইসলাম নামের এমন একজন ক্রেতার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বেসরকারি চাকরিজীবী মোতাহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এবার ১০ দিন ছুটি হওয়ায় বন্ধুরা মিলে রাজশাহী অঞ্চলে ঘুরতে এসেছেন। কানসাটে এসে আম কিনে কুরিয়ারে আত্মীয়স্বজনের বাসায় পাঠিয়েছেন। তিনি জানান, ২০ ও ২৫ টাকা দরে তিনি আমদানি কিনেছেন।
পরিবহন খরচ কত
কানসাট থেকে আম কিনে পাঠাবেন কীভাবে। সহজ উত্তর-কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দেবেন। কানসাট বাজারে ১৪-১৫টি কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি কার্যালয় আছে। আমের মৌসুমে কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবসা জমজমাট থাকে। সকাল থেকে প্লাস্টিকের সাদা ব্যাগে মোড়ানো আমবোঝাই শত শত কার্টন ও ক্যারেট এসব কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয়ে জমা হতে থাকে। দুপুরের পর থেকে ট্রাকে বোঝাই করে গন্তব্যে পাঠানো হয়। এসএ পরিবহন, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস, জননী কুরিয়ার সার্ভিসে বেশি ভিড় হয়।
জানা গেছে, এক কেজি আম ঢাকায় পাঠাতে কুরিয়ার সার্ভিসে খরচ হয় ১২ টাকা। চট্টগ্রামসহ ওই অঞ্চলের জেলায় কেজিতে খরচ ১৬ টাকা। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে ঢাকা শহরের ভেতরে হোম ডেলিভারি নিতে হলে কেজিতে খরচ পড়বে ২০ টাকা।
আমের পাইকারেরা ট্রাক ভাড়া করে আমের চালান আনেন। সে ক্ষেত্রে খরচ আরও কম। এক ক্যারেট আম ঢাকায় পাঠাতে খরচ পড়ে ১০০ টাকা। প্রতি ক্যারেটে গড়ে ২৫ কেজি আম আনা যায়। সে ক্ষেত্রে কেজিতে আমের পরিবহন খরচ হয় ৪ টাকা। এ ছাড়া ক্যারেটের দাম ১৬০-১৮০ টাকা। ফলে কেজিতে খরচ পড়ে ৭ টাকার মতো। কাগজের কার্টনে পাঠালে খরচ আরও কম।
২০ টাকা কেজি আম কিনে ক্যারেটবন্দী করে ঢাকায় পৌঁছাতে খরচ হয় আরও ১১-১২ টাকা। ঢাকা বাজারে পৌঁছানোর পর এক কেজি হিমসাগর আমের দাম পড়ে ৩২ টাকা।
ঢাকা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি
কানসাট থেকে ঢাকার বাজার পর্যন্ত পরিবহন খরচসহ মোটামুটি মানের হিমসাগর আমের দাম পড়ে কেজিতে গড়ে ৩২ টাকা। আজ শনিবার কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মোটামুটি ভালোমানের হিমসাগর আম বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি। তবে মানভেদে ৬০-৭০ টাকা কেজিও হিমসাগর আম মিলছে। তবে ল্যাংড়া, আম্রপালি এসব আমের দাম কিছুটা কম।
এদিকে উত্তরা, মহাখালী, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকার বাজারে হিমসাগর আম প্রতি কেজি ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অনলাইনে আম কিনলে হোম ডেলিভারিসহ দাম পড়ে কেজিতে ১০০-১১০ টাকা। আমচাষি যে দামে আম বিক্রি করেন, ঢাকার বাজারে এর চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি দামে বিক্রি হয়।