মার্কিন শীর্ষ ধনীদের সম্পদ গত বছর অনেকটাই বেড়েছে। অঙ্কটা দেখলে অনেকেরই চোখ কপালে উঠতে পারে। সম্পদবৈষম্য নিয়ে অক্সফামের নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর শীর্ষ ১০ মার্কিন শতকোটিপতির সম্পদ বেড়েছে ৬৯৮ বিলিয়ন বা ৬৯ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। খবর দ্য গার্ডিয়ান।
বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৮৫ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকারের বাজেট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ বাংলাদেশের বাজেটের প্রায় ১০ দশমিক ৮ গুণ সম্পদ বেড়েছে এই ধনীদের।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে নীতি গ্রহণ করেছেন, তার জেরে মার্কিন সমাজের অসমতা নতুন উচ্চতায় উঠেছে। তবে তাঁরা শুধু ট্রাম্প প্রশাসন নয়, এই ক্রমবর্ধমান অসমতার জন্য ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান—উভয় গোষ্ঠীকেই দায়ী করেছেন।
গবেষকেরা দেখিয়েছেন, ১৯৮৯ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ধনী–গরিবের সম্পদের ব্যবধান অনেকটাই বেড়েছে। শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর হাতে পুঞ্জীভূত সম্পদের পরিমাণ নিচের সারির মানুষের তুলনায় অনেক দ্রুতগতিতে বেড়েছে। ব্যবধানটা অনেক বেশি। দেখা যাচ্ছে, গড়পড়তা পরিবারের তুলনায় শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর সম্পদ বেড়েছে ১০১ গুণ। সেই সঙ্গে নিচের সারির ২০ শতাংশ পরিবারের তুলনায় এই শ্রেণির মানুষের সম্পদ বেড়েছে ৯৮৭ গুণ। এর অর্থ হলো, শীর্ষ ১ শতাংশ পরিবারের হাতে সম্পদ বেড়েছে ৮ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন বা ৮৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার। একই সময়ে গড়পড়তা পরিবারের হাতে সম্পদ এসেছে ৮৩ হাজার ডলারের।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ নিম্ন আয়ের; তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই শিশু। তাদের পারিবারিক আয় জাতীয় দারিদ্র্যসীমার দ্বিগুণের কম।
৩৮টি ধনী দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডির দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আপেক্ষিক দারিদ্র্য সবচেয়ে বেশি। আরও পরিষ্কারভাবে বললে, শিশু দারিদ্র্য ও মৃত্যুর দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। গড় আয়ুর দিক থেকেও তারা দ্বিতীয় সর্বনিম্ন।
অক্সফাম আমেরিকার নীতিবিশেষজ্ঞ রেবেকা রিডেল দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘কোনো দেশে অসমতা থাকবে কি থাকবে না, তা মূলত নীতিগত বিষয়। এই তুলনা থেকে বোঝা যায়, সমাজে দারিদ্র্য ও অসমতার বেলায় আমরা ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারি।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কর কাঠামো, সামাজিক নিরাপত্তা ও শ্রমিকের সুরক্ষাব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এতে যেমন নির্দিষ্ট শ্রেণির হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে, তেমনি ক্ষমতাও কুক্ষিগত হয়েছে। গত মে মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে কর বিল পাস হয়েছে, সেটাকে এর অন্যতম কারণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই বিলের মাধ্যমে কর হ্রাস করে ধনী ও করপোরেটদের সম্পদ ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এই অসম পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট—উভয় দলই দায়ী। গত কয়েক দশকে তারা যে ধরনের নীতির প্রণয়ন করেছে, তার জেরে আজ মার্কিন সমাজে অসমতা। এতে ধনীদের কর আরও কমেছে এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল হয়েছে।
ক্রমবর্ধমান এই অসমতা আমলে নেওয়ার জন্য বেশ কিছু সুপারিশও দিয়েছে অক্সফাম। এর মধ্যে আছে অ্যান্টি ট্রাস্ট পলিসি ও অর্থায়নের প্রক্রিয়া পুনর্গঠনের প্রচারণা শুরু করা। করব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে ধনী ও করপোরেটদের কর বৃদ্ধি করা, সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা ও ইউনিয়ন গঠনের অধিকার সুরক্ষিত রাখা, এসবও জরুরি হয়ে পড়েছে।
কিন্তু সমাজের সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা ও কর নিয়ে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব আছে; সেই সঙ্গে আছে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। অনেক মানুষ মনে করে, করব্যবস্থা একধরনের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা।
রিডেল বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে আমাদের নতুন ধরনের রাজনীতি দরকার; যে রাজনীতি দ্রুততার সঙ্গে অসমতা কমিয়ে এনে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করবে। এসব নীতি উচ্চমার্গীয় বিষয় নয়। সংস্কারের মাধ্যমে যে অনেক দূর যাওয়া যায় বা এই প্রবণতার গতিমুখ উল্টে দেওয়া যায়, তা আমরা দেখেছি।’
এই প্রতিবেদন প্রণয়নে অক্সফাম যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় পর্যায়ে বেশ কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে, বিশেষ করে ইউনিয়ন নেতৃত্বের। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় পর্যায়ে এই অসমতা মোকাবিলার চেষ্টা আছে, যদিও জাতীয় পর্যায়ে এর গতি একেবারেই কম।
ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স মেরিল্যান্ডের একজন ইউনিয়ন প্রতিনিধি বলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে কিছু পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখন অনেক মানুষই মনে করছে, বিদ্যমান অবস্থায় হাতে গোনা কিছু মানুষ লাভবান হচ্ছে। এই উপলব্ধি থেকে বৃহৎ পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।
রিডেল বলেন, এই পরিস্থিতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, মানুষ তার শক্তি ও প্রভাব বুঝতে পারছে।