ছবি: চাকরি–বাকরি
ছবি: চাকরি–বাকরি

কারণ ছাড়াই চাকরিচ্যুতি ও নেতিবাচক পুলিশ প্রতিবেদন: আতঙ্কে চাকরিপ্রত্যাশীরা

বিসিএস ক্যাডারসহ সরকারি চাকরির চূড়ান্ত নিয়োগ বা বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ ধাপে এসে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার শিকার হচ্ছেন অনেক চাকরিপ্রার্থী। কারও ক্ষেত্রে কারণ দর্শানো ছাড়াই চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। কারও কারও নিয়োগ আটকে যাচ্ছে পুলিশ বা নিরাপত্তা সংস্থার নেতিবাচক প্রতিবেদনের কারণে। সম্প্রতি এমন কয়েকটি ঘটনায় সরকারি নিয়োগপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পাশাপাশি চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে হতাশা ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

কারণ ছাড়াই অপসারণ: প্রশ্নবিদ্ধ সরকারি নিয়োগ

সরকারি চাকরির নিয়োগপ্রক্রিয়ার শেষ ধাপে এসে কারণ ছাড়াই অপসারণের ঘটনা প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। সম্প্রতি ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণরত তিনজন শিক্ষানবিশ সহকারী কমিশনারকে চাকরি থেকে অপসারণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অপসারিত ব্যক্তিরা হলেন কাজী আরিফুর রহমান, অনুপ কুমার বিশ্বাস ও নবমিতা সরকার।

প্রজ্ঞাপনে ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮১’-এর বিধি ৬(২)(এ) অনুযায়ী তাঁদের নিয়োগ বাতিলের কথা বলা হয়েছে। এই বিধি অনুযায়ী, শিক্ষানবিশ মেয়াদে কোনো কর্মকর্তাকে ‘চাকরিতে বহাল থাকার অযোগ্য’ মনে হলে পিএসসির পরামর্শ ছাড়াই নিয়োগ বাতিল করা যায়। তবে প্রজ্ঞাপনে তিন সহকারী কমিশনারকে অযোগ্য ঘোষণার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করা হয়নি।

অপসারিত কাজী আরিফুর রহমান ৪১তম বিসিএসে রেলওয়ে ক্যাডারে প্রথম এবং ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে ৩০তম হয়ে উত্তীর্ণ হন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কোনো কারণ উল্লেখ না করে এভাবে অপসারণ করায় আমি ও আমার পরিবার মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছি।’ তিনি জানান প্রজাতন্ত্রের একজন জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে আমি ১১ মাস ফরিদপুর জেলা প্রশাসনে যুক্ত থেকে কাজ করেছি। সেই সময়েও আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। এর আগে ৪১তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে আমি রেল ক্যাডারেও চাকরি করেছি।’

মনে রাখা উচিত, সরকারি চাকরিজীবীদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রভু-ভৃত্যের নয়। ইচ্ছা হলেই কাউকে চাকরিচ্যুত করা যায় না। আমার অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের বিষয় আদালতে উঠলে চাকরিচ্যুতির আদেশ টিকবে না।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া

চাকরিচ্যুতিতে সরব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যা বললেন সারজিস আলম

৪৩তম বিসিএসে এই তিন প্রার্থীর বাইরেও পররাষ্ট্র ক্যাডারে দুজন, নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডারে দুজন, সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে দুজন এবং পুলিশ ক্যাডারে চারজন প্রার্থীকে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় চাকরিচ্যুত করেছে বর্তমান সরকার। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিষয়টি নিয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।

কাজী আরিফুর রহমানের চাকরিচ্যুতি প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে সারজিস আলম ফেসবুকে লিখেছেন, আরিফুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অমর একুশে হল ডিবেটিং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্টস স্কাউট, হল থেকে প্রভোস্ট অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবৃত্তিতে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কখনো অন্যায় কিংবা অপকর্মের অভিযোগ ওঠেনি। অমর একুশে হলের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে তিনি ছিলেন ‘রোল মডেল’ এবং অন্যতম সেরা আবাসিক শিক্ষার্থী।

সারজিস আলম তাঁর স্ট্যাটাসে আরও উল্লেখ করেন, ‘তাঁর (আরিফুর রহমান) সঙ্গে যা হয়েছে, তা পরিষ্কার অন্যায়। তিনি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা স্বার্থবিরোধী কোনো অপেশাদার আচরণ করলে ভিন্ন কথা ছিল।’ মেধাবী শিক্ষার্থীদের এভাবে বাদ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. এহছানুল হকের দপ্তরে গত ২৬ নভেম্বর ২০২৫ যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, তিনি বৈঠকে আছেন। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। জনসংযোগ কর্মকর্তা মানসুর হোসেনের পরামর্শে হোয়াটসঅ্যাপে সচিবের কাছে প্রশ্ন পাঠানো হলেও প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো জবাব মেলেনি।

পেট্রোবাংলায় অস্বচ্ছতার অভিযোগ

বিসিএস ক্যাডারের বাইরে পেট্রোবাংলা ও এর অধীন কোম্পানিগুলোর সমন্বিত নিয়োগপ্রক্রিয়াতেও একই ধরনের অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে। সব ধাপ সফলভাবে সম্পন্ন করার পর চূড়ান্ত তালিকা থেকে ১৫ জন প্রার্থী বাদ পড়েছেন। বাদ পড়া এক প্রার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাকরির আশায় আগের চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। সরকারি চাকরির বয়সও শেষ। এখন পরিবার নিয়ে মহাবিপদে পড়েছি। মা-বাবা অসুস্থ, ওষুধ কেনার টাকাও নেই।’

এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রশাসন) এস এম মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগপ্রক্রিয়ার কোনো ধাপে উত্তীর্ণ হতে না পারলেই কেউ বাদ পড়ে। চূড়ান্ত নিয়োগ না হলে কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয় না। চাকরিপ্রার্থীরা মনে করছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ যোগ্য প্রার্থীদের কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতিই করছে না, বরং সরকারি নিয়োগপ্রক্রিয়ার ওপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকেও ক্ষুণ্ন করছে।

পুলিশি যাচাইয়ে আটকে যাচ্ছে মেধাবীদের ভবিষ্যৎ

তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও পুলিশ বা নিরাপত্তা সংস্থার নেতিবাচক প্রতিবেদনের (ভেরিফিকেশন) কারণে বহু মেধাবী প্রার্থীর চূড়ান্ত নিয়োগ আটকে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে এই সংকট চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার ২৮তম থেকে ৪২তম বিসিএসে বাদ পড়া এমন ২৫৯ জন প্রার্থীকে ২০২৪ সালে ১৪ আগস্ট নিয়োগ দিয়েছিল, যা প্রশংসিত হয়। তবে চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, পুলিশ ভেরিফিকেশন জটিলতা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক নিয়োগ আটকে থাকছে। প্রার্থীদের অভিযোগ, পিএসসির সুপারিশপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয়ের বিবেচনায় ভেরিফিকেশনে বাদ দেওয়া সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। সংবিধানে নাগরিকের অধিকার ও সুযোগের সমতার নিশ্চয়তা দেওয়া হলেও চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। মূলত প্রার্থীর ফৌজদারি মামলার তথ্যের পাশাপাশি পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই করা হয়, যা অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রতিবেদনের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশিক্ষণরত অবস্থায় কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়া কাউকে চাকরিচ্যুতি কাম্য নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব একটা ঘটেনি। প্রশিক্ষণকালে কেউ গুরুতর অসদাচরণ করলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হতে পারে। কিন্তু কারণ ছাড়াই চাকরিচ্যুতি সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’

মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, ‘মনে রাখা উচিত, সরকারি চাকরিজীবীদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রভু-ভৃত্যের নয়। ইচ্ছা হলেই কাউকে চাকরিচ্যুত করা যায় না। এ ধরনের ঘটনা প্রশাসনে অস্থিরতা তৈরি করবে। আমার অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের বিষয় আদালতে উঠলে চাকরিচ্যুতির আদেশ টিকবে না।’