ঢাকার সাত কলেজে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে নানা দাবিতে আন্দোলন করেছেন
ঢাকার সাত কলেজে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে নানা দাবিতে আন্দোলন করেছেন

ঢাকার সাত কলেজ: বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর আগেই তীব্র সেশনজটে শিক্ষার্থীরা 

২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির কাজই শেষ হয়নি। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ-ছয় মাস আগে ক্লাস শুরু, নতুন ভর্তিও সামনে। 

ঢাকা কলেজ চত্বরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে শিক্ষার্থীরা ভর্তি-সংক্রান্ত কাগজপত্র পূরণ করছিলেন। তাঁদের কেউ এসেছেন অভিভাবক নিয়ে, কেউ আবার একাই। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা কলেজে দেখা মিলল এমন দৃশ্যের। ঢাকার সাত কলেজ নিয়ে প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির’ অধীনে চলমান ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তির অংশ হিসেবে এখানে ভর্তি কার্যক্রম চলছে।

কিন্তু সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা যখন ভর্তির কাজ করছেন, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চলতি শিক্ষাবর্ষের প্রায় পাঁচ মাস ক্লাস করে ফেলেছেন। এমনকি আসন্ন ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তির আবেদনও ১৯ নভেম্বর শেষ হয়েছে। ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে ২৮ নভেম্বর, আর পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা শেষ হবে ২০ ডিসেম্বর। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও প্রায় একই।

অথচ ঢাকার সরকারি সাত কলেজে ভর্তির কাজ শেষ করে এখনো ক্লাস শুরু হয়নি। আজ রোববার ক্লাস শুরুর সম্ভাব্য একটি তারিখ ছিল। কিন্তু নতুন করে ভর্তিসংক্রান্ত কার্যক্রমের সময় ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এখন ক্লাস শুরুর সম্ভাব্য তারিখ ৩০ নভেম্বর।

ঢাকা কলেজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষার্থী ভর্তি ও পাঠদান আইনসিদ্ধ নয়। ‘কাঠামো কী হবে, আমরা কোন অবস্থানে থাকব—এগুলো এখনো পরিষ্কার নয়। তাই এসব নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত প্রথম বর্ষে ক্লাস নেওয়ার পক্ষে নই,’ বলেন তিনি। 

এ রকম পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই শিক্ষার্থীরা পড়েছেন তীব্র সেশনজটে। তাঁরা জানিয়েছেন, দ্রুত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে অধ্যাদেশ প্রকাশ ও ক্লাস শুরু না হলে তাঁরা আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবেন।

এ পরিস্থিতির সমাধান সহজ—কর্তৃপক্ষ যদি শিক্ষক ও অধিকাংশ শিক্ষার্থীর প্রত্যাশিত মডেলে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করে। 
এ কে এম ইলিয়াস, অধ্যক্ষ, ঢাকা কলেজ ও অন্তর্বর্তী প্রশাসক, ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি

সংকট ও শিক্ষার্থীদের বিড়ম্বনা

আগে থেকেই ঢাকার এই সাত সরকারি কলেজে সংকট বিরাজ করছে। ২০১৭ সালে যথেষ্ট প্রস্তুতি ছাড়াই এগুলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল। সরকারি এই কলেজগুলো হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ ও তিতুমীর কলেজ। এর মধ্যে ইডেন ও তিতুমীরে শুধু স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়; বাকি পাঁচটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর—তিন স্তরেই পাঠদান হয়। এগুলোতে শিক্ষার্থী দেড় লাখের মতো। চলতি শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তিযোগ্য আসন ১১ হাজারের মতো। ৭ কলেজে মোট শিক্ষক হাজারের বেশি।

আলাদা স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। ২১ অক্টোবর ২০২৪ তোলা

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই সাত কলেজকে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পৃথক করার ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চূড়ান্ত হওয়ার আগেই অধিভুক্তি বাতিল হওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। এখন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষকে প্রশাসক করে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থায় কার্যক্রম চলছে।

সম্প্রতি সাত কলেজকে একীভূত করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করার সরকারি পরিকল্পনা আলোচনায় আসে। কিন্তু এর কাঠামো নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভিন্ন মত রয়েছে। সংকট কাটার পরিবর্তে নতুন জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ১৮ থেকে ২০ নভেম্বর টানা তিন দিনের কর্মবিরতি পালন করেছেন শিক্ষকেরা। 

এর মধ্যে আবার ভর্তিপ্রক্রিয়াতেও জট দেখা দিয়েছে। গত আগস্টে ভর্তি পরীক্ষা হলেও জটিলতার কারণে এখনো ভর্তি শেষ করা যায়নি। শিক্ষকদের আন্দোলনের সময়ে কর্মচারীদের দিয়ে ভর্তির কাজ করেছে ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ।

গত বৃহস্পতিবার ঢাকা কলেজে গিয়ে কথা হয় অর্থনীতি, ইংরেজি, মনোবিজ্ঞান, পরিসংখ্যানসহ কয়েকটি বিভাগে ভর্তি হতে আসা কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। ভর্তি ও ক্লাসের জটিলতায় তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁদের বক্তব্য, একই শিক্ষাবর্ষে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেখানে কয়েক মাস আগেই ক্লাস শুরু করেছেন, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় এক সেমিস্টার শেষের পথে, সেখানে তাঁরা ভর্তি শেষ করে এখনো ক্লাস শুরু করতে পারছেন না।

প্রস্তাবিত মডেলে অনেকের আপত্তি

শিক্ষকদের অভিযোগ, সহজ বিষয়টি কঠিন করছে একটি পক্ষ। শিক্ষকদের মতে, একটি অধিভুক্তমূলক (অ্যাফিলিয়েটিং) বিশ্ববিদ্যালয় করে এর সহজ সমাধান সম্ভব। আবার কারও কারও মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রেখেও পর্যাপ্ত জনবল দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে অন্যত্র সাত কলেজের প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করেও এর সমাধান সম্ভব। অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ যখন শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন, তখন প্রথমে এমন একটি ব্যবস্থা নিয়েই আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু পরে সাত কলেজের জন্য ‘হাইব্রিড মডেলে’ নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করার বিষয়টি সামনে আনা হয়। প্রস্তাবিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ শতাংশ ক্লাস হবে অনলাইনে আর ৬০ শতাংশ ক্লাস হবে সশরীর। তবে সব ধরনের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে সশরীর। প্রস্তাবিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনকার মতো একেকটি কলেজে সব বিষয় পড়াশোনা হবে না। এক বা একাধিক কলেজে স্কুলভিত্তিক (অনুষদের মতো) ক্লাস হবে। সাতটি কলেজকে চারটি স্কুলে বিভক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এতে বিদ্যমান অনেক বিষয় থাকবে না। এই মডেল সামনে আসার পর আপত্তিগুলো বড় করে সামনে আসে। শিক্ষকেরা এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা প্রস্তাবিত মডেলের বিপক্ষে; তবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অনেকে এর পক্ষে।

একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় এখনো না হওয়ায় তাঁরা এর অধীনে প্রথম বর্ষের ক্লাস নিতে পারেন না। তবে উচ্চমাধ্যমিকসহ অন্যান্য বর্ষে ক্লাস নিতে তাঁদের কোনো বাধা নেই।

ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ও ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির (প্রস্তাবিত) অন্তর্বর্তী প্রশাসক অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস প্রথম আলোকে বলেন, এ পরিস্থিতির সমাধান সহজ—কর্তৃপক্ষ যদি শিক্ষক ও অধিকাংশ শিক্ষার্থীর প্রত্যাশিত মডেলে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করে। তিনি আরও বলেন, চলতি শিক্ষাবর্ষের ভর্তি শেষ না করে তাঁরা পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের ভর্তির কাজ শুরু করতে পারছেন না।