কার্যকরভাবেও শিক্ষার্থীরা এআই টুল ব্যবহার করতে পারেন
কার্যকরভাবেও শিক্ষার্থীরা এআই টুল ব্যবহার করতে পারেন

সন্তান পড়াশোনায় এআই ব্যবহার করছে, অভিভাবক কী করবেন

স্কুলে অনেক শিক্ষার্থী এখন পড়াশোনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করছে। এমন খবর যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশ থেকে মিলছে হরহামেশাই। চিন্তিত অনেক অভিভাবক। এটা নিয়ে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন একটি প্রতিবেদন ছাপিয়েছে, তা পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো—

২০২৪ সালের পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে দেখা গেছে, ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোরদের ২৬ শতাংশ চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছে স্কুলের দেওয়া বাড়ির কাজ (হোম ওয়ার্ক) করার জন্য। এর পর থেকে এআই চ্যাটবটের ব্যবহার আরও বেড়েছে। এক বছরের বেশি সময় পর এ সংখ্যা (ব্যবহারকারী স্কুলশিক্ষার্থী) এখন আরও বেশি হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেয়ারলেইহ ডিকিনসন বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক কারা আলাইমো। তাঁর একটি বই ‘ওভার দ্য ইনফ্লুয়েন্স: হোয়াই সোশ্যাল মিডিয়া ইজ টক্সিক ফর উইমেন অ্যান্ড গার্লস—অ্যান্ড হাউ উই ক্যান টেক ইট ব্যাক’ ২০২৪ সালে প্রকাশিত হয়। কারা আলাইমোর চোখে এভাবে চ্যাটজিবিটি, চ্যাটবট দিয়ে লেখা মানে প্রতারণা। শুধু শিক্ষককে নয়, সবচেয়ে বড় কথা—এভাবে শিশুরা নিজেদের শেখার সুযোগ হারাচ্ছে। যেহেতু এআই শনাক্তের প্রযুক্তি এখনো পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়, তাই সহজেই ধরা পড়ে না শিক্ষার্থীদের এআই ব্যবহারের বিষয়। এ কারণেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন—অভিভাবকদের এখনই সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা দরকার, কখন তারা এআই ব্যবহার করবে আর কখন করবে না।

যদি এআই সব কাজ করে দেয়, তবে স্কুলশিক্ষার্থীদের শেখার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। তবে তিনি এ–ও পরামর্শ দেন যে এআইকে টিউটর বা শিক্ষকের মতো ব্যবহার করা যেতে পারে
রবি টরনি, সিনিয়র ডিরেক্টর, এআই প্রোগ্রাম, কমন সেন্স মিডিয়া

আমেরিকার শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যকর প্রযুক্তি ব্যবহারে কাজ করে এমন একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হলো ‘কমন সেন্স মিডিয়া’। এই প্রতিষ্ঠানের এআই প্রোগ্রামের সিনিয়র ডিরেক্টর রবি টরনি বলেন, ‘অভিভাবকেরা নিশ্চিত করুন, শিশুরা এআইকে শেখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, শর্টকাট পদ্ধতি হিসেবে নয়।’

শেখার জন্য টিউটর বা আইডিয়া জেনারেটর হিসেবে এআই ব্যবহার—

প্রথমেই শিশুদের বোঝাতে হবে—তোমার লক্ষ্য হচ্ছে ‘শেখা ও বেড়ে ওঠা।’ রবি টরনি বলেন, যদি এআই সব কাজ করে দেয়, তবে স্কুলশিক্ষার্থীদের শেখার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। তবে তিনি এ–ও পরামর্শ দেন যে এআইকে টিউটর বা শিক্ষকের মতো ব্যবহার করা যেতে পারে—যেখানে জটিল ধারণার ব্যাখ্যা করা বা কোথাও আটকে গেলে সহায়তা নেওয়া যায়। কিন্তু মূল চিন্তাভাবনা ও কাজ অবশ্যই শিক্ষার্থীর হওয়া উচিত।’

এআই থেকে ব্রেনস্টর্মিং বা আইডিয়া নেওয়া যায়, তবে লেখা ও বিশ্লেষণ তাদের নিজেদের মানে শিক্ষার্থীদের করা উচিত। টরনি বলেন, ‘আমাদের মস্তিষ্ক পেশির মতো। অনুশীলন ছাড়া দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়। বাচ্চারা দক্ষতা অনুশীলন না করলে তা থেকে শিখবে না। শিক্ষার্থীদের এআই ব্যবহারের সীমারেখা আগে থেকেই পরিবারের নির্ধারণ করা ভালো। এরপর নিয়মিত খোঁজ নিতে হবে, এআই যেন শেখার জায়গায় ‘কাজ করার শর্টকাট’ পদ্ধতি হয়ে না যায়।’

শিশুরা এআই ব্যবহার করে স্কুলের কাজ করার চেষ্টা করবেই। আর যদি ইতিমধ্যেই না করে থাকে, তাদের শেখাতে হবে—এআই শেখার হাতিয়ার, কাজ করার শর্টকাট পদ্ধতি নয়।

এআইয়ের সব তথ্য বিশ্বাস করবেন না, কারণ...

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রায়ই ভুল তথ্য দেয়, যাকে বলা হয় সম্মোহোন বা ‘হ্যালুসিনেশন’ এবং এটা সব সময় ঘটে থাকে। এক শিক্ষক বলেন, ‘অনেক সময় চ্যাটবটগুলো বা এআই নানা বিষয় এড়িয়ে যায় বা মিস করে। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি আমার ছাত্ররা একটা বিষয়ে কিছু লেখা জমা দিয়েছে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল অদ্ভুতভাবে একই রকম, যা আমার কাছে বিপদের ঘণ্টা মনে হয়েছে। আবার এই একই ক্ষেত্রে একাধিক শিক্ষার্থী দাবি করেছে যে ‘নুড ডিপফেক’–এররের শিকার হওয়াদের সাহায্য করার জন্য কোনো ফেডারেল আইন নেই। যদিও এই আইন মে মাসে করা হয়েছে। তাই শিশুদের শেখাতে হবে, এআইয়ের উত্তর যাচাই না করে গ্রহণ করা যাবে না। স্কুলের পড়াশোনার বিষয় তো আরও নয়। এআইয়ের দেওয়া তথ্য ফ্যাক্ট চেকের মাধ্যমে যাছাই করে দেখা যেতে পারে।

অভিভাবকেরা সন্তানদের সঙ্গে বসেই এ কাজ (ফ্যাক্ট চেক) করতে পারেন। টরনি বলেন, ‘এ জন্য অভিভাবকদের এআই–বিশেষজ্ঞ হতে হবে না। একসঙ্গে খোঁজখবর নেওয়া ও প্রশ্ন করা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাও বটে।’ তিনি অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেন, ‘এটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পছন্দ করুন বা না করুন, চ্যাটবটগুলো (এআই) সম্ভবত ভবিষ্যতে থেকেই যাবে। এআই ইন্টারফেসের মাধ্যমে তথ্য পাওয়া শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য ক্রমে সাধারণ হয়ে উঠবে। আজ যেমন ইন্টারনেট শিশুদের কাছে হয়ে উঠেছে তথ্যের প্রধান উৎস, কাল সেটিই হবে এআই।’

সহায়তা করতে পারে এআই কিন্তু ব্যক্তিগত পরামর্শ বা তথ্যের জন্য নয়—

টরনি বলেন, ‘বাচ্চাদের পক্ষে এআই চ্যাটবটগুলো প্রযুক্তি বলে ভুলে যাওয়া সহজ বা স্বাভাবিক। আমরা জানি, ছোট বাচ্চারা প্রায়ই কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না, এর ফলে তাদের মনে হয়, এআই একজন বাস্তব ব্যক্তি বা বন্ধু।’

একটি উদ্বেগের বিষয় হলো যে চ্যাটবট, যা রোমান্টিক কথোপকথন পরিচালনা করার জন্য প্রশিক্ষিত, বাচ্চাদের সঙ্গে যৌন আলাপচারিতায় লিপ্ত হতে পারে। স্কুলশিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে যে চ্যাটবট থেকে কখনো ব্যক্তিগত পরামর্শ নেওয়া যাবে না, আবার ব্যক্তিগত তথ্যও শেয়ার করা যাবে না। অনেক সময় শিশু মনে করে, এআই সত্যিকারের বন্ধু। কিন্তু টরনি সতর্ক করেন, চ্যাটবট রোমান্টিক কথোপকথনের জন্য প্রশিক্ষিত। এর ফলে এআই শিক্ষার্থীদের যৌন আলাপ বা এ–সংক্রান্ত ক্ষতিকর পরামর্শও দিতে পারে। এতে শিশু বাস্তবত সম্পর্ক থেকেও দূরে সরে যেতে পারে।

এ ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা উদাহরণ দিতে পারেন এভাবে যে এআই যদি বলে ‘তোমার আইডিয়াটা আমার ভালো লেগেছে’, আসলে এআইয়ের কোনো ব্যক্তিগত মতামত নেই। যেটা আছে, সেটা হলো আসলে প্রোগ্রামিং।

আরেকটি ঝুঁকি হলো—ব্যক্তিগত ছবি বা তথ্য এআইয়ের ডেটায় ঢুকে গেলে সেগুলো অন্যের কাছে চলে যেতে পারে।

এআই ব্যবহার করে শিশু যৌন নিপীড়নের ছবি তৈরির হার বাড়ছে

টরনি সতর্ক করে বলেন, এ ক্ষেত্রে আরেকটি ঝুঁকি হলো, এআইয়ের মাধ্যমে শিশুরা অসাবধানতাবশত ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারে। যদি কোনো শিশু আপনার বাসার ছবি আপলোড করে তাহলে অন্য ব্যবহারকারীরা এটি দেখতে পারে। তাই কেন তাদের কখনই এআইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত তথ্য ভাগ করা উচিত নয়, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ।

পারিবারিক নিয়ম তৈরি করুন—

এআই ব্যবহারের জন্য খোলা জায়গা যেমন: বসার ঘরকে বেছে নিন, কিন্তু শয়নকক্ষ নয়। টেক-ফ্রি সময় (যেমন: খাবার সময়, ঘুমানোর আগে) সবার জন্য নির্ধারণ করতে পারেন।

শিশুরা এআই ব্যবহার করে স্কুলের কাজ করার চেষ্টা করবেই। আর যদি ইতিমধ্যেই না করে থাকে, তাদের শেখাতে হবে—এআই শেখার হাতিয়ার, কাজ করার শর্টকাট পদ্ধতি নয়। এআইয়ের দেওয়া প্রতিটি তথ্য যাচাই করতে হবে। এআই মানুষ নয়, তাই ব্যক্তিগত পরামর্শ নেওয়া বা তথ্য শেয়ার করা যাবে না। এভাবে পরিবারের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শিশুরা এআইকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে শিখবে, যাতে এটি শেখায় সহায়ক হয়, শেখার বিকল্প নয়।