
জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা আবার শুরু হতে যাচ্ছে। অবশ্য এ উদ্যোগ ঘিরে বিভক্ত মত রয়েছে শিক্ষাবিদদের মধ্যে। এই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকদের অভিমত ছাপা হচ্ছে শিক্ষায়
জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল, যা প্রতিবছর অষ্টম শ্রেণি শেষে অনুষ্ঠিত হতো। ২০১০ সালে সারা দেশে একযোগে জেএসসি পরীক্ষা চালু হয়। শুরুতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও পরে পরীক্ষাটির প্রচলনে সবাই আশ্বস্ত হয়।
এই পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মাঝে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করত। অষ্টম শ্রেণির শেষে সারা দেশে একযোগে বোর্ড পরীক্ষা নেওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগ, শৃঙ্খলা ও প্রতিযোগিতার মানসিকতা তৈরি হতো। এর মাধ্যমে দুর্বল শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে আগেভাগে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া যেতো। পাশাপাশি গ্রামীণ ও শহুরে এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য সমান মানদণ্ডে মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি হতো, যা শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখত।
২০২৩ সালে নতুন কারিকুলাম চালুর কারণে জেএসসি পরীক্ষা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শিক্ষাব্যবস্থা আবার পুরোনো কারিকুলামে ফিরে এসেছে। কিন্তু জেএসসি পরীক্ষার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এ জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়াও বন্ধ রয়েছে। এতে দেশের অনেক কোমলমতি মেধাবী শিক্ষার্থী পড়াশোনার ব্যাপারে গতি হারিয়ে ফেলছে। বিগত কয়েক বছরে জেএসসি পরীক্ষা বন্ধের খেসারত এবার এসএসসির ফলাফলকেও প্রভাবিত করেছে। ২০২৫ সালে ৬ লাখের বেশি শিক্ষার্থী এসএসসিতে ফেল করা শুধু অনভিপ্রেত নয়, শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অশনিসংকেত বটে।
এসএসসির আগে জেএসসি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি যাচাই ও মান নির্ধারণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অষ্টম শ্রেণিতে এই পরীক্ষা নেওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা বড় পরিসরের বোর্ড পরীক্ষার অভিজ্ঞতা অর্জন করত, যা এসএসসির মতো চূড়ান্ত পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাস বাড়াত। এ ছাড়া জেএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের মাধ্যমে দুর্বল বিষয়ে দ্রুত নজর দেওয়া যেত এবং শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীর ঘাটতি পূরণে উদ্যোগ নিতে পারতেন। সারা দেশে অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে শহর ও গ্রামের শিক্ষার্থীর জ্ঞানের স্তর সমানভাবে যাচাই করা সম্ভব হতো, যা এসএসসির আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতিমূলক ধাপ হয়েছে কাজ করত।
জেএসসি পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কিছু বিতর্কও আছে। অনেকে মনে করেন কম বয়সে বোর্ড পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের ওপর অযথা মানসিক চাপ সৃষ্টি করে এবং সৃজনশীল শিক্ষার বদলে মুখস্থনির্ভরতা বাড়ায়। তা ছাড়া কোচিং ও গাইডবুকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা শিক্ষার গুণগত মান কমিয়ে দেয়। বিষয়গুলো অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু বিকল্প মান যাচাই পদ্ধতি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত এ পরীক্ষা বাতিল করারও কোনো যুক্তি নেই। বিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে পরীক্ষা পদ্ধতিতেই মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু বিদ্যালয়ের ভেদে পরীক্ষার মান ও মূল্যায়ন–কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাহলে জাতীয়ভাবে এ পরীক্ষা নিতে সমস্যা কোথায়? পরীক্ষার মাধ্যমে যে শুধু মুখস্থবিদ্যা যাচাই করা হয়, তা কিন্তু ঠিক নয়। পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলে প্রস্তুতির সময় বিষয়ের অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গে নিচের ক্ষেত্রগুলোতেও শিক্ষার্থীরা পারদর্শী হয়ে ওঠে।
১.
পরীক্ষার তারিখ ও সিলেবাস জানলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় স্পষ্ট লক্ষ্য স্থির করতে পারে
২.
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রস্তুতি শেষ করতে গিয়ে সময়ের সঠিক ব্যবহার শিখতে পারে
৩.
পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় পাঠ অনুশীলনের অভ্যাস তৈরি হয়
৪.
ভালো ফলাফলের ইচ্ছা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী হতে প্রেরণা জোগায়
৫.
শিক্ষার্থীর মধ্যে ফলাফল ও ভবিষ্যতের জন্য সচেতনতা তৈরি হয়
৬.
কোন বিষয় আগে পড়তে হবে এবং কোনটিতে বেশি সময় দিতে হবে, তা বুঝতে শেখায়
৭.
ভালো ফলাফলের জন্য বারবার লেখাপড়া চর্চার অভ্যাস হয়
৮.
পরীক্ষার চাপ শিক্ষার্থীদের বিপথে সময় নষ্ট কমাতে সাহায্য করে
৯.
নিয়মিত প্রস্তুতি ও ছোট ছোট সাফল্য শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে
১০.
সহপাঠীদের সঙ্গে তুলনা করে নিজের অবস্থান উন্নত করার চেষ্টা হয়।
বিগত কয়েক বছর বিভিন্ন কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এখান থেকে দ্রুত মুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে ফেরাতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে জেএসসির মতো একটি পরীক্ষার আয়োজন করতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, এ কথা সত্য। কিন্তু যেকোনো চ্যালেঞ্জের ওপরে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। অতীতে যদি সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা যেত, বর্তমানে তা করা যাবে না কেন? তাই আমি মনে করি, এ মুহূর্তে জেএসসি পরীক্ষা আবার চালু করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই সিদ্ধান্ত যত তাড়াতাড়ি নেওয়া হবে, ততই শিক্ষার্থীর জন্য ভালো হবে।
*লেখক: জাহেদ হোসেন, মাস্টার ট্রেইনার ও সিনিয়র শিক্ষক, বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা