স্মৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রাজু ভাস্কর্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
  ফাইল ছবি

১৯৯৭ সালে আমাদের গ্রামের হাবিব ভাই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেন। হাবিব ভাই ভর্তি হলেন ফলিত পদার্থবিজ্ঞান এবং ইলেকট্রনিকস বিভাগে।

উঠলেন ফজলুল হক হলে। তখনো মোবাইলের চল শুরু হয়নি আর আমাদের গ্রামে টেলিফোনেরও লাইন ছিল না। তাই ভাইয়ার সঙ্গে তখন যোগাযোগ রাখার একমাত্র উপায় চিঠি। চিঠি লিখে দুই টাকা দামের খামে পুরে সেটাকে জগতি ডাকঘরের সামনে রাখা ডাকবাক্সে ফেলে আসতাম। এরপর সেই চিঠি একসময় হাবিব ভাইয়ার কাছে পৌঁছাত, আসত উত্তরও। তবে ঠিকানা লেখার সময় একটা ব্যাপারে বারবার খটকা লাগত। ফজলুল হক হল কক্ষ নং ৪০০৭। আমি তখনো কুষ্টিয়ার বাইরে কোথাও পা রাখিনি, তাই ভাবতাম একটা হল কত বড় হলে সেখানে চার হাজারের অধিক কক্ষ থাকতে পারে। আর যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের থাকার জন্যই চার হাজার কক্ষ আছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ই না জানি কত বড়!  
এরপর বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে ঢাকা যেতে হবে। থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। হাবিব ভাইয়ার ফজলুল হক হলই শেষ আশ্রয়। ভাই আমাকে ওনার বিছানা ছেড়ে দিয়ে পাশের কক্ষে ওনার বন্ধু রায়হান ভাইয়ের কক্ষে চলে গেলেন। বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার কটা দিন ফজলুল হক হলেই থাকা হলো। তখন কক্ষগুলোর এমন বিশাল নম্বরের রহস্য বুঝতে পারলাম। ফজলুল হক হলের মেইন বিল্ডিং তিনতলাবিশিষ্ট একটা বর্গাকারের ইমারত। একতলার কক্ষগুলোর নম্বর ১০০ দিয়ে শুরু। একইভাবে দুই এবং তিনতলার কক্ষগুলোর নম্বর যথাক্রমে ২০০ এবং ৩০০ দিয়ে শুরু। যখন এক্সটেনশন এসেছে, তখন সেটার নম্বর শুরু হয়েছে হাজার দিয়ে। হাবিব ভাই থাকতেন হাজার এক্সটেনশনের চার তলার ৭ নম্বর কক্ষে।

এরপর যে কয় দিন হাবিব ভাইয়ার কাছে ছিলাম, আমার একবারের জন্যও মনে হয়নি আমি বাড়ির বাইরে আছি। হাবিব ভাইয়ার পাশাপাশি রায়হান ভাই নিয়মিত প্রস্তুতির খবর নিতেন। রায়হান ভাইও আমাদের এলাকার হওয়ায় আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতোই স্নেহ করতেন। এরপর বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার দিন এগিয়ে এল। রায়হান ভাইদের কক্ষে হিটারের সাহায্যে রান্না করা হতো। সেখানে খিচুড়ি এবং ডিমভাজি রান্না করা হলো। হাবিব ভাই আমাকে খেয়ে নিতে বললেন। আমি খেয়ে হাবিব ভাই, রায়হান ভাই এবং ওনার অন্য বন্ধুদের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে বুয়েটে চললাম ভর্তি পরীক্ষা দিতে।

এরপর ভর্তি পরীক্ষা শেষ করে পরের দিন খুব ভোরে চানখাঁরপুল থেকে ৭ নম্বর বাসে উঠলাম কল্যাণপুরের উদ্দেশে।

এরপর একসময় বুয়েটে ভর্তি হলাম সানজাদ, সুমন, সুদীপ্ত এবং আমি। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হলো হিটু আর চয়ন ভাই। চয়ন ভাই আমাদের আগের ব্যাচের কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পেয়েছিলেন আমাদের ব্যাচে। আর বন্ধু পাভেল ভর্তি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান এবং ইলেকট্রনিকসে, অবশ্য তত দিনে নাম বদলে হয়েছে ফলিত পদার্থবিজ্ঞান এবং ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং। আর বান্ধবী জিনিয়া সুযোগ পেল উদ্ভিদবিজ্ঞানে। হিটু আর চয়ন ভাই থাকেন ঢাকা মেডিকেলের একমাত্র হল ডা. ফজলে রাব্বী হলের ৫১৩ নম্বর কক্ষে। পাভেল থাকে শহীদুল্লাহ্‌ হলের এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ের ৫০৯ নম্বর কক্ষে। প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তেই বুয়েট থেকে সানজাদ, সুমন আর আমি বের হয়ে ঢাকা মেডিকেল থেকে হিটু আর চয়ন ভাইকে নিয়ে আমরা চলে যেতাম পাভেলের কক্ষে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এরপর পাভেলের কক্ষে চলত আড্ডা। অথবা কখনো পাভেলকে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়তাম ঢাকার রাস্তায় উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে। পাভেলের রুমমেট সোহেল, খোকন আর লিটন আমাদেরই ব্যাচের। তাই দিনে দিনে ওরাও আমাদের বন্ধু হয়ে গেল এমনকি এখনো ওরা আমাদের বন্ধু হয়েই আছে। আর ছিলেন ফারুক ভাই। ভাইয়া আমাদের কুষ্টিয়ারই মানুষ ছিলেন, তাই আমাদের প্রচণ্ড স্নেহ করতেন। আমাদের দেখলে তখন মনে হতো যেন আমরা একই পরিবারের চাচাতো, খালাতো ভাই। আর জিনিয়ার সিট পড়েছিল সামসুন্নাহার হলে। ওর কাছে গিয়ে ওকে ডেকে দেখা করা ছিল রীতিমতো ঝক্কির কাজ। হলের গেটে গিয়ে অপেক্ষায় থাকা কোনো মেয়ে বাইরে থেকে ভেতরে যাচ্ছে কি না। কেউ যখন ভেতরে যায়, তখন অপেক্ষমাণ সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে ওনাকে কক্ষ নম্বর এবং নাম লেখা চিরকুটটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সবাই রাজি হতেন না।

আবার অন্য ব্লকের হলেও ওনারা নিতে চাইতেন না। এরপর ওকে হল থেকে বের করতে পারলে সবাই মিলে শুরু হতো হাঁটা। আমাদের পুরো সার্কেলে একটা মাত্র মেয়ে ছিল জিনিয়া।

ক্যাম্পাস বলতে আমরা যা বুঝি সে রকম কোনো জায়গায় বুয়েট বা মেডিকেলে ছিল না। বুয়েটে যে সামান্য খোলা জায়গা ছিল, ঢাকা মেডিকেলে তা–ও ছিল না। তাই অবধারিতভাবেই আমাদের আড্ডার কেন্দ্রগুলো ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে।

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধিও এতই বড় যে একেবারে নীলক্ষেত থেকে শাহবাগ, চানখাঁরপুল থেকে কাঁটাবন পুরোটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর তার মধ্যেই আছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, বাংলা একাডেমি এমন আরও প্রতিষ্ঠান। আমরা কখনো শহীদুল্লাহ্‌ হলের পাশের পুকুরঘাটে বসে, শহীদ মিনারের বেদিতে বসে, কখনো মল চত্বরের নরম ঘাসের ওপর শুয়ে, আবার কখনো টিএসসির চত্বরে বসে আড্ডা দিতাম। আর রাতের বেলা পুকুরঘাটে বসে কোরাসে গান করাটা ছিল আমাদের প্রায় নিয়মিত অভ্যাস।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি বলতাম মা আর বুয়েট এবং মেডিকেল তার দুটো সন্তানের মতো। অবশ্য বুয়েটের সনদ নিজের নামেই দেওয়া হয় কিন্তু ঢাকা মেডিকেলের সনদ দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেকোনো দিক দিয়েই বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এমন কোনো আন্দোলন–সংগ্রাম নেই, যেটাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–ছাত্ররা নেতৃত্ব দেয়নি।

আমাদের বন্ধুদের মধ্যেও পাভেলই সব বিষয়ে আমাদের নেতৃত্ব দিত এবং এখনো দেয়। আমাদের যেকোনো ধরনের আর্থিক বা সামাজিক সমস্যায় পাভেল সব সময়ই কান্ডারি হিসেবে উপস্থিত হতো। আমরাও সব সময় জানতাম একটা জায়গায় গেলে সমাধান একটা পাওয়া যাবেই।

অপরাজেয় বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, ভর্তি পরীক্ষার মান, হলের ছাত্রদের তথৈবচ অবস্থা, শিক্ষকদের রাজনীতি নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। সেগুলো যাদের সমাধান করার কথা, তারা সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাক। আমার অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয় জানি সেটা হচ্ছে এত এত প্রতিকূলতার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুনামের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। এর কারণ হচ্ছে আপনি যত বেশি প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে জীবনে এগিয়ে যাবেন, আপনি জীবনে তত বেশি টেকসই প্রতিষ্ঠা পাবেন।

পাভেল এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের হুয়াওয়ে ডিভাইস–এর সি এক্স ও, ওর কক্ষের লিটন আছে এখন আমেরিকায়, খোকন আছে আফগানিস্তানে, সোহেল দেশেই ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। ফারুক ভাই আছেন একটা সরকারি ব্যাংকের উচ্চ পদে। আর হাবিব আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অবস্থা যা–ই হোক না কেন, এখনো বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অন্যতম স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানের নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা। সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ার, এমনকি বিশ্বের অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম কুড়াবে বলেই আমার বিশ্বাস। আর এ সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা খুব একটা কঠিনও নয়। শুধু দরকার কর্তৃপক্ষের একটু দূরদর্শী দৃষ্টি। সময় এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব ফিরিয়ে আনার। শতবর্ষে এটাই হোক দেশের মানুষের অঙ্গীকার।