শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আপত্তির মুখে ঢাকার সাতটি বড় সরকারি কলেজ একীভূত করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেই কাঠামো থেকে সরে এসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এখন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করা হলেও তা আর আগের প্রস্তাবিত কাঠামোয় হচ্ছে না।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও কলেজগুলো তাদের বর্তমান স্বাতন্ত্র্য, বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ‘সংযুক্ত’ হিসেবে কার্যক্রম চালাবে। সহজভাবে বললে, এটি অনেকটাই এখনকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধিভুক্ত কলেজগুলোর ব্যবস্থার মতোই—যদিও হুবহু অধিভুক্ত নয়।
এমন বিধান রেখে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আগের অধ্যাদেশের খসড়া সংশোধন করে নতুন খসড়া করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এখন অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তা উপদেষ্টা পরিষদে উত্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
নতুন এই কাঠামো নিয়ে বড় দাগে আপত্তি নেই ওই কলেজগুলোর শিক্ষকদের। তবে শব্দগত কিছু বিষয় আরও পরিষ্কার করার দাবি তাঁদের।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা কলেজের একজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন ‘সংযুক্ত’ কলেজগুলোর শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া এবং উচ্চ মাধ্যমিক এখনকার মতোই বহাল রাখার কথাটি পরিষ্কার করে বলা উচিত। এ ছাড়া সরকারি কলেজ হিসেবে গভর্নিং বডি (পরিচালনা পর্ষদ) প্রয়োজন নেই বলে তাঁরা মনে করেন।
অবশ্য, অধ্যাদেশের নতুন খসড়ায় বলা হয়েছে ‘সংযুক্ত’ কলেজগুলোর বিরাজমান পরিচয়, বৈশিষ্ট্য, অবকাঠামো, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও অন্যান্য বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা অক্ষুণ্ন থাকবে।
ঢাকার এই সাত কলেজকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই সংকট চলছে। ২০১৭ সালে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই এই সাত কলেজকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল। সরকারি কলেজগুলো হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ ও তিতুমীর কলেজ। এই অধিভুক্তির পর থেকেই নানা সংকট তৈরি হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সাত কলেজকে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা করার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চূড়ান্ত হওয়ার আগেই অধিভুক্তি বাতিল করায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে। বর্তমানে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষকে প্রশাসক করে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থায় সাত কলেজের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
সম্প্রতি এসব কলেজ একীভূত করে সরকার নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার পরিকল্পনা নেয়। এ জন্য প্রথমে যে অধ্যাদেশের খসড়া করা হয়েছিল, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চারটি ভাগে পরিচালনার কথা ছিল। এর মধ্যে স্কুল অব সায়েন্সের আওতায় ঢাকা কলেজে, স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিসের আওতায় বাঙলা কলেজে, স্কুল অব বিজনেসের আওতায় তিতুমীর কলেজে এবং স্কুল অব ল অ্যান্ড জাস্টিসের আওতায় কবি নজরুল কলেজে বিভিন্ন বিষয় চালু করার কথা ছিল। এই কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় ‘হাইব্রিড’পদ্ধতিতে পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল; যেখানে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ক্লাস হবে অনলাইনে, বাকিগুলো সশরীর হওয়ার কথা ছিল। আর বেলা একটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল।
গত সেপ্টেম্বরে এই কাঠামোয় করা অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশের পর থেকে প্রস্তাবিত কাঠামো নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করে আসছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ক্লাসও শুরু করা যাচ্ছিল না। এ রকম পরিস্থিতিতে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিল প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়া পরিমার্জন করে চূড়ান্ত করার কাজ চলছে।
অধ্যাদেশের নতুন খসড়া অনুযায়ী ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ নামে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। স্থায়ী ক্যাম্পাস না হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজন অনুযায়ী ভবন বা স্থান ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ থাকবে। ঢাকা মহানগরীর সাতটি কলেজ—ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ ও তিতুমীর কলেজ ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’র সংযুক্ত কলেজ হিসেবে সম্পর্কিত থাকবে। সংযুক্ত কলেজগুলোর বিদ্যমান পরিচয়, বৈশিষ্ট্য, অবকাঠামো, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা অক্ষুণ্ন থাকবে।
নতুন খসড়া অনুযায়ী উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যদের সমন্বয়ে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ নামে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা গঠিত হবে।
সংযুক্ত কলেজের অনুমোদন প্রদান ও বাতিল, পাঠ্যক্রম নির্ধারণ, পরীক্ষা গ্রহণ এবং ডিগ্রি প্রদানসহ শিক্ষা-সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করবে এই বিশ্ববিদ্যালয়। সংযুক্তি ও সংযুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত একাডেমিক কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট নেবে।
এ ছাড়া সংযুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষকদের চাকরিকালীন ও গবেষণামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করবে বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক পরিচালন ব্যয় (মূলধন ব্যয় ছাড়া) নির্বাহের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়যোগ্য বেতন ও ফি, পরিশোধ পদ্ধতি এবং শিক্ষাবৃত্তি প্রবিধান মালার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। সেমিস্টারভিত্তিক (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে মাসভিত্তিক) নির্ধারিত বেতন ও ফি পরিশোধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে, তা বিধিমালার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে।
সাত কলেজের অন্তর্বর্তী প্রশাসক ও ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস প্রথম আলোকে বলেন, সাত কলেজের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় দরকার। এ জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা ইতিবাচক। এখন খসড়ায় শব্দগত কিছু সংশোধন করে সেটি চূড়ান্ত করলে সব পক্ষই মেনে নেবে বলে তিনি আশা করেন। আর সেটাই সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে তিনি মনে করেন।