গত কয়েক বছরে মুক্তি পাওয়া আলোচিত হরর সিনেমা ও সিরিজের দৃশ্য। কোলাজ
গত কয়েক বছরে মুক্তি পাওয়া আলোচিত হরর সিনেমা ও সিরিজের দৃশ্য। কোলাজ

বিশ্বজুড়ে হরর সিনেমার উত্থান, বাংলাদেশে কী অবস্থা

একটা সময় হলিউডে সুপারহিরো সিনেমার রমরমা ছিল, এরপর একের পর এক রিবুট সিনেমা মুক্তি পেতে লাগল। দুই ঘরানার সিনেমার টানা ব্যর্থতার পর প্রযোজকদের এখনকার ভরসা হরর সিনেমা।

কয়েক বছর ধরেই আলোচিত ড্যানি ও মাইকেল ফিলিপো জুটি। ইউটিউবে হরর ভিডিও বানিয়ে দুনিয়াজুড়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন এই দুই অস্ট্রেলীয় যমজ। জিতেছেন বহু পুরস্কার। ২০২৩ সালে সুপারন্যাচারাল সিনেমা ‘টক টু মি’ বানিয়ে চমকে দেন তাঁরা। সানড্যান্স উৎসবে প্রিমিয়ারের পর দুনিয়াজুড়ে হইচই পড়ে যায়। দুই বছরের বিরতির পর এবার ‘ব্রিং হার ব্যাক’ নিয়ে হাজির তাঁরা। এটিও যে হরর সিনেমা, সেটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছেন। চলতি বছরের ২৯ মে অস্ট্রেলিয়ায় মুক্তির পরই আলোচনায় আসে সিনেমাটি। পরে এটি যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি দেয় প্রযোজনা সংস্থা এ২৪। গত শুক্রবার যুক্তরাজ্যে মুক্তি পেয়েছে ‘ব্রিং হার ব্যাক’। ১৫ মিলিয়ন ডলার বাজেটের সিনেমাটি এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে ২৩ মিলিয়ন ডলার ব্যবসা করে ফেলেছে। কেবল এটিই নয়, গত কয়েক বছরে অল্প বা মাঝারি বাজেটের অনেক হরর সিনেমা, সেটা দুনিয়ার যে প্রান্তেই নির্মিত হোক, বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলেছে।

সাধারণ একটা বিদেশি সিনেমা দেখতে গেলে সাবটাইটেল লাগে, কিন্তু হররের বিষয়টা এতটা ভিজুয়াল; পুরো বিষয়টা (হরর সিনেমা) ভিজ্যুয়াল আর সাউন্ডের ওপরে চলে, সংলাপ এখানে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ জন্য দেখবেন অনেক বাংলাদেশি দর্শক টার্কিশ বা ইন্দোনেশিয়ান হরর সিনেমা দেখে। যুক্তরাষ্ট্রেও একই ব্যাপার, সেখানেও এখন আন্তর্জাতিক হররের একটা ট্রেন্ড চলছে।
নুহাশ হুমায়ূন

যখন সুপারহিরো, সিকুয়েল আর পুরোনো ছবির রিবুট দেখে দেখে হাঁপিয়ে উঠেছেন দর্শক, তখন হঠাৎ ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে হরর বা ভৌতিক ঘরানার ছবি। মার্কিন সংস্থা কমস্কোরের এক পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর উত্তর আমেরিকার মোট টিকিট বিক্রির ১৭ শতাংশই এসেছে হরর ছবির হাত ধরে, যা ২০২৪ সালে ছিল ১১ শতাংশ; এক দশক আগেও যা ছিল মাত্র ৪ শতাংশ।

‘সিনার্স’ ও ‘ফাইনাল ডেস্টিনেশন: ব্লাডলাইনস’-এর মতো ছবির সাফল্য এবং বছর শেষে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘দ্য কনজ্যুরিং: লাস্ট রাইটস’ ও ‘ফাইভ নাইটস অ্যাট ফ্রেডিস ২’-এর মতো হরর ফ্র্যাঞ্চাইজির নতুন কিস্তি—সব মিলিয়ে আশাবাদী হলমালিকেরা। ‘আমরা হররকে আমাদের অন্যতম প্রধান টার্গেট ঘরানা হিসেবে দেখছি। যখন অন্য কিছু চলে না, তখন এটা কাজ করে,’ বলেন জর্জিয়ার স্যান্ডি স্প্রিংসের স্প্রিংস সিনেমা অ্যান্ড ট্যাপহাউসের মালিক ব্রান্ট গুলি।

‘ব্রিং হার ব্যাক’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

প্রযোজক, স্টুডিও প্রধান ও হলমালিকদের মতে, হরর সব সময়ই ছিল উদ্বেগ থেকে মুক্তির উপায়। আজকের দুনিয়ায় সেই ভয়—মহামারির পরবর্তী ধাক্কা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আশঙ্কা, শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় বা বর্ণবাদ—হরর চলচ্চিত্রে জায়গা করে নিচ্ছে।
‘এ ঘরানায় একধরনের শুদ্ধকরণ আছে, অর্থাৎ মানসিক উত্তরণ ঘটে, আবেগ কাজ করে আর একটা পরিণতিও থাকে,’ বলছেন হরর মুভি রিপোর্ট-বইয়ের লেখক ও চলচ্চিত্র বিশ্লেষক স্টিফেন ফলোস। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যেসব বিষয়ের মুখোমুখি হতে আমরা ভয় পাই, হরর ছবি আমাদের সেগুলো মোকাবিলা করার সাহস দেয়।’
সাধারণত কম বাজেটের হরর ছবি নির্মাতাদের ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ দেয়, যা ‘মিশন ইম্পসিবল’-এর মতো ব্যয়বহুল ফ্র্যাঞ্চাইজিতে সম্ভব নয়। এই সৃজনশীল স্বাধীনতাই সুযোগ করে দিচ্ছে রায়ান কুগলার, জর্ডান পিল, ড্যানি বয়েল ও গুয়ের্মো দেল তোরোর মতো পরিচালকদের।

‘দ্য সাবস্ট্যান্স’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

কমস্কোর সিনিয়র মিডিয়া বিশ্লেষক পল ডারগারাবেডিয়ান বলছেন, ‘মহাকাশভিত্তিক কোনো সায়েন্স ফিকশন ছবি কম খরচে বানানো যায় না। কিন্তু হরর? “ওয়েপনস”-এর মতো অল্প বাজেটের হরর ছবি দিয়েই আপনি পয়সা ফেরত পেতে পারেন।’
কয়েক বছর ধরেই বিশ্বজুড়ে হরর সিনেমার রমরমা। ওটিটি বা প্রেক্ষাগৃহ হোক, মুক্তির পর এসব সিনেমা আকৃষ্ট করছে দর্শকদের। এর অন্যতম উদাহরণ রায়ান কুগলারের পরিচালনায় মিসিসিপির পটভূমিতে বানানো ভ্যাম্পায়ারকেন্দ্রিক সিনেমা ‘সিনার্স’, মাইকেল বি জর্ডান অভিনীত ছবিটি চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বক্স অফিসে তৃতীয় সর্বোচ্চ আয় করা সিনেমা।

করোনা মহামারির পর যখন হলগুলো দর্শকশূন্য হয়ে পড়ে, ঘরে বসেই সিনেমা দেখার অভ্যাস গড়ে ওঠে, তখন আবার মানুষকে হলে ফেরাতে সহায়ক হয়ে ওঠে হরর। ‘এটা এমন একটা ঘরানা, যা মানুষকে বাড়ি থেকে বের করে হলে নিয়ে আসে,’ বলেন ওয়ার্নার ব্রাদার্স মোশন পিকচার গ্রুপের সহসভাপতি মাইক ডি লুকা। ‘এই ঢেউয়ে সবাই ভাসতে পারে। দর্শককে হলে ফেরানো এখন জরুরি,’ যোগ করেন তিনি।
হররের ভয় কিন্তু কেবল এক দেশের নয়, বিশ্বজুড়েই তা সমান কার্যকর। লন্ডনভিত্তিক অ্যাম্পেয়ার অ্যানালাইসিস বলছে, ২০২৩ সালে বড় স্টুডিওগুলো থেকে যেসব হরর ছবি মুক্তি পেয়েছে, তার অর্ধেকের বেশি আয় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থেকে। যেমন ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ সিনেমাটি ৭৭ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যার ৮০ শতাংশই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এসেছে।

‘গেট আউট’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মেও হররের দাপট। ২০২৩ সালে ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ নেটফ্লিক্সে আসার পর দেখা হয়েছে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ঘণ্টা। চলতি বছরের নভেম্বরে আসছে গুয়ের্মো দেল তোরোর ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’; মেরি শেলির ক্ল্যাসিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত প্রকল্পটি মুক্তির পরই ঝড় তুলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

হরর ছবি বড় পর্দার জন্যই
‘বাসায় আপনি অন্ধকার ঘরে হররের আসল মজা পাবেন না। হলের মতো শত শত দর্শকের সঙ্গে বসে, মুঠোফোন বন্ধ রেখে চমকে ওঠার অভিজ্ঞতা পাবেন না,’ বলেন প্রযোজনা সংস্থা ব্লুমহাউসের প্রধান নির্বাহী জেসন ব্লুম। তাঁদের হাত ধরে এসেছে ‘হ্যালোইন’ আর ‘প্যারানরমাল অ্যাকটিভিটি’র মতো সিনেমা।
তবে বড় বাজেটের ছবি, যেমন ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা: ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ কিংবা ‘দ্য মাইনক্রাফট’ মুভি এখনো হল ব্যবসার মেরুদণ্ড। তবে এসবের চাপে মাঝারি বাজেটের রোমান্টিক কমেডি বা ড্রামা জায়গা হারিয়েছে। সেই শূন্যস্থানই চুপি চুপি দখল করেছে অল্প বাজেটের হরর সিনেমা।

‘সিনার্স’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় প্রথমবারের মতো হরর ঘরানার ছবির আয় এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ওই বছর মুক্তি পায় স্টিফেন কিংয়ের উপন্যাস থেকে নির্মিত ইট আর জর্ডান পিলের গেটআউট।
২০২৩ সালে হলিউডে ধর্মঘটের মধ্যেও হরর ছবি নির্মাণে আগ্রহ কমেনি; বরং গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে হরর ছবির প্রোডাকশন বেড়েছে ২১ শতাংশ। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের দুই-তৃতীয়াংশই এখন হররকে সবচেয়ে প্রিয় ঘরানা হিসেবে দেখেন—বলছে জরিপ।
প্রযোজনা সংস্থা ওয়ার্নার ব্রাদার্সের ডি লুকা বলেন, ‘যখন কোনো কিশোর প্রথমবার কারও সঙ্গে ডেটে গিয়ে সিনেমা দেখতে চায়, তখন হরর ছবিই হয় তার প্রথম পছন্দ। এভাবেই এ ঘরানার সিনেমা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।’

ফ্রিক শো থেকে অস্কার পর্যন্ত
১৯১০ সালে টমাস এডিসনের ক্যামেরায় ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ দিয়ে শুরু—হরর সিনেমা ইতিহাসে বরাবরই একটা জায়গা ধরে রেখেছে। ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ সেন্সর বোর্ড এ ঘরানার জন্য আলাদা ‘এইচ’ রেটিং চালু করে। তবে সে সময় হলিউড হররকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ‘বিশ শতকের প্রথম ভাগে হরর ছিল মূলত ফ্রিক শোর মতো,’ বলেন ফলোস। তবে ‘সাইকো’, ‘দ্য এক্সোরসিস্ট’ আর ‘দ্য শাইনিং’-এর মতো চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে থাকে। ১৯৭৫ সালে স্টিভেন স্পিলবার্গের জস একদম নতুনভাবে দানব চলচ্চিত্রকে পপ কালচারে জায়গা দেয়। এখন তো অস্কারেও হররের কদর। ২০১৮ সালে ‘গেটআউট’-এর জন্য জর্ডান পিল পেয়েছেন সেরা মৌলিক চিত্রনাট্যের অস্কার। আর চলতি বছর ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’-এ প্লাস্টিক সার্জারির নেশায় মগ্ন এক অভিনেত্রীর ভূমিকায় ডেমি মুরও পেয়েছেন অস্কার মনোনয়ন।

‘ওয়েপনস’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

তবে সব হরর ছবিই যে সফল হবে, তেমন নয়। যেমন ২০২২ সালের হিট ছবি ‘এমথ্রি-গান’-এর সিকুয়েল ‘এমথ্রি-গান ২.০’ মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় আয় করেছে মাত্র ১০ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার।
তবে এবারের গ্রীষ্মে হররপ্রেমীদের জন্য সুখবর—লেবার ডের আগেই সাতটি হরর ছবি মুক্তি পাচ্ছে। এর মধ্যে ৮ আগস্ট মুক্তি পাবে ‘ওয়েপনস’।

বলিউডে হরর-কমেডি
ভারতেও ইদানীং হরর ছবির বেশ রমরমা। হরর কমেডির মোড়কে এ ঘরানা প্রথম জনপ্রিয়তা পেয়েছে দক্ষিণে। পরে প্রযোজক দিনেশ বিজন তৈরি করেছেন ‘হরর ইউনিভার্স’। তাঁর প্রযোজিত ‘স্ত্রী’ ব্যাপক ব্যবসায়িক সাফল্য পায়। গত বছর ছবিটির সিকুয়েল ‘স্ত্রী ২’ তো রেকর্ড ব্যবসা করেছে। একই প্রযোজকের আরেকটি হরর-কমেডি ‘মুনজ্যা’ও সুপারহিট। আরেকটি সিনেমা ‘ভুলভুলাইয়া ৩’–ও হিট। কিছুটা হাস্যরস, কিছুটা ভয় ছিল এসব সিনেমায়; আর ছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে কটাক্ষ। দর্শকপ্রিয়তা পেলেও অনেক সমালোচক এসব ছবিকে আসল হরর ছবি বলতে নারাজ। অনেকে আবার মনে করেন, ভারতের দর্শকের কাছে কোনো বার্তা পৌঁছাতে গেলে এ ধরনের সিনেমাই জুতসই।

‘স্ত্রী ২’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

হিন্দি সিনেমার দর্শকের কাছে এখনো হরর সিনেমা বললে ভেসে ওঠে মধুবালার মুখ। ১৯৪৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মহল’ সিনেমায় ‘ভূত’ হয়ে হাজির হয়ে দর্শককে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন তিনি। পরে নির্মিত হয় ‘ওহ কৌন থি’, ‘গুমনাম’, ‘কোহরা’র মতো আলোচিত হরর সিনেমা। তবে এ সময় হিন্দি সিনেমার নির্মাতারা ভয় পাওয়াতে প্রস্থেটিকস নয়; বরং আবহ তৈরিতেই জোর দিয়েছেন বেশি।

এরপর আসে রামজে ভ্রাতৃদ্বয় আর রামগোপাল ভার্মার যুগ। এ সময় পাওয়া যায় ‘রাত’, ‘কৌন’, ‘ভূত’, ‘ফুঁক’, অজ্ঞাত’, ‘ডরনা মানা হ্যায়’, ‘বাস্তুশাস্ত্র’, ‘ডরনা জরুরি হ্যায়’-এর মতো সিনেমা। আরও পরে দৃশ্যপটে হাজির হন বিক্রম ভাট। তিনি মূলত হলিউডের বিভিন্ন সিনেমার প্লটে কিছু বলিউডি মসলা মিশিয়ে সিনেমা বানাতেন। এ সময়ে নির্মিত রাজ, ১৯২০-এর মতো সিনেমা দেখলেই তা বোঝা যায়। এসব চর্বিতচর্বণ শুরুতে দর্শক টানলেও পরে ফ্লপ হতে থাকে। নির্মাতারাও এ ধরনের সিনেমায় সেভাবে বিনিয়োগের সাহস করেননি। তবে বক্স অফিস বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, কমেডির মোড়কে হরর সিনেমা বানানোর রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছেন দিনেশ বিজন। এ সিনেমাগুলো কতটা জাত হরর, সে নিয়ে বিতর্ক হলেও লগ্নি ফেরত আসার প্রায় নিশ্চিত সম্ভাবনা ধরে নিয়ে এ ধরনের আরও সিনেমা তৈরি হবে।

ভূতের ভবিষ্যত ছবিতে ‘হাত কাটা কার্তিক’–এর ভূমিকায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়।

সত্যজিৎ রায়ের ‘মণিহারা’ বা অজয় করের ‘কায়াহীনের কাহিনী’র মতো ছাড়া ছাড়া কিছু উদাহরণ বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গেও সেভাবে হররের ধারা ছিল না। অবশ্য অনীক দত্তর ভূতের ভবিষ্যৎ-এর পর পশ্চিম বাংলায়ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে কমেডিনির্ভর হরর সিনেমা। তবে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ বাদে কোনোটিই সেভাবে সাফল্য পায়নি। কলকাতার এই অভিনেতা ও নির্মাতা বরাবরই হরর-কমেডির ভক্ত। তিনি মনে করেন, বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের প্রচুর গল্প, উপন্যাস আছে। ঠিকঠাকভাবে এগুলো পর্দায় তুলে আনলে দর্শকের আগ্রহ তৈরি হতে পারে।

বাংলাদেশের কী অবস্থা
বাংলাদেশের সিনেমায় হরর সেভাবে জায়গা পায়নি। জহির রায়হানের ‘কখনো আসেনি’ বা মোস্তাফিজের ‘হারানো দিন’-এ সাইকোলজিক্যাল হরর সিনেমার কিছু উপাদান ব্যবহার করা হলেও এগুলোকে কোনোভাবেই হরর ছবি বলা যাবে না। আলমগীর কবিরের ‘সূর্যকন্যা’ বিষয়েও একই কথা। সম্প্রতি ‘জ্বীন’ ফ্র্যাঞ্চাইজি চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু এর কোনো কিস্তিই জুতসই হয়নি। বরং ওটিটিতে হরর ধীরে ধীরে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। শুরুটা করেন নুহাশ হুমায়ূন। ২০২২ সালে চরকিতে মুক্তি পাওয়া তাঁর অ্যানথোলজি সিরিজ ‘পেট কাটা ষ’ মুক্তির পর চমকে দেয়।

‘পেট কাটা ষ’–এর প্রথম সিরিজে জিনের চরিত্রে আফজাল হোসেন। চরকির সৌজন্যে

দেশি ভূতের গল্প প্রশংসিত হয় দেশ-বিদেশে। এর আগে মশারি বানিয়েছেন নুহাশ, যুক্তরাষ্ট্রের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হুলুর জন্য বানিয়েছেন ‘ফরেনার্স অনলি’, গত বছর চরকিতে এসেছে ‘ষ’-এর দ্বিতীয় কিস্তি ‘২ষ’। সব মিলিয়ে তরুণ এই নির্মাতা বিশ্বব্যাপী আলাদা পরিচিতি পেয়েছেন হরর কনটেন্ট বানিয়ে। গত শুক্রবার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে নুহাশের যখন কথা হয়, তখন তাঁর ‘২ষ’ প্রদর্শিত হচ্ছে কানাডার ফ্যান্টাজিয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে।

ফ্যান্টাজিয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নুহাশ। ছবি: ফেসবুক থেকে

বিশ্বজুড়ে হরর সিনেমার জনপ্রিয়তা নিয়ে নুহাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা সময় একেকটা জনরা জনপ্রিয়তা পায়। ওয়েস্টার্ন একসময় খুব জনপ্রিয় ছিল, এ ধরনের প্রচুর সিনেমা বানানো হয়েছে। এরপর অনেক দিন সুপারহিরো ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় জনরা, এখন হররের একটা ঢেউ চলছে। হরর দেখার মধ্যে একটা মজা আছে। আমাকে অনেকেই বলে, “পেট কাটা ষ” বা “২ষ” রাতে কাজিনদের সঙ্গে বসে দেখেছে। কোথাও বেড়াতে গেছে, বন্ধুদের সঙ্গে রাত ১২টায় দেখেছে। হরর সবাই মিলে দেখার মধ্যেও একটা মজা আছে। হরর মুভির একটা ভালো ব্যাপার হলো, একটা ভালো হরর সিনেমা দেখার পর যেমন ভালো লাগে, ভয় লাগে, তেমনি বাজে হরর দেখার পর দুইটা বাজে কথা বলতেও ভালো লাগে।’

নুহাশ জানান, টানা বেশ কয়েকটি হরর প্রকল্প বানানোর পর তিনি হলিউডের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এবং ভারত থেকেও হরর বানানোর প্রস্তাব পাচ্ছেন।

‘ভাগ্য ভালো’তে মোশাররফ করিম। চরকির সৌজন্যে

তাঁর মনে হয়, হররের মধ্যে বিশ্বজনীন ব্যাপার আছে। নুহাশের ভাষ্যে, ‘সাধারণ একটা বিদেশি সিনেমা দেখতে গেলে সাবটাইটেল লাগে, কিন্তু হররের বিষয়টা এতটা ভিজুয়াল; পুরো বিষয়টা (হরর সিনেমা) ভিজ্যুয়াল আর সাউন্ডের ওপরে চলে, সংলাপ এখানে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ জন্য দেখবেন অনেক বাংলাদেশি দর্শক টার্কিশ বা ইন্দোনেশিয়ান হরর সিনেমা দেখে। যুক্তরাষ্ট্রেও একই ব্যাপার, সেখানেও এখন আন্তর্জাতিক হররের একটা ট্রেন্ড চলছে।’

বাংলা সিনেমার জন্য এখন খুবই দারুণ একটা সময়; ড্রামা, আর্ট হাউস সিনেমা যেমন হচ্ছে, আবার ছোট ছোট বিভিন্ন জনরার কাজও হচ্ছে। নুহাশ চান দেশে হরর নিয়ে আরও কাজ হোক। ‘শুধু আমি নই, অন্যরাও বানাক। ‘পেট কাটা ষ’, ‘২ষ’, ‘মশারি’, ‘ফরেনার্স অনলি’ করার অভিজ্ঞতায় আমি দেখলাম, দেশে হররের বিশাল সম্ভাবনা। বাংলাদেশের বড় একটা শ্রেণির দর্শক বসে আছে হরর দেখার জন্য।’
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ইন্ডিয়া টুডে