
নিউইয়র্ক শহরের নবনির্বাচিত মেয়র হয়েছেন জোহরান মামদানি। তাঁর মেয়র হওয়ার পেছনে বাঙালি ভোটারদের যে অবদান ছিল, সেটা মামদানির জেতার খবরের বিজয় মিছিলেই দেখা গেছে। ‘আমার মেয়র-তোমার মেয়র, মামদানি-মামদানি’, ‘নিউইয়র্কের মেয়র, মামদানি-মামদানি’, ‘শ্রমিক শ্রেণির মেয়র, মামদানি-মামদানি’—এসব স্লোগানে মুখর হয়ে উঠেছিল কুইন্সের জ্যামাইকা শহর। তবে বাঙালি ভোটারদের মন জেতার পেছনের তাঁর একটা বাংলা প্রচারণার ভিডিও-ও ভূমিকা রেখেছে বলা যায়। লিটল বাংলাদেশ কেনসিংটনের বাঙালি কাউন্সিল মেম্বার শাহানা আরিফের সঙ্গে তাঁর বাংলায় কথোপকথন নজর কেড়েছে অনেকেরই। তাঁর সাবলীল কথা বলার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছিল বাংলার ওপরও তাঁর দখল আছে বেশ। তবে মামদানির এই বাংলাপ্রীতি শুধু ভোট টানার জন্য ছিল না। এখানে রয়েছে তাঁর মায়ের অবদান। মামদানির মা ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মীরা নায়ার। সন্তান মেয়র হওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় এই নির্মাতা।
শুরুর গল্প
১৯৫৭ সালের ১৫ অক্টোবর মীরা নায়ারের জন্ম ভারতের ওডিশায়। বেড়ে উঠেছেন ওডিশার রাজধানী ভুবনেশ্বরে। ভুবনেশ্বরের উত্তর-পূর্বে পশ্চিমবঙ্গ হওয়ায় সেখানের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ বাঙালি। মীরা নায়ারের বন্ধুবান্ধব যেমন বাঙালি ছিল, তেমনি তিনি ছোটবেলায় গানও শিখেছেন এক বাঙালি শিক্ষকের কাছে। তিনি ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য, থিয়েটার ও সমাজবিজ্ঞানে গভীর আগ্রহী ছিলেন।
মীরা নায়ারের চলচ্চিত্রচিন্তার পেছনে বাংলা ও ভারতীয় সংস্কৃতির যোগসূত্র রয়েছে।
দ্য টেলিগ্রাফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি পরিচালক ঋত্বিক ঘটক ও সত্যজিৎ রায়ের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ঋত্বিক ঘটক আমার প্রিয় পরিচালক—তাঁর সিনেমাই আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে একটি গাছকে ফ্রেমে ধরা যায়। আর সত্যজিৎ রায়কে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি ও খুবই পছন্দ করি। আমার ছবিতে তাঁদের অনেক রেফারেন্স থাকে।’
চলচ্চিত্রে অভিষেক
আশির দশকের প্রথম দিকে তথ্যচিত্র নির্মাণের মাধ্যমে মীরা নায়ার তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন। প্রথম দিকে তিনি সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে বেশ কিছু ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ ‘সো ফার ফ্রম ইন্ডিয়া’(১৯৮২)। ১৯৮৮ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘সালাম বম্বে!’। এ সিনেমাটি রাস্তায় বেড়ে ওঠা পথশিশুদের বাস্তব জীবন নিয়ে নির্মিত। আর এ সিনেমাই তাঁকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি এনে দেয়। এই সিনেমার জন্য তিনি কান চলচ্চিত্র উৎসবে ক্যামেরা দ’অর ও অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। এ ছাড়া এটি অস্কারে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে মনোনীত হয়, বাফটাতেও মনোনয়ন পায় এবং ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।
‘কামসূত্র’ বিতর্ক
১৯৯৬ সালে মুক্তি পায় মীরা নায়ার পরিচালিত ‘কামসূত্র: আ টেল অব লাভ’ সিনেমাটি। এটি নির্মিত হয় ভারত, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও জাপানের যৌথ প্রযোজনায়। এটি ১৯৯৬ সালে সাব সেবাস্তিয়ান চলচ্চিত্র উৎসবে মনোনীত হয়। ছবিটি কান উৎসবে প্রদর্শিত হয়। সমালোচকদের প্রশংসা পেলেও নগ্ন দৃশ্যের কারণে বিতর্কের মুখে পড়ে। এ জন্য সিনেমাটি ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়।
আরও উল্লেখযোগ্য কাজ
২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মনসুন ওয়েডিং’ মীরা নায়ারের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ। ভারতের মধ্যবিত্ত জীবনের ঐতিহ্য, আধুনিকতা ও পারিবারিক টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে নির্মিত এই সিনেমা ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সর্বোচ্চ সম্মান স্বর্ণ সিংহ অর্জন করে। এ ছাড়া এটি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় সেরা জনপ্রিয় চলচ্চিত্র বিভাগে গোল্ডেন গ্লোবে মনোনীত হয়।
পরবর্তী সময়ে ‘দ্য নেমসেক’ (২০০৬) ও ‘কুইন অব কাতওয়ে’ (২০১৬)-এর মতো চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি প্রবাসী জীবন, পরিচয় ও নারীর সংগ্রামকে ফুটিয়ে তোলেন।
‘দ্য নেমসেক’ সিনেমাটি তাঁর ক্যারিয়ারে অন্যতম সেরা ও গভীর কাজ হিসেবে বিবেচিত।
ঝুম্পা লাহিড়ীর উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমাটি তৈরি। প্রবাসী বাঙালি পরিবার ও পরিচয়ের দ্বন্দ্ব নিয়েই গল্প। গল্পের অভিবাসী বাঙালি দম্পতি অশোক ও অসীমা গাঙ্গুলির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন যথাক্রমে ইরফান খান ও টাবু। প্রবাসী বাঙালি দর্শক এই একটি সিনেমার জন্যই মীরা নায়ারকে মনে রাখবেন।
এ ছাড়া তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক সংবেদনশীলতার জন্য তিনি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। চলচ্চিত্রে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সালে তিনি ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মভূষণ পান, ২০১৩ সালে হার্ভার্ড আর্টস মেডেলে ভূষিত হন।
কত সম্পদের মালিক
মীরা নায়ারের মোট সম্পদ প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডলার, যা মূলত তাঁর প্রযোজনা সংস্থা মীরাবাঈ ফিল্মের আয়, সিনেমার রয়্যালিটি থেকে এসেছে। তাঁর ‘সালাম বম্বে!’, ‘মিসিসিপি মাসালা’, ‘মনসুন ওয়েডিং’ ৭ মিলিয়ন ডলারের কম বাজেটে তৈরি হলেও বিশ্বব্যাপী ৪৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছে।
৬৮ বছর বয়সেও মীরা নায়ার সক্রিয়ভাবে চলচ্চিত্রে যুক্ত আছেন। সন্তান মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বলেন, ‘জোহরান, তুমি অসাধারণ।’ স্টোরিতে মার্কিন র্যাপার জে জেডের ‘এম্পায়ার স্টেট অব মাইন্ড’ গানটি জুড়ে দেন তিনি।
বিবিসি বাংলা, নিউজ ১৮ অবলম্বনে