‘থামা’ সিনেমায় রাশমিকা ও আয়ুষ্মান। কোলাজ
‘থামা’ সিনেমায় রাশমিকা ও আয়ুষ্মান। কোলাজ

হাসিও পায় না, ভয়ও পায় না...

‘স্ত্রী’ দেখে হিন্দি হরর-কমেডিতে মজেছিলেন দর্শকেরা। সেই পথ ধরে আসে ম্যাডক ফিল্মসের ‘ভেড়িয়া’, ‘মুনজ্যা’, ‘স্ত্রী ২’; সবগুলোই মোটা দাগে সফল। তাই এই ইউনিভার্সের নতুন সিনেমা ‘থামা’ নিয়ে প্রত্যাশাও ছিল বেশি, প্রধান তিন চরিত্রে যখন আয়ুষ্মান খুরানা, রাশমিকা মান্দানা আর নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর মতো তারকা, তখন এই প্রত্যাশা বাড়াবাড়ি ছিল না। কিন্তু মুক্তির পর পূরণ করতে পারল সিনেমাটি?

একনজরেসিনেমা: ‘থামা’ধরন: হরর-কমেডিঅভিনয়ে: আয়ুষ্মান খুরানা, রাশমিকা মান্দানা, নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী, পরেশ রাওয়ালপরিচালনা: আদিত্য সরপোতদারচিত্রনাট্য: নীরেন ভাট, সুরেশ ম্যাথিউ, অরুণ ফালারাসময়: ২ ঘণ্টা ২৯ মিনিটস্ট্রিমিং: অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও

গল্প কী নিয়ে
‘থামা’র গল্প শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ সালে। ভারতে আক্রমণের সময় আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট সৈন্যদের সামনে গর্বভরে কথা বলছেন। কিন্তু ইতিহাসে পরিচিত সেই গ্রিক যোদ্ধার মৃত্যু হয় দাঁতওয়ালা এক ‘বেতাল’ নেতার হাতে। সেই বেতাল নেতা যক্ষাসন। রক্তপিপাসু এই দানব ইতিহাস নতুন করে লিখছে, অথচ নিজেও তা বুঝতে পারছে না। ‘তুমি ভারত দখল করবে?’—ব্যঙ্গভরে গর্জে ওঠে সে।

পরের কয়েক শতক ধরে যক্ষাসন অ্যাংলোদের রক্তে ভোজ সারতে থাকে। সেই ফাঁকে ভাঙাচোরা ইংরেজিও রপ্ত করে নেয়। ১৯৪০-এর দশকের ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তার জন্য যেন এক বিরাট ভোজ—চারদিকে ফরসা চামড়ার, শক্ত ঠোঁটের উপনিবেশবাদী।

‘থামা’র নির্মাণ যেন রাইটার্স রুমের খসড়া ভাবনা—যা কখনোই চূড়ান্ত রূপ পায় না। হিন্দি সিনেমায় এই ঘরানার অপরিচিতির কারণে সম্ভাবনা ছিল সীমাহীন। কিন্তু এখানে সৃজনশীলতার দিকগুলো খুবই ফিকে। বাস্তব ইতিহাস আর ছবির কল্পনার মেলবন্ধন যথেষ্ট খতিয়ে দেখা হয় না। মানুষের প্রতি বিশেষ গোষ্ঠীর বিরাগ—যা আলোক ও তাড়কার ‘নিষিদ্ধ’ সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করে—তার উৎস এক মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। কিন্তু সেই বিপর্যয়ের প্রকাশও আসে অগভীর পাঞ্চ লাইনের মতো।

কিন্তু শিগগিরই তার নিজের গোষ্ঠীই তাকে নির্বাসিত করে ও বন্দী করে রাখে, যখন তারা বুঝতে পারে—তার তথাকথিত স্বাধীনতা সংগ্রাম আসলে ছিল লাগামছাড়া আদিম প্রবৃত্তির আড়াল। সে কোনো আধ্যাত্মিক রক্ষক বা অতিপ্রাকৃত প্রহরী নয়; সে এক ঘৃণাপ্রসূত সত্তা, যে একটি সম্প্রদায়কে মুছে দিতে চায়। নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর অতিনাটকীয় অভিনয়ে যক্ষাসন চরিত্রটি গল্পে খেই হারায়। ছবিটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্রটির দিকেই নজর দিতে চায় না—এক ক্ষমতালোভী উন্মাদ, যে জাতীয়তাবাদের জোয়ারকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়।

‘থামা’ সিনেমার দৃশ্যে আয়ুষ্মান ও রাশমিকা। এক্স থেকে

‘থামা’ বেছে নেয় সবচেয়ে নিষ্প্রভ ও নিরামিষ পথ—একটি ফ্যান্টাসি ফ্র্যাঞ্চাইজের নতুন সংযোজন হয়ে ওঠার চেষ্টা। ‘স্ত্রী, ‘ভেড়িয়া’, ‘মুনজ্যা’ ও ‘স্ত্রী ২’-এর পর ম্যাডক হরর কমেডি ইউনিভার্স পঞ্চম ছবি হিসেবে ‘থামা’ তাই বারবার হোঁচট খায়। ভ্যাম্পায়ার-ছায়াযুক্ত লোককথা–নির্ভর রোমান্টিক সিনেমাটিতে উচ্চাকাঙ্ক্ষার আড়ম্বর থাকলেও, একাধিক জায়গায় ব্যর্থ।

অলৌকিক গল্পে চমকপ্রদ খবর খুঁজে বেড়ানো এক সাংবাদিক আলোক গোয়েল (আয়ুষ্মান খুরানা) বন্ধুদের সঙ্গে ক্যাম্পিংয়ে যান। হঠাৎ ভালুকের আক্রমের শিকার হয়ে পালাতে গিয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। মৃত্যুপথযাত্রী আলোককে সুস্থ করে তোলে হৃৎস্পন্দনহীন এক বেতলা তরুণী তাড়াকা (রাশমিকা মান্দানা)। শিগগিরই আলোক বুঝতে পারে, সে এমন এক জঙ্গলে আছে, যেখানে গোত্রের নিজস্ব নিয়মকানুন রয়েছে। গোত্রপ্রধান বা থামা (নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী) দেশভাগের সময় নিয়ম ভাঙার দায়ে এক গুহায় বন্দী।

‘থামা’ কোনো স্বতন্ত্র সিনেমা নয়, এটি ম্যাডক হরর-কমেডি ইউনিভার্সের একটি কিস্তি মাত্র। কিন্তু ‘স্ত্রী’, ‘ভেড়িয়া’, ‘মুনজ্যা’র সঙ্গে জোর করে যোগসূত্র তৈরির চাপে ছবিটি নিজস্বতা হারায়। তাই এই ইউনিভার্সের অন্য চরিত্ররা যখন হাজির হয়, হাততালি দিতে ইচ্ছা করে না। এই সিনেমাকে তাই ফ্র্যাঞ্চাইজির বোঝা মনে হয়।

পুরাণ আর আধুনিক ইতিহাসের এই মিশ্রণ শুরুতে বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়। পালিয়ে বেড়াতে থাকা আলোক তাড়াকাকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসে নিজের বাড়িতে। আলোকের জগতে এসে তাড়াকা ‘তারিকা’ হয়ে ওঠে, তবু রয়ে যায় বহিরাগত। আলোকের বাবা (পরেশ রাওয়াল) মেয়েটিকে ছেলের সর্বনাশ ডেকে আনা ‘হানি ট্র্যাপ’ মনে করেন। আর অতিস্নেহশীলা মা (গীতা আগরওয়াল শর্মা) অবাক হন তার খাদ্যাভ্যাস দেখে। তবে প্রেম যখন জমে উঠেছে তখনই এক দুর্ঘটনায় আলোক নিজেই রক্তপিপাসু হয়ে ওঠে। কিন্তু সে কি নিজের মানবিকতা ঝেড়ে ফেলতে পারবে?

‘থামা’ সিনেমায় রাশমিকা ও আয়ুষ্মান। আইএমডিবি

কোথায় ব্যর্থ
ম্যাডকের হরর-কমেডি ইউনিভার্সের আগের সিনেমাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কমেডি। কিন্তু এই সূচকে ‘থামা’ পাঁচ সিনেমার মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল; কারণ, হাস্যরস ঠিকমতো কাজ করে না—ছবিটি নাটকীয়তাকেই পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারে না। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বাদুড়ের কামড় আর সুপারহিরো পুরাণের রূপান্তর হিসেবেও এটি সাম্প্রতিক মালয়ালম হিট ‘লোকাহ: চ্যাপ্টার ১—চন্দ্রা’র চেয়ে ‘থামা’ অনেক পিছিয়ে। ‘লোকাহ’য় বিনোদন আর সাংস্কৃতিক ভাষ্য প্রায় নিখুঁতভাবে মিশেছিল, এখানে যেটা হয়নি। প্রেমের গল্প হিসেবেও খুবই গড়পড়তা ‘থামা’।

‘থামা’র নির্মাণ যেন রাইটার্স রুমের খসড়া ভাবনা—যা কখনোই চূড়ান্ত রূপ পায় না। হিন্দি সিনেমায় এই ঘরানার অপরিচিতির কারণে সম্ভাবনা ছিল সীমাহীন। কিন্তু এখানে সৃজনশীলতার দিকগুলো খুবই ফিকে। বাস্তব ইতিহাস আর ছবির কল্পনার মেলবন্ধন যথেষ্ট খতিয়ে দেখা হয় না। মানুষের প্রতি বিশেষ গোষ্ঠীর বিরাগ—যা আলোক ও তাড়কার ‘নিষিদ্ধ’ সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করে—তার উৎস এক মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। কিন্তু সেই বিপর্যয়ের প্রকাশও আসে অগভীর পাঞ্চ লাইনের মতো।

আরও একটি বড় সত্য—এই ছবির প্রকৃত নায়ক তাড়কা, যে সব নিয়ম ভেঙে প্রেমের জন্য নিজের ঐতিহ্যকে ঝুঁকিতে ফেলে। তবু আলোচনার কেন্দ্র দখল করে নেয় আলোক—কারণ, তিনি এক আধা-নারীবাদী গল্পে পুরুষ লেখকদের হাতে গড়া এক পুরুষ চরিত্র, যেখানে অন্তত দুটি আইটেম গানও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

ছবির সবচেয়ে নজরকাড়া মুহূর্ত নিঃসন্দেহে আলোক আর ভেড়িয়ার (বরুণ ধাওয়ান) মুখোমুখি সংঘর্ষ—ভ্যাম্পায়ার বনাম ওয়্যারউলফের এই লড়াই জমজমাট। দ্রুতগতির কোরিওগ্রাফিতে সাজানো এই দৃশ্য ম্যাডক ইউনিভার্সের পরবর্তী ছবির ইঙ্গিতও দেয়, যেখানে দুই দানবের মধ্যে প্রাণঘাতী শিকারের গল্প দেখা যেতে পারে।

‘থামা’ কোনো স্বতন্ত্র সিনেমা নয়, এটি ম্যাডক হরর-কমেডি ইউনিভার্সের একটি কিস্তি মাত্র। কিন্তু ‘স্ত্রী’, ‘ভেড়িয়া’, ‘মুনজ্যা’র সঙ্গে জোর করে যোগসূত্র তৈরির চাপে ছবিটি নিজস্বতা হারায়। তাই এই ইউনিভার্সের অন্য চরিত্ররা যখন হাজির হয়, হাততালি দিতে ইচ্ছা করে না। এই সিনেমাকে তাই ফ্র্যাঞ্চাইজির বোঝা মনে হয়।

‘থামা’র পোস্টার। আইএমডিবি

টোন ও অভিনয়
‘থামা’র আরেকটি বড় সমস্যা—অসম টোন। একদিকে ব্যঙ্গ, অন্যদিকে বাঁচা-মরার লড়াই। আলোক যখন নতুন সত্তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন এক ভুয়া পুলিশ সেজে থাকা গোষ্ঠীর সদস্য তাদের নিয়ে যায় এক রক্ত-বার ও নাইটক্লাবে। হঠাৎ এই স্কেলের পরিবর্তনের কোনো কারণ নেই (নোরা ফতেহির নাচ ছাড়া)।

অভিনয়ের দিক থেকেও বিশেষ কিছু নেই। আয়ুষ্মান খুরানা নাটকীয়তা আর কৌতুকের টানাপোড়েন সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু প্রাণহীন চিত্রনাট্য তার চরিত্রকে রক্তমাংসহীন এক কঙ্কালে পরিণত করে। আয়ুষ্মান বারবার বোঝাতে চান, তিনি ‘সাধারণ মানুষ’ ইমেজ ছেড়ে সুপারহিরোর জগতে পা রাখছেন। রাশমিকার ভূমিকা তুলনামূলক ধারাবাহিক, চিত্রনাট্য অনুযায়ী নিজের সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
সবচেয়ে হতাশার নওয়াজুদ্দিনের অভিনয়, তাঁর মতো অভিনেতা যখন অতি নাটকীয়তার আশ্রয় নেন তখন বিরক্তই লাগে।

যা যা কাজ করে
ছবির সবচেয়ে নজরকাড়া মুহূর্ত নিঃসন্দেহে আলোক আর ভেড়িয়ার (বরুণ ধাওয়ান) মুখোমুখি সংঘর্ষ—ভ্যাম্পায়ার বনাম ওয়্যারউলফের এই লড়াই জমজমাট। দ্রুতগতির কোরিওগ্রাফিতে সাজানো এই দৃশ্য ম্যাডক ইউনিভার্সের পরবর্তী ছবির ইঙ্গিতও দেয়, যেখানে দুই দানবের মধ্যে প্রাণঘাতী শিকারের গল্প দেখা যেতে পারে।

‘থামা’র পোস্টার। আইএমডিবি

প্রযুক্তিগত দিক থেকেও ‘থামা’ যথেষ্ট শক্তপোক্ত। ভিএফএক্স, প্রোডাকশন ডিজাইন ও সিনেমাটোগ্রাফি ছবিটিকে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মানানসই ঔজ্জ্বল্য দিয়েছে। আবহসংগীতও মন্দ নয়; এটি হাস্যরসের মুহূর্ত যেমন জোরালো করে, তেমনি ভৌতিক আবহও তৈরি করে।

‘থামা’ এই ফ্র্যাঞ্চাইজির নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি; সম্ভাবনাময় শুরুর পরও বারবার পথ হারায়। হরর-কমেডি ইউনিভার্সের ছবি কিন্তু এখানে হরর বা কমেডি কোনোটাই কাজ করে না