‘হোমবাউন্ড’ সিনেমায় মোহাম্মদ সাইয়ুব ও অমৃত কুমারের চরিত্রে প্রাণ দেন ঈষাণ খাট্টার ও বিশাল জেঠওয়া
‘হোমবাউন্ড’ সিনেমায় মোহাম্মদ সাইয়ুব ও অমৃত কুমারের চরিত্রে প্রাণ দেন ঈষাণ খাট্টার ও বিশাল জেঠওয়া

‘হোমবাউন্ড’ সিনেমার নেপথ্য ঘটনাটি জানেন কি

সতর্কতা: লেখাটিতে ‘হোমবাউন্ড’ সিনেমার স্পয়লার আছে।

মোহাম্মদ সাইয়ুব ও অমৃত কুমার—একজন ‘সংখ্যালঘু’ মুসলিম, আরেকজন জাতিগতভাবে ‘দলিত’; ভারতের উত্তর প্রদেশের বাস্তী জেলার দেবরি গ্রামের দুই বন্ধুর জীবনের গল্প পর্দায় তুলে ধরেছেন পরিচালক নীরজ ঘেওয়ান। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ‘হোমবাউন্ড’ সিনেমাটি বহু দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।

‘মাসান’ নির্মাণের এক দশক পর ‘হোমবাউন্ড’ নিয়ে এলেন নীরজ ঘেওয়ান। এ বছরের মে মাসে ৭৮ তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটির প্রিমিয়ার হয়। প্রদর্শনী শেষে ছবিটি ৯ মিনিট ধরে স্ট্যান্ডিং ওভেশন পায়। পরে ২৬ সেপ্টেম্বর ভারতে মুক্তি পায়, ২১ নভেম্বরে নেটফ্লিক্সে আসে।

‘হোমবাউন্ড’ সিনেমার দৃশ্যে ঈষাণ খাট্টার ও বিশাল জেঠওয়া
সাইয়ুব ও অমৃতকে নিয়ে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই নিউইয়র্ক টাইমসে এক নিবন্ধ লেখেন ভারতীয় সাংবাদিক বাশারাত পীর। আবেগঘন নিবন্ধটি পড়েই ‘হোমবাউন্ড’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন নীরজ ঘেওয়ান।

পর্দায় মোহাম্মদ সাইয়ুব ও অমৃত কুমারের চরিত্রে প্রাণ দেন ঈষাণ খাট্টার ও বিশাল জেঠওয়া। সিনেমাটি অনেক দর্শককে আবেগতাড়িত করেছে, পাশাপাশি সমালোচকদেরও প্রশংসা কুড়িয়েছে। মার্কিন সাময়িকী হলিউড রিপোর্টারের ভাষ্য, এ বছরের সেরা ভারতীয় সিনেমার মধ্যে একটি ‘হোমবাউন্ড’। অস্কারে ‘সেরা আন্তর্জাতিক ছবি’ বিভাগে এটি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছে।

সাইয়ুব ও অমৃতকে নিয়ে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই নিউইয়র্ক টাইমসে এক নিবন্ধ লেখেন ভারতীয় সাংবাদিক বাশারাত পীর। আবেগঘন নিবন্ধটি পড়েই ‘হোমবাউন্ড’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন নীরজ ঘেওয়ান।

২০২০ সালে ভারতে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। সে সময় দুই বন্ধুর একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার ধারে জ্বরে আক্রান্ত অচেতন অমৃতকে কোলে আগলে রেখেছেন সাইয়ুব। পাশে পড়ে আছে অর্ধেক পানিভর্তি বোতল ও একটি লাল ব্যাগ। অনেকের মতো সাংবাদিক বাশারাত পীরকেও নাড়া দিয়েছিল ছবিটি।

২০২০ সালের ১৫ মে রাস্তার ধারে তোলা মোহাম্মদ সাইয়ুব ও অমৃত কুমারের ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল

ছবিটির সূত্র ধরে দিল্লি থেকে উত্তর প্রদেশের গলিঘুপচি ঘুরতে ঘুরতে বাস্তী জেলার দেবরি গ্রামে হাজির হন বাশারাত পীর। সাইয়ুবের কাছে ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনে নিউ ইয়র্ক টাইমসে নিবন্ধটি লেখেন তিনি।

‘আ ফ্রেন্ডশিপ, আ প্যান্ডেমিক অ্যান্ড আ ডেথ বিসাইড দ্য হাইওয়ে’ শিরোনামে নিবন্ধটি প্রকাশের পর আলোচিত হয়েছিল। এতে সাইয়ুব ও অমৃতের বন্ধুত্ব, লকডাউনের মধ্যে ট্রাকে চেপে গুজরাটের সুরাট থেকে বাড়ি ফেরার দুর্বিষহ যাত্রার কথা উঠে এসেছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছ থেকে নিবন্ধটির স্বত্ব কেনে সিনেমাটির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ধর্মা প্রোডাকশন। বাশারাত পীরের সঙ্গে সিনেমার গল্প লেখেন নীরজ ঘেওয়ান ও সুমিত রায়। চিত্রনাট্য লেখেন নীরজ ঘেওয়ান।

সিনেমার গল্পও লিখেছেন সাংবাদিক বাশারাত পীর

চিত্রনাট্যে সাইয়ুবের চরিত্রের নাম মোহাম্মদ শোয়েব আলী ও অমৃতের চরিত্রের নাম চন্দন কুমার রাখা হয়। পর্দার শোয়েব (ঈষাণ খাট্টার) ও চন্দন (বিশাল জেঠওয়া) ঘুরেফিরে সাইয়ুব ও অমৃতকেই মনে করিয়েছে।

‘হোমবাউন্ড’-এ সাইয়ুব ও অমৃতের জীবনের গল্পের পাশাপাশি কল্পনারও মিশেল রাখা হয়েছে। এতে আরেক চরিত্রে অভিনয় করেছেন জাহ্নবী কাপুর। সিনেমার নির্বাহী প্রযোজক মার্টিন স্করসেজি।

‘হোমবাউন্ড’ সিনেমার দৃশ্যে ঈষাণ খাট্টার ও বিশাল জেঠওয়া

জীবিকার তাগিদে সুরাটে

উত্তর প্রদেশের বাস্তী জেলার দেবরি গ্রামে সাইয়ুব ও অমৃতের বেড়ে ওঠা। দুজনই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। বয়স কাছাকাছি। ধর্ম আলাদা—একজন সংখ্যালঘু মুসলিম আরেকজন দলিত সম্প্রদায়ের। সমাজে দুজনই নিপীড়িত, অবহেলিত।

জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজনের মধ্যে বন্ধুত্বই দুজনকে এক করেছে। শৈশব থেকেই দেবরির আলো–হাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন। কেউ কেউ বলে, সাইয়ুব ও অমৃত নাকি হরিহর আত্মা। আনন্দ কিংবা দুঃখ—জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভাগাভাগি করে নেন, একে অপরের ছায়াসঙ্গী হয়ে ছিলেন।

একসময় জীবিকার তাগিদে গুজরাটের সুরাটে পাড়ি জমান সাইয়ুব ও অমৃত। কারখানায় কাজ নেন, ভাড়া বাসায় একসঙ্গে থাকেন। মাস শেষে থাকা–খাওয়ার খরচ বাদে বাকি টাকা পরিবারকে পাঠান।

এর মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয়। ২০২০ সালে লকডাউনের মধ্যে সাইয়ুব ও অমৃতের কারখানাও বন্ধ হয়ে যায়। কাজ হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন তাঁরা। ভাড়া বাসায় আটকা পড়েন।

সুরাট থেকে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের মতো সাইয়ুব ও অমৃতও বাড়ি ফেরার পথ খুঁজতে থাকেন।

‘হোমবাউন্ড’ সিনেমার দৃশ্যে ঈষাণ খাট্টার ও বিশাল জেঠওয়া

বাড়ি ফেরার দুর্বিষহ যাত্রা

সুরাট থেকে উত্তর প্রদেশের বাস্তী জেলার দূরত্ব কম নয়, ১ হাজার ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি। দূরপাল্লার বাস বন্ধ, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য চালানো বিশেষ ট্রেনে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সপ্তাহখানেক ধরে চেষ্টা করেও ট্রেনে উঠতে পারেননি সাইয়ুব ও অমৃত।

হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে অমৃতের জ্বর আসে। করোনাভাইরাস সন্দেহে যাত্রীরা মাঝরাস্তায় অমৃতকে জোর করে নামিয়ে দেন।
পারিবারিক অ্যালবামে থাকা অমৃত কুমারের ছবি

শেষমেশ উত্তর প্রদেশগামী একটি ট্রাকের খোঁজ পান। জনপ্রতি চার হাজার রুপি ভাড়া দিতে হবে। ট্রাকটি প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরে এক হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে। পুরো পথটা হেঁটে ট্রাকের কাছে পৌঁছান দুজন। ট্রাকে জায়গা কোথায়? ভেতরটা ভিড়ে ঠাসা, কোনোভাবেই উঠতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত ট্রাকচালকের মাথার ওপরের ঝুপড়িতে জায়গা পান।

পরদিন হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে অমৃতের জ্বর আসে। করোনা সন্দেহে যাত্রীরা মাঝরাস্তায় অমৃতকে জোর করে নামিয়ে দেন। মাঝরাস্তায় প্রিয় বন্ধুকে একা ফেলে যাবেন না সাইয়ুব, তিনিও নেমে পড়েন।

তখনো তাঁরা গ্রামের বাড়ি দেবরি থেকে ৩১০ কিলোমিটার দূরে। মাথার ওপর কাঠফাটা রোদ, জ্বরের সঙ্গে পানিশূন্যতায় ভুগতে থাকেন অমৃত। অচেতন হয়ে পড়েন। রাস্তাঘাট সুনসান, গাড়িঘোড়া নেই।

মোহাম্মদ সাইয়ুব, ছবিটি ২০২০ সালে তোলা

এর মধ্যে কাকতালীয়ভাবে এক অ্যাম্বুলেন্স মেলে। অমৃতকে মধ্য প্রদেশের শিবপুরি জেলার কোলারাসের স্থানীয় এক হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকেরা ধারণা করেছিলেন, অমৃত হিটস্ট্রোক করতে পারেন। থেরাপি দিয়েও কোনো কাজ হয়নি।

উন্নত চিকিৎসার জন্য অমৃতকে নিয়ে শিবপুরির এক হাসপাতালে ছুটলেন সাইয়ুব। অবস্থার অবনতি ঘটায় অমৃতকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। আর সাইয়ুবকে রাখা হয় কোয়ারেন্টিন ওয়ার্ডে। আইসিইউতে থাকা বন্ধুর জন্য প্রার্থনা করেন তিনি, বন্ধুকে নিয়ে দেবরি গ্রামে ফিরতে চান।

এর মধ্যে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য দুজনেরই নমুনা নেওয়া হয়, রিপোর্ট পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন সাইয়ুব।

‘হোমবাউন্ড’ সিনেমার পোস্টার
অমৃত মারা গেছেন—২০২০ সালের ১৬ মে কোয়ারেন্টিনে এসে সাইয়ুবকে বলে গেলেন এক নার্স।

অমৃত বাড়ি ফিরলেন, তবে...

অমৃত মারা গেছেন—২০২০ সালের ১৬ মে কোয়ারেন্টিনে এসে সাইয়ুবকে বলে গেলেন এক নার্স; করোনাভাইরাসে নয়, পানিশূন্যতায়। অমৃতের বাবাকে মৃত্যুর খবরটা দেওয়া হয়। তবে লকডাউনের বিধিনিষেধের কারণে প্রশাসনের কাছ থেকে শিবপুরি যাওয়ার অনুমতি পাননি বাবা।

বন্ধুর মরদেহ নিয়ে বাড়িতে (দেবরি) ফিরবেন সাইয়ুব। তবে এর জন্য করোনাভাইরাস রিপোর্টের ওপর নির্ভর করতে হবে তাঁকে। তাঁর রিপোর্ট নেগেটিভ এলেই বন্ধুকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন, পজিটিভ এলে ফেরার অনুমতি দেবে না প্রশাসন।

বন্ধু অমৃত কুমারের সমাধির পাশে মোহাম্মদ সাইয়ুব, ছবিটি ২০২০ সালে তোলা

সাইয়ুব প্রাণপণে প্রার্থনা করছিলেন, রিপোর্ট যেন নেগেটিভ আসে। শেষ পর্যন্ত দুজনের রিপোর্টই নেগেটিভ আসে। এরপর বন্ধুর মরদেহ নিয়ে দেবরিতে ফেরেন সাইয়ুব। স্থানীয় দলিত সমাধিক্ষেত্রে অমৃতকে সমাহিত করা হয়।

সাইয়ুব এখন কোথায়, কী করছেন

এখনো অমৃতের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন সাইয়ুব। বন্ধুর মৃত্যুর পর আর সুরাটে ফেরেননি তিনি। বছর তিনেক গ্রামেই কাজ করেছেন। পরে ২০২৩ সালের দিকে দুবাই পাড়ি দেন সাইয়ুব, সেখানে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

সিনেমাটি দেখতে গিয়ে বহু স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে।
মোহাম্মদ সাইয়ুব
বর্তমানে দুবাইয়ে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন সাইয়ুব

‘হোমবাউন্ড’ দুবাইয়েও মুক্তি পেয়েছে। সেপ্টেম্বরে পরিচালক নীরজ ঘেওয়ান ইমেইলে সাইয়ুবকে টিকিট পাঠান। চার বন্ধুকে নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাটি দেখেছেন ২৭ বছর বয়সী সাইয়ুব। সিনেমাটি আবেগতাড়িত করেছে তাঁকে।

১ অক্টোবর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাইয়ুব বলেন, ‘সিনেমাটি দেখতে গিয়ে বহু স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে। নীরজ ঘেওয়ান দুর্দান্ত সিনেমা নির্মাণ করেছেন।’

তবে চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে গল্পে খানিকটা পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে জানান সাইয়ুব। তাঁর ভাষ্য, ‘অমৃতর মৃত্যুর বছরখানেক পর নীরজ ঘেওয়ান আমার বাড়িতে আসেন। তিনি আমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে সিনেমা বানাতে চান। পুরো বিষয় শোনার পর আমি সম্মতি দিই।’

এরপরও কয়েক দফায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন নির্মাতা।

অমৃতের মৃত্যুর পর থেকে তাঁর পরিবারের পাশে আছেন সাইয়ুব। অমৃতের দুই বোনের বিয়েতে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেন তিনি।
অমৃত কুমারের ছবিটি এখন শুধুই স্মৃতি

অমৃতের পরিবারের পাশে সাইয়ুব

পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ছিলেন অমৃত কুমার। অমৃতের বাবা রামচরণ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, অমৃতের মৃত্যুর পর থেকে আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিন কাটছে তাঁদের। অমৃতের পাঁচ বোন ও এক ছোট ভাই রয়েছে।

অমৃতের মৃত্যুর পর থেকে তাঁর পরিবারের পাশে আছেন সাইয়ুব। রামচরণ জানান, ২০২১ সালে মেয়ে সীমা ও ২০১৪ সালে আরেক মেয়ে রিমার বিয়ের সময় সাইয়ুব আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন।

রামচরণ জানান, তাঁকেও সিনেমাটির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে তাঁরা (পরিচালক) তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেননি। ‘তারা আমাদের কাছ থেকে অমৃতকে নিয়ে তথ্য নিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে ১০ হাজার রুপি দিয়ে গেছে,’ বলেন রামচরণ।

এরপর আর সিনেমাটি নিয়ে কিছু জানেন না রামচরণ।

সূত্র: টাইম, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হলিউড রিপোর্টার